৫০ বছর ধরে পুথিপাঠ করে চলেছেন নাসিরুদ্দিন

40

নাসিরুদ্দিন তার ভালো নাম। তবে ‘ভোলা’ নামেই সমধিক পরিচিত। জাতীয় পরিচয়পত্র অনুযায়ী বয়স ৬৬ পার হয়েছে। খেটে খাওয়া মানুষটির শরীরে এখন বয়সের ভার দানা বাঁধতে শুরু করেছে। তবুও থেমে থাকেননি একটি জায়গাতে, তাহলো পুথিপাঠ। প্রায় ৫০ বছর ধরে নিয়মিতই পুথিপাঠ করে চলেছেন এই মানুষটি।
নিজের মনের খোরাক ও তৃপ্তির জন্যই তিনি পুথিপাঠ করেন। পাঠ না করলে মনে হয়, কি যেন করা হয়নি আপনভোলা নাসিরুদ্দিনের। তার বাড়ির আশপাশে এমনকি গোটা গ্রামের প্রবীণদের মধ্যে এমন কেউ নেই যে, তার পুথিপাঠ শোনেননি।
বিদ্যালয়ের গণ্ডি দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত হলেও পুথিপাঠটাকে রপ্ত করতে পেরেছেন বেশ ভালোভাবেই। দশ-এগার বছর বয়স থেকেই পুথিপাঠ শুরু তার। চর্চার শুরুটা বাবা কিসমত আলীর কাছ থেকেই।
দশ ভাইয়ের মধ্যে ষষ্ঠ নাসিরুদ্দিন। প্রথমে বসতি ছিল চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল উপজেলার নেজামপুরে। তার বয়স যখন ১০-১১ বছর, তখন তার বাবা বসতি গাড়েন নাচোল পৌরসভার মোমিনপাড়া গ্রামে। নাচোল বাসস্ট্যান্ড-স্টেশন রোডের মাঝামাঝিতে অবস্থিত গ্রামটি।
বাবা কিসমত আলীর পুথিপাঠের অভ্যাসটা দশ ভাইয়ের মধ্যে শুধু নাসিরুদ্দিনই আয়ত্ত করতে পেরেছিলেন। কিশোর বয়স থেকে যে পুথিপাঠ শুরু করেছিলেন এখন অবধি তা চলতেই আছে। আশপাশের মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০-২৫ বছর আগে রাতের নিস্তব্ধতা চিরে যে মানুষের কণ্ঠটি গমগম করে ভেসে আসত, সে হলো নাসিরুদ্দিন। বেশিরভাগ সময় রাতেই পুথিপাঠ করেন নাসিরুদ্দিন। লণ্ঠন-চেরাগ জ¦ালিয়ে দিনের পর দিন পুথিপাঠ করেছেন তিনি। কোলাহল না থাকায় দশ বাড়ি পরেও তার পুথিপাঠের শব্দ শোনা যেত। কারো কারো আবার এই পুথিপাঠ শুনে ঘুমানোর অভ্যাসও তৈরি হয়ে গিয়েছিল। এখন মানুষের চাপ বেড়েছে, বেড়েছে যান্ত্রিক কোলাহলও। আর তাই তো তার পুথিপাঠের আওয়াজ বেশিদূর পর্যন্ত গড়ায় না। তবে এখন আর লণ্ঠনের আলোতে পুথিপাঠ করতে হয় না, তার ঘরেও বিদ্যুৎ লেগেছে।
জীবিকার তাগিদে কৃষিকাজ থেকে শুরু করে রিকশা-ভ্যান চালানোসহ দিনমজুরি করেছেন তিনি। স্ত্রী জোবেদার গর্ভে এসেছিল ছয় সন্তান। এর মধ্যে দুই সন্তান মারা গেছে। তিন ছেলে আর এক মেয়ে নিয়েই তাদের জগৎ সংসার। সবার বিয়ে হয়ে গেছে। ছেলেরাও রিকশা-ভ্যান চালিয়ে রোজকার জীবনযাপন করে।
রাতের বেলা নাসিরুদ্দিনের পুথিপাঠ শুনে প্রথম প্রথম স্ত্রী জোবেদার বিরক্তি লাগলেও কিছুদিন পর তা সয়ে যায়। এই প্রসঙ্গে নাসিরুদ্দিন মজা করে বলেন, ওর (জোবেদার) ঘুমের ওষুধই এটা!
