জ্বলে উঠে আলোর ভুবন

89

মাহবুব জন

সুবর্ণভূমি বিমানবন্দরে আমাদের পা পড়তেই সকলে বিষ্ময়ভরা দৃশ্য নিয়ে চোখ মেলল। সুবর্ণভূমি নামটি ‘সু-ওয়া-না-পুম’ হিসেবে উচ্চারিত হয়। নামটি সংস্কৃত থেকে নেয়া হয়েছে, যার অর্থ সোনালী ভূমি। নামটি বাছাই করেছেন রাজা ভূমিবল আদুল্যদি। বিমানবন্দরটি ব্যাংকক থেকে ৩০ কিলোমিটার পূর্বে সামুত প্রাকান প্রদেশের ব্যাং ফ্লি জেলার রাচা থেওয়ায় অবস্থিত।
আমাদের থাইল্যান্ডের যাত্রাটি ছিল ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ১২টার দিকে বিমান ছাড়লে আমরা ২টা ২০ মিনিটের মধ্যে থাইল্যান্ডের বিমানবন্দরে অবতরণ করলাম। বিমান অবতরণের সময় দেখতে পাচ্ছিলাম ব্যাংককের হাইরাইজ সব বিল্ডিং যেন আকাশের দিকে চোখ মেলে তাকিয়ে আছে। ভিসা চেকিং, লাগেজ ডেলিভারিং হলে একটু এগোতেই বাহির গেটের মুখোমুখি হাস্যময়ী চু এবং অ্যানি দুজন গাইড আমাদের বরণ করে নিলেন। তারা আমাদের ডলার ভাঙানো, মোবাইলে সিম সেটিং ইত্যাদি কাজে সবাইকে সহায়তা করলেন এবং আমাদের জন্য কাসেটসার্ট ইউনিভার্সিটির তিনটি মাইক্রোবাস ছুটে চলল ব্যাংকক শহরের শুকুমভিত ২৪ এর প্রেসিডেন্ট পার্ক হোটেলে।
হোটেল বুকিং শেষ হলে আমরা নিজ নিজ রুমে উঠে পড়লাম। তারপর হোটেলে ফ্রেশ হয়ে খাবার জন্য রেস্টুরেন্ট খুঁজতে বের হলে এক ইন্ডিয়ান হোটেলে রাতের খাবার সেরে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। হোটেলে যেতে রাস্তার দুপাশে দেখা মেলল ম্যাসাজ পয়েন্ট। সারাদিন শেষে সন্ধ্যে হলেই সরব হয়ে উঠে ম্যাসাজ পয়েন্টগুলো। এই ম্যাসাজটা অনেকটা নার্সিং সেবার মতো। ম্যাসাজের জন্য আবার ধার্য আছে প্রতি ঘণ্টা দুইশত থেকে শুরু করে উপরে সাতশত/আটশত বাথ। থাইল্যান্ডের প্রায় সব জায়গায় এই ম্যাসাজিং বিজনেস চালু আছে। শুধু হাইওয়ের পাশেই নয়, বড় বড় শপিংমলেও এই ম্যাসাজিং পয়েন্ট আছে। থাইল্যান্ড ম্যাসাজের জন্য এতটাই বিখ্যাত যে, দেশ ছেড়ে ইউরোপীয় বিভিন্ন দেশে এরা যায় এবং এর বিনিময়ে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে তারা।
পরদিন ট্রেনিংয়ের সেশন না থাকায় আমরা ভ্রমণে বেরিয়ে গেলাম। শান্তিচাই পার্ক। চাপাইরা নদীর পাশ ঘেঁষে এই পার্ক বেশ মনোরম এবং মনোমুগ্ধকর। এখানে রয়েছে সুসজ্জিত ছোট ছোট ফুলের বাগান, নদীর বাতাস, গাছের ছায়ায় বসে কিছুক্ষণ সময় কাটানো বেশ আরামদায়ক এবং ক্লান্তি বিদারক। এখানে দেখা যায়, কোনো বৃদ্ধ লোহার চেয়ারে লাঠি হাতে বসে জীবনের অতীত গুণে চলেছেন। কখন চোখ বন্ধ হয়ে আসে খেয়াল থাকে না। ভিনদেশী কোনো যুগল কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ভেতরের ভালোবাসা উজাড় করে যাচ্ছেন আর তার নীরব সাক্ষী হয়ে বয়ে চলেছে চাপাইরা নদীর ¯্রােত, গাছের ছায়া আর পাশ বেয়ে হেঁটে চলা নানা পর্যটক। এই পার্কের এক পাশে একটি দুর্গ এবং অন্যদিকে রয়েছে দেশের বিভিন্ন সমাজ-সংস্কৃতি ও পেশাজীবী মানুষের ছবি, যাঁরা দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কর্মকা-ে অবদান রেখেছেন।
