৬ দফা বাঙালির কাছে বাঁচার দাবি হিসেবে উদ্ভাসিত হয়েছিল : প্রধানমন্ত্রী

34

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, জাতির পিতা ঘোষিত ৬ দফা বাঙালির কাছে সে সময় তাদের মুক্তির দাবি, বাঁচার দাবি হিসেবে উদ্ভাসিত হয়েছিল।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘৬ দফা দাবিটা জনগণ এমনভাবে লুফে নিয়েছিল, আমি জানি না, পৃথিবীর কোনো দেশে এত দ্রæত কোনো দাবি এত বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছিল কিনা।’
তিনি বলেন, ‘বাংলার মানুষ একে নিয়েছিল তাদের বাঁচার অধিকার হিসেবে এবং এটা প্রকৃতও তাই ছিল।’
ঐতিহাসিক ৬ দফা উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রবিবার (৭ জুন) গণভবনে পূর্বে ধারণকৃত আলোচনা অনুষ্ঠানে দেয়া ভাষণে এ কথা বলেন।
‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বাঙালির মুক্তির সনদ ৬ দফা’ শীর্ষক আলোচনা সভায় সভাপত্বি করেন শেখ হাসিনা।
বাংলাদেশ টেলিভিশনসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে আলোচনা সভাটি প্রচারিত হয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এটাই ছিল সব থেকে বড় বিষয় যে, এত দ্রæত এই দেশের মানুষ ৬ দফাকে শুধু সমর্থনই করেনি তারা স্বায়ত্তশাসনের এই দাবিকে নিজের দাবি হিসেবে গ্রহণ করল।’
১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, ‘সে সময় দেখা গেল আমরা খুবই অরক্ষিত। ভারত-পাকিস্তান যখন তাসখন্দ চুক্তি করল তখনো এই পূর্ববঙ্গ ছিল অরক্ষিত। তারপরে যখন ৬ দফা দেয়া হলো তখনই এ দেশের গণমানুষ জেগে উঠল।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ৬ দফার ভিত্তিতেই সত্তরের নির্বচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে সমগ্র পাকিস্তানে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পায়। কাজেই ৬ দফা এবং ৭ জুনের কারণে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। সেজন্য দিবসটি আমাদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
তিনি বলেন, ১৯৫২ সালে বুকের রক্ত দিয়ে আমাদের মাতৃভাষার মর্যাদাকে রক্ষা করতে হয়েছে। আবার ৭ জুন আমাদের স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন, সেখানেও রক্ত দিয়ে আমাদেরকে লিখে যেতে হয়েছে যে, আমরা আমাদের স্বাধিকার চাই।
বিশিষ্ট লেখক ও গবেষক সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন।
শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি এবং কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক বাংলাদেশ টেলিভিশন থেকে আলোচনায় অংশ নেন।
করোনা ভাইরাস পরিস্থিতির কারণে ডিজিটাল মাধ্যমে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জন্মশতবর্ষ উদযাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির প্রধান সমন্বয়ক ড. কামাল আব্দুল নাসের চৌধুরীও অংশ নেন।
১৯৬৬ সালের ৭ জুন ৬ দফা আন্দোলনকে সফল করার জন্য আওয়ামী লীগের ডাকা হরতালে তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকযন্ত্রের পুলিশ ও ইপিআর’র গুলিতে আত্মাহুতিদানকারী শ্রমিক নেতা মনু মিয়া, আবুল হোসেন, শফিক, শামসুরসহ সব শহীদদের প্রধানমন্ত্রী শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘বঞ্চনার বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব আজীবন সংগ্রাম করেছেন। আর তারই পথ বেয়ে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। কাজেই আজ এই ৭ জুন যারা জীবন দিয়ে সেদিন বাঙালির অধিকারের কথা বলে গেছেন- আমি তাদের স্মরণ করছি।’
তিনি আরো বলেন, ‘স্মরণ করছি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে, যিনি সময়োচিত পদক্ষেপ নিয়ে ধাপে ধাপে এই বাঙালিকে স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেছিলেন এবং আমাদেরকে স্বাধীনতা এনে দিয়ে গেছেন।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘৭ জুনের হরতাল থেকে শুরু করে আন্দোলনে আমার মায়ের বিরাট ভূমিকা ছিল। আমি আজকের দিনে বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবকেও স্মরণ করছি। স্মরণ করছি জাতীয় চার নেতা এবং মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহীদকে এবং সম্ভ্রমহারা দুই লাখ মা-বোনকে।’
তিনি জাতির পিতার ‘কারাগারের রোজনামচা’ বইয়ের কথা উল্লেখ করে বলেন, আপনারা এই বইটি পড়লে দেখতে পাবেন, সে সময় কিভাবে পাকিস্তানি শাসকশ্রেণি এ দেশের মানুষের ওপর গ্রেপ্তার এবং অত্যাচার-নির্যাতন চালিয়েছিল।
