সোনিয়া শীল
কখনো প্রিয়জনের কাছে আবদারের সুরে কিংবা প্রিয়জন ছেড়ে যাবার সময় এই বেনারসি প্রিয়জনের কথাটাই মনে করিয়ে দেয়। কতশত মানুষের কাছে কথা আছে এই লাল বেনারসিকে নিয়ে।
বাংলার ঘরে মেয়ের বিয়ে মানেই পরনে থাকবে একটা লাল বেনারসি। মায়েদের আলমারি বা বাক্স খুঁজলেই হাল্কা বা ভারী কাজের একটা বেনারসির দেখা মিলবেই। দেখলে হয়তো মনে পড়ে সেই ছোট মেয়েটির বিয়ের সময় পরা বেনারসি। বাবা-মা-ভাইবোন, আত্মীয়স্বজন ছেড়ে আসা আর ভালোবাসা মাখানো এই শাড়ি যতেœ তোলা আছে।
শুধুমাত্র বিয়ের কনেই নয়, যে কোনো উৎসবে নারীর পরনে এই বেনারসির প্রচলন সেই সূদুর অতীত থেকে। তাঁতির হাতের সুচারু বুননে একেকটি শাড়ি যেন হাজারো দিনের কষ্ট আর পরিশ্রমের ফসল। এই বেনারসি শাড়ি একদিকে একটু চড়া দাম আর শাড়ির ভারী ওজন বিয়ের কনের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে।
বেনারসি শাড়ি হলো প্রাচীন ভারতীয় একটি শহর বেনারস বা বারানসিতে তৈরি একপ্রকার শাড়ি; যা ভারতের সেরা শাড়িগুলোর মধ্যে অন্যতম। এই শাড়ি সোনা, রুপার কিংখাব বা জরি, সূক্ষ্ম রেশম এবং আকর্ষণীয় সূচিকর্মের জন্য খ্যাতি লাভ করেছে। শাড়িগুলো সূক্ষ্ম রেশম তন্তুর তৈরি এবং জটিল নকশায় সজ্জিত ও নকশাকাটার কারণে তুলনামূলকভাবে ভারী ওজনের হয়ে থাকে।
জড়ানো ফুল ও পাতাযুক্ত নকশা, কলকা ও বেল, পাড়ের বাইরের অংশে ঝাল্লর নামে ওপর দিকে ওঠা পাতার একটি ঝাড় এই শাড়ির অন্যতম উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। অন্যান্য বৈশিষ্ট্যের মধ্যে রয়েছে সোনার কাজ, ঘন বুনন, পুঙ্খানুপুঙ্খ নকশা, ধাতব পাথরের প্রভাব, আঁচল এবং জালি কাজ।
দেশভাগের পর অনেক ভারতীয় তাঁতি ঢাকায় বসতি স্থাপন করে এই বেনারসি শাড়ির প্রচলন করেন। বর্তমানে ঢাকার মিরপুরের ১০, ১১, ১২ নম্বরে এর কারখানা রয়েছে বেশি। সেখান থেকে একসময় বাংলাদেশের সিরাজগঞ্জ, রংপুর, নরসিংদীর পাশাপাশি আমের জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জেও এসে পড়ে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের যেসব এলাকায় তাঁতের কাজ চলমান রয়েছে তার মধ্যে অন্যমত শিবগঞ্জ উপজেলার হরিনগর গ্রামটি। এই গ্রামেই ২৫ বছর আগেও বেনারসি বোনা হতো তাঁতে। মাঝে বিদেশী ও নি¤œমানের সুতা ও কাঁচামালের কারণে বেনারসি কাজ বন্ধ হয়ে যায়। এছাড়াও দক্ষ ও তরুণ কারিগরের অপ্রতুলতাও অন্যতম কারণ ছিল বন্ধের নেপথ্যে। তবে এখানকার রেশম, মটকা, অ্যান্ডিসহ বিভিন্ন সুতার পাশাপাশি একটি মাত্র তাঁতে এই বেনারসি বোনা হচ্ছে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার হরিনগর গ্রামের আজিজুল হক কাজল নতুন করে এই বেনারসি তাঁত বসিয়েছেন। ছোটবেলায় শেখা তাঁতের কাজ থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে একে ব্যবসা হিসেবে নিয়েছেন। তার ৮টি বেনারসি তাঁত রয়েছে। একটি শাড়ি তৈরি করতে নকশার ওপর ভিত্তি করে কখনো ১০ দিন আবার কখনো ৬ মাস সময় লাগে। রেশমের থানে জরি আর বিভিন্ন রঙের সুতোয় বেনারসি শাড়ির জমিন, পাড় তৈরি হয়। এই শাড়ি তৈরি করতে সুতার রং করা, বোর্ডে ডিজাইন বসানো, তাঁতের জন্য বিশেষ নলিতে সুতো জড়ানোসহ প্রায় ১০ ধরনের কাজ সম্পন্ন হলে একটি তাঁতে শাড়ি তৈরির উপযোগী হয়।