বর্তমানে নাসিরুদ্দিনের সংগ্রহে রয়েছে ৫টি পুথি। সবকটিই পুরনো। তবে একটি বেশি পুরনো শেখ কুমুরুদ্দিনের ‘খায়রল হাশার’ পুথিটি। এটি তার বাবার কাছ থেকে পাওয়া এবং তারও জন্মের আগের। তার মতে, পুথিটির বয়স ৭০ থেকে ৮০ বছর হবে। সংগ্রহে থাকা অন্য পুথিগুলো হলোÑ জৈগুনের পুথি, আসল গাজির পুথি, হাতেম তাই। আরেকটি পুথি থাকলেও অনেকখানি পাতা ছিঁড়ে যাওয়ায় নাম পাওয়া যায়নি।
তার সংগ্রহে থাকা পুথিগুলো সম্পর্কে জেলার গম্ভীরার নানা হিসেবে খ্যাত প্রবীণ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সাংবাদিক মাহবুবুল আলম বলেন, নাসিরুদ্দিনের সংগ্রহে থাকা পুথিগুলো অবশ্যই পুরনো এবং এ সময়ের জন্য দুর্লভ। তিনি আরো বলেন, তার (নাসিরুদ্দিন) পুথি শোনার সুযোগ হয়নি। তবে তার কাছে থাকা পুথিগুলো প্রমাণ করে পুথির প্রতি তার প্রগাঢ় ভালোবাসা। আর ভালোবাসা না থাকলে দীর্ঘ বছর ধরে এগুলো সংরক্ষণ করে রাখা সহজ কাজ নয়।
নাসিরুদ্দিনের পুথিপাঠ সম্পর্কে মোমিনপাড়া গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র হেলথ ভিজিটর মেরিনা খাতুন জানান, সময় হিসাব করে বলা সম্ভব নয়। তবে অনেক বছর ধরে রাতের বেলা ভোলার পুথিপাঠ শোনা গেছে। এই একই কথা জানান ওই গ্রামের আরো কয়েকজন।
কথা হয় নাসিরুদ্দিনের সঙ্গে। বলেন, মনের তৃপ্তির জন্যই পুথিপাঠ করেন তিনি। সারাদিনের কর্মব্যস্ততা শেষে পুথিপাঠের মধ্য দিয়েই ক্লান্তি ভুলে যান। তিনি জানান, আগে পুথিপাঠের জন্য যেখানেই ডাক পড়েছে, শোনাতে গিয়েছেন; তবে পয়সার বিনিময়ে নয়। এমনও দিন গেছে সারারাত পুথিপাঠ করে শুনিয়েছেন তিনি। তবে এসবই হয়েছে ২০-২৫ বছর আগে।
নাসিরুদ্দিনের আক্ষেপ, একটা সময় পুথিপাঠ শোনার প্রতি মানুষের আগ্রহ থাকলেও যখন থেকে মানুষের ঘরে ঘরে টেলিভিশন হতে শুরু করেছে তখন থেকেই এর প্রতি মানুষের আগ্রহ হারিয়ে গেছে। এখন কালেভদ্রেও কেউ পুথিপাঠের জন্য বলে না। তিনি বলেন, পুথিপাঠ না করলে তার ঘুম আসে না। কখনো পুথি নিয়ে না বসতে পারলেও যেগুলো মুখস্থ আছে, সেগুলোই শুয়ে শুয়ে পাঠ করেন।
‘ভোলা’ বলেন, এখন কোনো কাজ করতে পারেন না বয়সের ভারে। তবুও নিয়মিত পুথিপাঠ করেন তিনি। তবে আগের মতো পারেন না, গলার জোরও কমে এসেছে। কিন্তু পুথিপাঠে মনের জোরটা রয়েই গেছে আপনভোলা নাসিরুদ্দিনের।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ সরকারি টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের বাংলা বিভাগের ইন্সট্রাক্টর ও গবেষক ড. ইমদাদুল হক মামুন বলেন, পুথিপাঠ সংস্কৃতি চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে প্রায় হারাতে বসেছে। এই সময়ে একজন মানুষ ৫০ বছর ধরে পুথিপাঠ করে চলেছেন, এটা সত্যিই বিস্ময়কর। আমার মনে হয়, খুঁজলে নাসিরুদ্দিনের মতো আরো অনেককেই পাওয়া যেতে পারে। তার কাছে থাকা পুথিগুলোও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বিকল্পভাবে সংরক্ষণ করা যেতে পারে। তিনি বলেন, ঐতিহ্য ধরে রাখতে নাসিরুদ্দিনের মতো মানুষদের খুঁজে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা দেয়ার পাশাপাশি সম্মানিত করা দরকার। এক্ষেত্রে শিল্পকলা একাডেমি বড় ভূমিকা নিতে পারে।