এরপর আমাদের জন্য নিয়োজিত তিনটি মাইক্রো গাড়ি ছুটে চলল Wut Arun বৌদ্ধ মন্দিরের দিকে। আমাদের সাথে দুজন গাইড চু আর অ্যানি সার্বিক সহযোগিতা দিয়ে হাজির হলেন ঠিক বেলা ১২টায়। সুউচ্চ এই মন্দিরটি সকাল এবং বিকালের আকর্ষণীয় একটি দর্শনীয় স্থান। দুইশ বছরের এই মন্দিরটি দেখলে বোঝাই যায় না এর বয়স এত বছর। দেখলে মনে হয় এই তো সেদিন বুঝি নির্মিত হয়েছে। বিশ্বের নানা দেশ থেকে আগত পর্যটকে ভরপুর এই মন্দির। বড় আশ্চর্য লাগে, এর নির্মাণশিল্পের কাজ দেখে। কত নিপুণ হাতেগড়া এই মন্দির দুইশত বছর আগের মানুষের মাথায় এত আধুনিক শিল্প মনে হয় কোনো দিন পুরনো হবার নয়। মন্দির ঘেঁষা সিঁড়ি বেয়ে আমরা উপরে উঠলাম আর অবাক বিষ্ময়ে ভাবলাম কারুকার্যখচিত প্রতিটি মানুষের মিরাকল হাত। যে হাতের ছোঁয়ায় ফুটে উঠেছে বিভিন্ন মিথের শিল্প। এই সুউচ্চ মন্দিরের পাশে আরেকটি ছোট মন্দির রয়েছে, যেখানে বুদ্ধের প্রতিমার পাশে পুরোহিতের নিকট আশীর্বাদ নিয়ে যাচ্ছেন ভক্তরা। আর বাইরে সামনে ছোট একটা বাজার রয়েছে যেখানে বিভিন্ন সৌখিন জিনিসপত্র কেনাকাটায় ব্যস্ত অনেকে। তার সাথে চলছে ফটোসেশন বিভিন্ন পোশাকে, বিভিন্ন চরিত্রে।
চাপাইরা নদীর এপাার ওপার এই পার্ক, এই মন্দির যেন মহাকালের এক চুম্বকের আকর্ষণ। আমরা পৃথিবীর মানুষ ছুটে যাই অনাবিল সৌন্দর্যের টানে যুগে যুগে কালে কালে। নদীর স্রোতের মতো মানুষের স্রোত বয়ে চলেছে অবিরাম শুধু অজানাকে একনজর দেখা এবং জানার খোঁজে। পৃথিবীকে না জানলে আমাদের অনেক কিছুই অপরিচিত থেকে যায়। তাই তো ভ্রমণ শুধু ভেতরের সুপ্ত চেতনাকে জাগিয়ে তোলে না বরং নিজেদের বিকশিত করার সাথে সাথে সৃষ্টিকর্তার মহানুভবতাকেও উপলব্ধি করায়। অতঃপর ঘুরতে ঘুরতে আমরা ইন্দিরা স্কয়ারের সামনে একটি ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে দুপুরের লাঞ্চ শেষ করলাম। লাঞ্চ শেষ হলে আধা ঘণ্টার মধ্যে আমরা কেউ কেউ ইন্দিরা স্কয়ারে কিছু কেনাকাটা সেরে সন্ধ্যের আগে আমাদের হোটেলে ফিরে এলাম।