তিনি বলেন, সে সময় একদিকে অত্যাচার-নির্যাতন চলেছে অন্যদিকে আওয়ামী লীগের যিনিই সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পাচ্ছেন তাকেই গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। পাশাপাশি এ দেশের মানুষ আরো বেশি করে সচেতন হচ্ছে, সুসংগঠিত এবং ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। অবশ্য কিছু দালাল ছাড়া।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সবসময় কিছু’ দালাল থাকে। এটাই সমস্যা।’ জাতির পিতা বাঙালি জাতির অধিকার আদায়ে ৬ দফা দাবি উত্থাপন করেন, উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ভারত-পাকিস্তানের ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের পর লাহোরে সর্বদলীয় বিরোধী দলের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত গোলটেবিল বৈঠকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব প্রদানকালে জাতির পিতা প্রথম ৬ দফা দাবি উত্থাপন করেন। যে দাবির মূল বক্তব্য ছিল- প্রদেশ হিসেবে আমাদের দেশকে সুরক্ষিত, অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী এবং এই অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক উন্নতি করা। সেই সাথে বাঙালির যে অস্তিত্বের দাবি, সেই দাবিটা তুলে ধরা।’
তিনি আরো বলেন, ‘দুঃখের বিষয় ওই সভায় দাবি উত্থাপনকালে বঙ্গবন্ধুকে বাধা দেয়া হয় এবং আমাদের দেশেরও অন্য দলের নেতৃবৃন্দও জাতির পিতাকে বাধা দিয়েছিলেন।’
সে সময় গোলটেবিল আলোচনার পরদিন জাতির পিতা সংবাদ সম্মেলন করে এই স্বায়ত্তশাসন যে পাকিস্তানের প্রত্যেকটি প্রদেশেরই দাবি, সেই কথা তুলে ধরেছিলেন বলেও প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন।
তিনি বলেন, ‘পরে ঢাকায় ফিরে বিমানবন্দরেও বঙ্গবন্ধু সংক্ষিপ্তাকারে এই দাবি তুলে ধরেছিলেন। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের সভায় এবং কাউন্সিল অধিবেশনে ৬ দফা গ্রহণ করা হয়।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতা ৬ দফা দেয়ার পর সারা বাংলাদেশে এটা প্রচার করার উদ্যোগ নেন। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, শ্রমিক লীগ এবং শ্রমিক ইউনিয়নের নেতাদের এই দাবি সারাদেশে প্রচারের দায়িত্ব দেয়া হয়। মাত্র ৩৫ দিনে জাতির পিতা সারাদেশে ৩২টি সভা করেন। কিন্তু এর মধ্যে জাতির পিতা যখন যেখানে যেতেন সেখানে তাকে গ্রেপ্তার করা হতো। এভাবে ৮ বার তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
শেখ হাসিনা আরো বলেন, ‘সর্বশেষ নারায়ণগঞ্জের আদমজীনগরের জনসভা শেষে বঙ্গবন্ধু ঢাকায় ফিরলে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর তাকে আর জামিন দেয়া হয়নি।’ ফলে আন্দোলন-সংগ্রাম কঠোর পরিস্থিতি পরিগ্রহ করে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
এরপর আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা এবং দেশবাসীর জাতির পিতাকে মুক্ত করে আনার ’৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, স্বাধীনতার কথাও প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে তুলে ধরেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘১৯৪৮ সালে ভাষার অধিকার যখন কেড়ে নেয়া হলো তখন জাতির পিতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তখনই তিনি উদ্যোগ নিলেন এবং মাতৃভাষা বাংলাকে প্রতিষ্ঠার আন্দোলন শুরু করেন।’
শেখ হাসিনা বলেন, ’৭৫ এর ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে নির্মমভাবে হত্যা করে আমাদের অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করা হয়েছিল। ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ সরকারে আসার পর যে উদ্যোগ গ্রহণ করে তার ফলে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যাচ্ছিল।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হয়েছিল। কিন্তু করোনা ভাইরাস এসে সকলের জীবনকে স্থবির করে দিয়েছে। এটা শুধু বাংলাদেশ নয় সমগ্র বিশ্বব্যাপীই এখন সমস্যা।
জাতির পিতার কন্যা বলেন, ‘প্রতিটি অর্জনই আমাদের রক্তের বিনিময়ে করতে হয়েছে। শহীদের রক্ত কখনো বৃথা যায় না। এটা বৃথা যেতে পারে না।’
তিনি বলেন, ‘আমি আশা করি আমাদের দেশের প্রত্যেকটি মানুষ স্বাস্থ্য সুরক্ষার নিয়ম মেনে চলবেন। ইনশাআল্লাহ আমরা মুক্তি পাব।’
প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, ‘বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে এবং জাতির পিতার স্বপ্নের ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ আমরা গড়ে তুলব।’
তিনি আজকের আলোচক এবং প্রবন্ধ রচয়িতাকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানান।