Last Updated on জানুয়ারি ৩১, ২০২৫ by
২৫০ শয্যাবিশিষ্ট চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা হাসপাতালে খাবার বরাদ্দ একশ রোগীর
চাঁপাইনবাবগঞ্জে ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেলা হাসপাতালে ২৫০ জন রোগীর খাবার সরবরাহের চাহিদা থাকলেও খাবার পাচ্ছেন ১০০ জন রোগী। ২০২২ সালে খাবার (পথ্য) চেয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয়া হলেও অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদন না পাওয়া সব রোগীকে খাবার দেয়া যাচ্ছে না বলে হাসপাতাল সূত্র জানিয়েছে।
জেলাবাসীর প্রধান ভরসাস্থল চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর আধুনিক হাসপাতালটি ১৯৮৪ সালে ৫০ শয্যায় রূপান্তরিত হয় এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে ২০০৩ সালে ৫০ শয্যা হতে ১০০ শয্যায় উন্নীত করা হয়। পরে ২০২০ সালে হাসপাতালটিকে ১০০ শয্যা হতে ২৫০ শয্যায় উন্নীত করে নামকরণ করা হয়— ‘২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেলা হাসপাতাল, চাঁপাইনবাবগঞ্জ”। সেই সঙ্গে সেবা চালুকরণের প্রশাসনিক অনুমোদন পাওয়া যায়।
২০২২ সালে ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেলা হাসপাতালটি রাজস্ব খাতে স্থায়ীভাবে পদ সৃজনে মঞ্জুর হয়। কিন্তু সব ক্ষেত্রে ২৫০ শয্যার জনবল পাওয়া যায়নি। ফলে গড়ে ভর্তি রোগী আড়াইশজনের অধিক হলেও অনুমতি না থাকায় ১০০ জন রোগীর দৈনিক পথ্য (খাবার) সরবরাহ করা হয়। যে কারণে বাকি রোগীদের বাইরে থেকে খাবার কিনে খেতে হয়। এতে করে বেশি দুর্ভোগে পড়তে হয় দরিদ্র রোগীদের।
গত সোমবার হাসপাতালের পুরাতন ভবনের বারান্দায় ভর্তি থাকা শিবগঞ্জ উপজেলার অ্যাকাডেমি মোড় এলাকার শান্তিজুল ইসলাম জানান, দুই পা অবস হয়ে গেলে ২৫ জানুয়ারি জেলা হাসপাতালে ভর্তি হন। কিছু ওষুধ হাসপাতাল থেকে পাচ্ছেন এবং কিছু বাইরে থেকে কিনতে হচ্ছে। খাবার পাচ্ছেন কিনা জানতে চাইলে বলেন— না, খাবার দেয়া হয় না।
তার পাশেই ভর্তি ছিলেন সদর উপজেলার শাহজাহানপুর ইউনিয়নের চরসেখালিপুর গ্রামের মঞ্জুর রহমান। তিনিও একই ধরনের কথা বলেন। তবে তার অসুখ ভিন্ন।
হাসপাতাল সূত্র জানায়, ১০০ শয্যার আধুনিক সদর হাসপাতালের পরিবর্তে ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের রোগীর পথ্য সরবরাহের প্রশাসনিক অনুমোদনের জন্য ২০২২ সালের ১২ সেপ্টেম্বর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয়া হয়েছিল। কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে অনুমতি না পাওয়ায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সেই চিঠির কোনো সুরাহা করতে পারেনি। পরে সর্বশেষ ২০২৩ সালের ৬ নভেম্বর পত্র দেয়া হয়; কিন্তু কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।
এদিকে হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায়, জরুরি বিভাগসহ আউটডোরে রোগীদের ভিড়। হাসপাতালের নতুন ভবনে চিকিৎসকদের চেম্বারের সামনে লম্বা লইনে দাঁড়িয়ে আছেন সেবা নিতে আসা শত শত সাধারণ মানুষ। পুরুষের চেয়ে নারীর সংখ্যায় বেশি। হাসপাতালের ফার্মেসির সামনেও ওষুধ নেয়ার জন্য কয়েকটি লাইন দেখা যায়।