পরদিন ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮ শুরু হলো আমাদের ট্রেনিং সেশন। কাসেটসার্ট ইউনিভার্সিটির আইসিডিসি ভবনে সকাল ৮টা ৪৫ মিনিটে আমাদের মাধ্যমিক পর্যায়ের ২৩ জন শিক্ষকের জন্য আয়োজিত এই ট্রেনিংয়ের টিম লিডার প্রফেসর জাহাঙ্গীর হোসেন, ডিপিডি, টিকিউআই-২। সহযোগিতায় ছিলেন খালেদা আখতার, ডেপুটি সেক্রেটারি, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ এবং মানজার আলম, যুগ্ম পরিচালক, এইচ.এস.টি.টি.আই., খুলনা। আমাদের ট্রেনিংয়ের প্রতিপাদ্য বিষয় হলো- Teacher Core Subject Strengthening: English । অন্যান্য বিষয়ের মতো আমাদের ইংরেজি বিষয়ের ট্রেনিং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রোগ্রাম ম্যানেজার রিসালিন করপুজ (আরসি) আমাদের সকলের পরিচয় করিয়ে দিলেন Assoc Prof Chukiat Ruksorn (CR), Director, ETO, KU এর সাথে। পরিচালক চুকিয়াত আমাদের ছোট বক্তব্য দিয়ে আরম্ভ করলেন ট্রেনিংয়ের যাত্রা। “থাইল্যান্ডে আপনাদের স্বাগতম। আপনারা থাইল্যান্ডের মানুষ দেখুন, সমাজ দেখুন, সংস্কৃতি দেখুন আর ট্রেনিংয়ের নতুন অভিজ্ঞতা অর্জন করুন।”
তার এ বক্তব্যেই অনেক কিছুর আলোকপাত ঘটে। স্বাভাবিকভাবেই এক দেশ থেকে আরেক দেশে গেলে একটা না একটা কোনো পরিবর্তন আসেই। এই পরিবর্তনের সাথে নিজের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে যে বাস্তব জ্ঞানের উন্মেষ হয় তাই তো শিক্ষা। একে চিন্তার জগতে রসায়ন ঘটিয়ে বেছে নিতে হয় বৈচিত্র্যময় সৃষ্টিশীল চলার পথ। আমি আসলে এ লেখার মধ্য দিয়ে শুধু ট্রেনিংকে উপস্থাপিত করতে চাইনি। ট্রেনিং হচ্ছে সার্বিক কর্মপরিধির একটি। খাওয়া-দাওয়া, চলাফেরা, কথাবার্তা, জীবনযাত্রার সাথে খাপ খাইয়ে চলা সবকিছুই তো কালচার। এর সাথে খাপ খাইয়ে চলাটাই আসল ব্যাপার। প্রথমেই যেটা বলতে হয় তা হচ্ছে খাওয়া-দাওয়ার বিষয়টি। প্রত্যেক দেশেরই নিজ নিজ খাদ্যাভ্যাস থাকে। মাটির পৃথিবীর সব মাটি এক। ধান, গম, পেঁপে, কলা, শাক-সবজি মাটি থেকেই উৎপাদিত হয়। স্বাদে-গন্ধে হয়তো কিছুটা কমবেশি হতে পারে। আকার-আকৃতিতেও ছোট-বড় হতে পারে। আমরা মানুষও পৃথিবীর সবাই এক। এ মানুষেরও গায়ের রঙের পার্থক্য আছে, উচ্চতায় কমবেশ আছে। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে এসব পরিবর্তন হতে পারে। তাই তো মানুষের মন-মেজাজের অবস্থারও ভিন্নতর হয়ে থাকে। কোনো দেশের মানুষ আস্তে কথা বলে, কোনো দেশের মানুষ জোরে, কোনো দেশের মানুষ কাছাকাছি দাঁড়িয়ে অ্যাপ্রোচিং করে, কোনো দেশের মানুষ কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে। আর এই ভৌগোলিক কারনে জীবনযাত্রার মানও ভিন্ন হয়ে থাকে। কোনো দেশের মানুষ দুর্ভিক্ষে না খেয়ে মরে, কোনো দেশের মানুষ প্রাচুর্যের মাঝে বিলাসবহুল জীবনযাপন করে। কোনো দেশে মানুষ ঠা-ায় কাঁপে, কোনো দেশে মানুষ গরমে জ্বলে পুড়ে মরে।
তাই তো ভ্রমন এক বিচিত্র অভিজ্ঞতার সমাহার যা আমাদের জীবনকে ভালো-মন্দ, মানুষের কৃষ্টি-কালচার, খাদ্যাভ্যাস, আচার-আচরণ ইত্যাদি বহুবিধ বিষয়ে পরিচ্ছন্ন জ্ঞান দান করে।
পরিচালক চুকিয়াত সেই জন্যই হয়তো আমাদের বলেছিলেন, থাইল্যান্ডের সবকিছু ঘুরে ঘুরে দেখতে। শুধু বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান মানুষকে সম্পূর্ণ করতে পারে না। একজন মানুষকে ভালোভাবে বাঁচতে হলে তার চারপাশের বৈষয়িক জীবনের মোটামুটি একটা সাধারণ ধারণা থাকা প্রয়োজন। আর সেটা থাইল্যান্ডের সূবর্নভূমি বিমানবন্দরে নেমেই বুঝতে পেরেছিলাম এর অবকাঠামো এবং নির্মানশৈলীর চোখ ধাঁধাঁনো দৃশ্য দেখে। কী চমৎকার লাইটিং এবং জাঁকজমকপূর্ণ সাজ-সজ্জাম-িত সব শপিংস্টল। যে কারো মন ভরে যাবে। ইচ্ছা করলে হেঁটে যাওয়া যাবে, ইচ্ছা করলে চলন্ত সিঁড়ি বেয়ে যাওয়া যাবে। বিমানবন্দরটির দুটি সমান্তরাল রানওয়ে রয়েছে। উভয়েই ৬০ মিটার প্রস্থ। এটি ঘণ্টায় ৭৬টি ফ্লাইটের পরিচালনা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এটি প্রতি বছর ৪৫ মিলিয়ন যাত্রী এবং ৩ মিলিয়ন টন পণ্য/মাল নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এর যাত্রী টার্মিনালটি ৫ লাখ ৬৩ হাজার বর্গমিটার বা ৬০ লাখ ৬০ হাজার বর্গফুট। এটি বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম যাত্রী টার্মিনাল ভবন। বিমানবন্দরটির দুটি ৫ তলা বিশিষ্ট কার পার্কিং ভবন রয়েছে, য়েখানে পাঁচ হাজার গাড়ি রাখা যায়। এই যে বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম একটি বিমানবন্দরের ভবনে পথচলা, এটাও একটা কম শিক্ষা বা অভিজ্ঞতা নয়।

ব্যাংকক শহর। চারদিকে শুধু বিল্ডিং আর বিল্ডিং। সকাল হলেই শুরু হয় মানুষের চলাচল। এই শহরে আমাদের দেশের অটোরিকশার চেয়ে সাইজে একটু বড় যান চলাচল করে, যার নাম টুকটুক। নামটি শুনতে যেমন সুন্দর শোনায় দেখতেও ঠিক ততটাই সুন্দর। পাঁচ-ছয় জন যাত্রী নিয়ে চলে এ যানটি। এছাড়াও এ শহরে চলে প্রচুর ভাড়াটে মোটর বাইক। এসব মোটর বাইকে করে চাকরিজীবী মহিলা/পুরুষ, ছেলে/মেয়ে সবায় ছুটে চলে, সেই ভোর থেকে রাত অবধি। কার, মাইক্রোবাস, বাস, মোটর বাইক, টুকটুক সারাদিন অবিরাম ব্যাংকক শহরের রাস্তা ছুটে চলে। অথচ যততত্র কোনো হর্ন বাজে না এবং ট্রাফিক জ্যামে রাস্তায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা পথের ওপর অযথা সময় নষ্ট করতে হয় না। ঢাকা শহরের চেয়ে মোটেও কম গাড়ি চলে না এ শহরে। কিন্তু ট্রাফিক আইনের যে নিয়ম-কানুন তা পদে পদে মেনে চলা হয় এবং প্রায় প্রতিটি জায়গায় ওভারওয়ে থাকায় এখানে জ্যামের সৃষ্টি হয় না এবং চলাফেরায় শৃঙ্খলা দেখা যায় সব জায়গায়। ধরুন, আপনি কোনো রাস্তা হেঁটে অতিক্রম করছেন। সারি সারি গাড়ি আপনার রাস্তা পারাপারের জন্য অনায়াসেই দাঁড়িয়ে যাবে। আমরা যতবার এ রকম রাস্তা পারাপার হয়েছি ততবার এই শৃঙ্খলা পরিলক্ষিত হয়েছে। কত ভদ্র ও মার্জিত ওরা তা রাস্তায় চলাচলেও পরিলক্ষিত। ওপর দিয়ে আবার চলছে ম্যাগনেটিক ট্রেন। যে কোনো মাধ্যমেই অবিরাম চলা। 