হাসপাতাল সূত্র জানায়, প্রতিদিন গড়ে পাঁচ শতাধিক রোগী আউটডোরে চিকিৎসা নিতে ভিড় করেন। এইসব রোগীর চিকিৎসা দিতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হয় চিকিৎসকদের। অন্যদিকে সবমিলিয়ে গড়ে প্রায় তিন শতাধিক রোগী ভর্তি থাকছে প্রতিদিন।
হাসপাতাল সূত্রমতে, ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা হাসপাতালের সেবাগুলোর মধ্যে রয়েছে— গাইনি ও প্রসূতি সেবা, নবজাতক ও শিশু সেবা, ডায়রিয়া ব্যবস্থাপনা, দন্ত চিকিৎসা, চক্ষু সেবা, নাক-কান-গলা, অপারেশন সার্ভিস (সার্জারি, অর্থপেডিক, গাইনি, নাক কান গলা, চক্ষু ও দন্ত)। এছাড়াও বহির্বিভাগ ও জরুরি সেবা, মেডিসিন, এএনসি ও পিএনসি ও ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার, জলাতঙ্ক ভ্যাকসিনেশান কর্নার, ল্যাব সার্ভিস, এক্সরে সার্ভিস ও আলট্রাসোনোগ্রাফি সার্ভিস চালু রয়েছে।
সূত্র আরো জানায়, এই হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ও সহকারী পরিচালক, চিকিৎসক, কর্মকর্তা-কর্মচারীর মোট মঞ্জুরিকৃত পদ হচ্ছে ৩৭৭টি। এর মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক ও সহকারী পরিচালকসহ কর্মরত আছেন ২৬৫ জন এবং ১১২টি পদে কোনো জনবল নেই।
শূন্য পদগুলোর মধ্যে রয়েছে— সিনিয়র কনসালটেন্ট (মেডিসিন), সিনিয়র কনসালটেন্ট (চক্ষু), সিনিয়র কনসালটেন্ট (শিশু), সিনিয়র কনসালটেন্ট (গাইনি অ্যান্ড অবস), সিনিয়র কনসালটেন্ট (সার্জারি), সিনিয়র কনসালটেন্ট (নাক কান গলা), সিনিয়র কনসালটেন্ট (চর্ম ও যৌন), সিনিয়র কনসালটেন্ট (অ্যানেসথেসিয়া), জুনিয়র কনসালটেন্ট নেই (প্যাথলজি), জুনিয়র কনসালটেন্ট (ফিজিক্যাল মেডিসিন অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন)। গুরুত্বপূর্ণ এই পদগুলোয় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক না থাকায় সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে জেলাবাসী।
অন্যান্য বিভাগে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রয়েছেন— সিনিয়র কনসালটেন্ট (অর্থো-সার্জারি), সিনিয়র কনসালটেন্ট (কার্ডিওলজি), জুনিয়র কনসালটেন্ট (মেডিসিন), জুনিয়র কনসালটেন্ট (শিশু), জুনিয়র কনসালটেন্ট (অর্থো-সার্জারি), জুনিয়র কনসালটেন্ট (সার্জারি), জুনিয়র কনসালটেন্ট (নাক কান গলা), জুনিয়র কনসালটেন্ট (অ্যানেসথেসিয়া), জুনিয়র কনসালটেন্ট (রেডিওলজি), জুনিয়র কনসালটেন্ট (গাইনি অ্যান্ড অবস), জুনিয়র কনসালটেন্ট (চর্ম ও যৌন), জুনিয়র কনসালটেন্ট (কার্ডিওলজি)। এছাড়া আবাসিক মেডিকেল অফিসার ও মেডিকেল অফিসার কর্মরত আছেন।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা স্বাস্থ্য অধিকার ফোরামের সভাপতি প্রফেসর সুলতানা রাজিয়া বলেন— ২৫০ শয্যার এই হাসপাতালটির বেশ কয়েকটি সমস্যা রয়েছে। তার মধ্যে বাথরুমগুলোর পানি খুবই খারাপ, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অভাব, পরীক্ষা-নিরীক্ষার যন্ত্রপাতির ঘাটতি, প্রসূতিদের ওয়ার্ডটি অনেক উপরে এবং লিফট বিকল হলে প্রসূতি মায়েদের সিঁড়ি ভেঙে উঠতে হয়। তবে বর্তমানে খাবার পানি ভালো মানের পাওয়া যাচ্ছে। সমস্যাগুলো সমাধানের দাবি জানান তিনি।