পৃথিবীর অনেক দেশের মানুষ এ শহরে ছুটছে শুধু ছুটছে। কোনো যুবক-যুবতী আবার রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে বুকে বুক রেখে হাগিং করার দৃশ্যও আমাদের বুঝিয়ে দেয় ভালোবাসা কতটা খোলামেলা এখানে। রাস্তায় পঁচানব্বই ভাগ মানুষ হাফ প্যান্ট এবং শর্ট শার্ট পরে চলাফেরা করে। এসব অবাক হবার কোনো বিষয় নয়, কারনো এটাই এখানকার কালচার। এমন কোনো হোটেল নেই, যেখানে মদ নেই। পৃথিবী বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন ব্র্যান্ডের মদ এখানে প্রায় সকল শপে বিক্রি হয়। হোটেলগুলোয় পানির মতো ব্যবহার হচ্ছে মদ অথচ কোনো মাতলামি নেই। কত আনন্দচিত্তে এ সময় উড়ে যায় তা স্বচক্ষে না দেখলে কী আর সব বলে বা লিখে বোঝানো যায়!
রাস্তায় কোনো ধুলো নেই। এত গাড়ি এত মানুষ তবু পাখিরা ভীতু নয়। ভোর শুরু হয় কোকিলের ডাকে। ঘুঘুরা রোদের আশায় পাখা ঝাপটায়, ঠোঁটে ঁেঠাট মেলায়। হোটেলের জানালার বাইরে দুই জোড়া ঘুঘু এক অপরে পিঠের ওপর পালক আর ঠোঁটের ওপর ঠোঁট রেখে সকালের রোদের জন্য অপেক্ষার প্রহর মাড়ায়। আমারও মনে পড়ে যায়, ফেলা আসা পরিবার। ভালোবাসার রোদ মেখে যায় আমার শরীর। পাখি আর মানুষের পথ যেন একে অপরের চোখের জ্যোতি। এখানে পাখির বুক ভেদ করে কোনো গুলি চলে না। অথচ আমাদের এ দেশ সবুজে সবুজে ভরা মাঠ-ঘাট-নদীর দেশ এক সময় সাদা বক, সারসসহ হাজারো পাখির দৃশ্যে আমাদের চোখ জুড়িয়ে যেত। আজ কী সেই পাখির দেখা মেলে? পাখিরা উড়ে গেছে বহুদূর। পাখিদের বুক ভেদ করে চলেছে অনেক গুলি। পাখিরা চলে গেছে নিরাপদ কোনো সবুজের দেশে, আমাদের ছেড়ে।
ব্যাংককের সুপার মার্কেটগুলো অত্যাধুনিক। এখানে সবকিছু ডিজিটালাইজড। কিছু কিছু সুপার মার্কেট এত বড় যে গাইড ছাড়া অনেকে পথ হারিয়ে ফেলতে পারেন। আমরা সবাই একদিন গেলাম এমবিকে মার্কেট। আমাদের ট্রেনিংয়ের সেশন শেষ করে সন্ধ্যের আগ দিয়ে মার্কেটে পৌঁছলাম। যে যার মতো এদিক সেদিক কেনাকাটা শুরু করলে আমি একা হয়ে গেলাম। চারতলা পর্যন্ত ওঠানামা করে কারো আর দেখা মেলে না। শেষ পর্যন্ত নিচতলায় দেখি আমদের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ডেপুটি সচিব খালেদা আখতার ম্যাম কেনাকাটায় ব্যস্ত। আমরা একসাথে ম্যাগনেটিক ট্রেনে করে হোটেলে ফিরে এলাম। বিশাল এই মার্কেটের সাতটি গেট রয়েছে। গেট দিয়ে প্রবেশ করা আর বের হওয়াটাও একটা ব্যাপার।
পাতোয়া সি বিচ, কোন ল্যান দ্বীপ দেখার মতো সমুদ্র সৈকত। পাতোয়া সি বিচ রাতের বেলা দিনের চেয়ে বেশি উৎসবমুখর থাকে। রাস্তার ধারে প্রত্যেক বিল্ডিং যেন এক একটি উৎসবের বিচ্ছুরণ। লাল, নীল বিভিন্ন বাতি দ্বারা সজ্জিত, গান-বাজনায় মুখরিত এসব উৎসব বাইরে থেকেও উপভোগ করা যায়। আমাদের টিম লিডার প্রফেসর জাহাঙ্গীর স্যার, ডেপুটি সচিব খালেদা আখতারসহ আমরা টিমের কয়েকজন সদস্য টিকিট কেটে রাতের পাতোয়া কালচারাল শো অখঈঅতঅজ এনজয় করলাম। খুব মজা পেয়েছি। এসবের মধ্যে ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং জীবনের মর্ম খুঁজে পাওয়া যায়। থাইল্যান্ডকে বলা হয়, সাদা হাতির দেশ। নন নুক গার্ডেনে গেলে দেখা যায় হাতির নানা মজার শো এবং সেখানে আমরা নন নুক কালচারাল শো উপভোগ করলাম। নানান ফুল এবং পাতাবাহারি এই নন নুক গার্ডেন যে কাউকে মুগ্ধ করতে পারে।
পাতোয়া আর্ট গ্যালারি পৃথিবীর বৃহত্তম আর্ট গ্যালারিগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি। উপমহাদেশের মহান ব্যক্তিত্ব যেমন মহাত্মা গান্ধী এবং পৃথিবীবরেণ্য লিউনার্দো দ্য ভিঞ্চির মোনালিসার সেই বিখ্যাত হাসির আর্টসহ থাইল্যান্ডের অতীত বর্তমান কী নেই এই গ্যালারিতে। একবার ঢুকলে মনে হয় আবার দেখে আসি। বারবার দেখতে মন চায়।
পৃথিবী বিখ্যাত জেমস গ্যালারি এই পাতোয়া বিচে। এখানে যে কেউ অত সহজে প্রবেশ করতে পারে না। লাখ লাখ কোটি টাকার হিরা, মণি, মুক্তা, সোনার অলংকার আপনি পেতে পারেন। যা কখনো স্বপ্নেও হয়তো ভাবা যায় না, অলংকার এত সুন্দর হয় এত দামি হয়। আমাদের গাইড জানালেন, ভারতের বিখ্যাত চলচ্চিত্র নায়ক অভিতাভ বচ্চন এবং পৃথিবীর বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গ এই জেমস গ্যালারি থেকে তাদের অলংকার কিনে থাকেন।
থাইল্যান্ডের ঐতিহ্যবাহী একটি উপাদান ফ্লোটিং মার্কেট বা ভাসমান বাজার। প্রায় বারোটির মতো এরকম বাজার আছে। তার মধ্যে আমরা একটি পরিদর্শন করলাম। এ একরকম বিচিত্র অভিজ্ঞতা। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে মানুষ এই ঐতিহ্যবাহী ফ্লোটিং মার্কেট পরিদর্শন করেন, যা থাইল্যান্ডের একসময়ের জনপ্রিয় বাজার ছিল তা বর্তমানে চলমান।
এছাড়া দ্য গ্রান্ড প্যালেসসহ আমরা আরো একটি বৌদ্ধ মন্দির যেমন ওয়াট ফো, যেখানে জবপষরহরহম ইঁফফযধ যা এমন শৈল্পিকভাবে তামা-পিতলের ধাতব সংমিশ্রণে তৈরি করা হয়েছে চোখ পড়তেই মনে হয় বুদ্ধ কাত হয়ে ঘুমিয়ে আছেন। ইন্দিরা মার্কেট, বিগ সি, চাতুচক মার্কেট, বহুতল ভবন, বায়োকি স্কাই হোটেলে লাঞ্চের অভিজ্ঞতা আমাদের ট্রেনিংয়ের বাইরে সত্যি একজন মানুষের মনে দেখা থেকে জানার বিষয়গুলো সমৃদ্ধ করে বহুগুণ।

লেখক : সহকারী শিক্ষক (ইংরেজি), হরিমোহন সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, চাঁপাইনবাবগঞ্জ