সিনিয়র কনসালটেন্ট ঘাটতি থাকার ব্যাপারে তত্ত্বাবধায়ক ডা. মো. মাসুদ পারভেজ বলেন— প্রায় সব বিষয়ে সিনিয়র হোক বা জুনিয়র হোক কনসালটেন্ট আছেন। বর্তমানে শুধু চক্ষু বিভাগটা ফাঁকা আছে। যিনি ছিলেন, তিনি বদলি হওয়ায় আপাতত চক্ষু রোগীদের সেবা দেয়া যাচ্ছে না। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে, হয়ত চিকিৎসক পেয়ে যাবো।
হাসপাতালে পর্যাপ্ত নার্স রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর ১৬ জন জনবল বদলিজনিত কারণে এবং উন্নয়ন খাতে যারা আউট সোর্সিংয়ের মাধ্যমে কর্মরত ছিল, বরাদ্দ না থাকায় তাদের চাকরি নেই। ফলে এই খাতে জনবলের কিছুটা সংকট চলছে। তবে এটা কাটিয়ে ওঠার জন্য আমরা মন্ত্রণালয়ে লিখিত আবেদন দিয়েছি।
হাসপাতাল পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে তিনি বলেন— সারাদেশের হাসপাতালগুলোর চেয়ে আমাদের হাসপাতাল অনেক বেশি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। আমরা চেষ্টা করি, সবসময় এই হাসপাতালের ভেতর ও বাইরের পরিবেশ সুন্দর রাখার। আমাদের মান অনেক ভালো। কারণ মাস্টাররোলে যেসব কর্মচারী দিয়ে আমরা কাজ করিয়ে থাকি, এই সুযোগটা অন্যদের নেই।
বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের ব্যাপারে ডা. মাসুদ পারভেজ বলেন, এই এলাকাটি বরেন্দ্র অঞ্চল হবার কারণে খাবার পানির তীব্র সংকট। তবে এই সংকট কাটাতে আমরা ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে ইলেকট্রিক পানির ফিল্টারের ব্যবস্থা করেছি, সেখান থেকে রোগী ও তাদের স্বজনরা পানি নিয়ে পান করছেন। এছাড়াও হাসপাতালের পাশে একটি টিউবওয়েল আছে সেই পানিও পানযোগ্য। সেখান থেকেও পানি নিয়ে গিয়ে অনেকেই পান করে।
ডা. মাসুদ বলেন— আমাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় রয়েছে পিডব্লিউডির মাধ্যমে একটি ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট স্থাপন করার। সেটা হয়ে গেলে পানযোগ্য পানির সম্পূর্ণরূপে সমাধান হবে।
হাসপাতালের খাবারের ব্যাপারে তিনি বলেন— ২৫০ শয্যার হাসপাতাল, জনবল ২৫০ শয্যার কিন্তু যে কোডে আমরা বরাদ্দ পাই সেই কোড হচ্ছে ২১১, এই কোডে আমরা ১০০ জনের বেশি খাবার দিতে পারি না। আমার উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে লিখেছি। হাসপাতালের কোড যদি ২১০ করা যায় তাহলে আমরা ২৫০ জন রোগীকে খাবার দিতে পারব। এটা অর্থ বিভাগ করে থাকে। আমরা অনেক দিন থেকেই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি, বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন আছে। আশা করি হয়ত এটা হয়ে যাবে।
হাসপাতালের সেবার মান অনেক ভালো উল্লেখ করে ডা. মাসুদ পারভেজ বলেন— কোনো সময় ৫০০ মতো রোগী ভর্তি থাকে। সকল বিভাগেই সেবার মান ভালো রাখার চেষ্টা করা হয়। বেশ কয়েকবার দেশের অন্য জেলা হাসপাতালগুলোর সঙ্গে সেবার মান নির্ণয়ে ১ম, ২য় ও ৩য় অবস্থান অর্জন করেছে এই হাসপাতাল।