তাঁতশ্রমিক মো. সাব্বিরের সাথে কথা হলে তিনি জানান, প্রায় ৩০ বছর ধরে তিনি এই বেনারসি তাঁতের সাথে যুক্ত আছেন। তিনি বলেন, ঢাকায় প্রায় ২২ বছর বেনারসি তাঁতে কাজ করেছি। আমাদের মালিক কাজল ভাই যখন ঢাকায় বেনারসির কাজ শিখছিলেন, তখন থেকেই তার সঙ্গে পরিচয়। সেখানে তিনি যখন কাজের প্রস্তাব দেন চলে আসি।
সাব্বির বলেন, আমার দুই ছেলে গার্মেন্টসে কাজ করে। ঢাকার জীবন এখানকার থেকে একটু কঠিন। করোনার কারণে কাজ একটু কম চলছে। সকাল থেকে শুরু করে রাত ৮টা, কখনো ১০টা পর্যন্ত কাজ করি। এখন কারখানার পাশেই বাসা নিয়ে থাকি।
আরেক তাঁতি দিদার হোসেন বলেন, আমার বড়ভাইয়ের সাথে এই কাজ শিখেছি। কিন্তু কাজটি অন্যান্য কাপড় তৈরির তুলনায় বেশি সময় ও পরিশ্রম প্রয়োজন। ১৪ হাত মাপের একটি শাড়ি তৈরির পর মজুরি আসে প্রায় ৩ হাজার টাকা থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত। শাড়ির ডিজাইন ও ভারী কাজের ওপর এই মজুরি নির্ধারণ করা হয়। যে কেউ চাইলে তার পছন্দের বেনারসিটি তারা বানিয়ে দিয়ে থাকেন।
আজিজুল হক বলেন, একসময় আমার এলাকায়ই বেনারসি তাঁত বুনতাম। কিন্তু মাঝে সুতোর দাম, বাইরের দেশের চকচকে কিন্তু সস্তা শাড়ির বাজার বেনারসির পথকে একটু হলেও বাধাগ্রস্ত করে। এখন নতুন করে এই বেনারসি তার আগের অবস্থান তৈরি করছে। শুধু বিয়েই নয়, বৌভাত, গায়ে হলুদ, শহরের পার্টি, কিংবা উপহারসহ যে কোনো অনুষ্ঠানেই এই বেনারসির চাহিদা বাড়ছে। বেনারসি শাড়ি বেশিরভাগ গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে পরিধান করা হয়।
‘অন্যান্য ব্যবসা থাকতে প্রায় হারিয়ে যাওয়া বেনারসি তাঁত নিয়ে কেন কাজ করছেন?’ এ বিষয়ে জানতে চাইলে আজিজুল হক বলেন, একসময়ের জনপ্রিয় শাড়ি ও আমাদের এলাকার ঐতিহ্য আর তরুণদের নতুন কিছু করার আগ্রহ সৃষ্টি করতে এই কাজটি করার উদ্যোগ নিয়েছি। প্রথম দিকে একটু সমস্যায় পড়েছিলাম, কিন্তু আত্মীয়রা আমাকে উৎসাহ দেয়। আমি প্রথমে ঢাকা থেকে এই কাজটি শিখি। ওখানে পরিচয় হয় কয়েকজনের সাথে। পরে এই কারখানাটি চালু করি। তিনি বলেন, আমাদের পাড়ায় সাধারণত রেশম, সিল্ক, বলাকা, কোড়া, অ্যান্ডি ইত্যাদি সুতার কাপড় তৈরি হয়Ñ যা খুব সূক্ষ্ম এবং মসৃণ। সেগুলো তৈরি প্রক্রিয়া সহজ। তবে এই বেনারসির জন্য আলাদা আলাদা কাজ করতে হয়। বিয়ের মৌসুমে বেশি চাপ থাকে বলে প্রায় সারাবছরই কাজ চলে। একেকটি শাড়ি পাইকারি ৩-৪ হাজার টাকা থেকে শুরু করে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি করি।
আজিজুল হক বলেন, জেলায় বেনারসি নিয়ে তেমন বাজার না থাকা, বাজারে সঠিক চাহিদা বা ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় ব্যবসাটা মূলত ঢাকায় করে থাকি। তিনি বলেন, এই শাড়ি প্রস্তুত করতে অনেক লোকের প্রয়োজন। এতে বেকার তরুণরাও কাজের সুযোগ পাচ্ছে। হতাশার সুরে তিনি জানান, এই ব্যবসায় মূলধন বেশি লাগে, আবার সব তাঁতশ্রমিক এটা তৈরি করতে পারে না। ফলে এই ব্যবসায় অনেকেই আগ্রহী হয় না। সরকারিভাবেও কোনো সেবা বা সহায়তা না থাকায় অনেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। তবে তিনি বলেন, এখানকার (হরিনগর) শ্রমিকদের প্রশিক্ষণের পাশাপাশি বেনারসির জন্য আগ্রহ সৃষ্টি করতে হবে। তাহলে গ্রামটিতে হয়তো আবারো তাঁতিরা তাদের পেশাটিকে ধরে রাখবে, ভভিষ্যত প্রজন্মও এগিয়ে আসবে।
ইতিহাসে দেখা যায়, রাল্ফ ফিচ (১৫৮৩-৯১) বেনারসকে সুতি বস্ত্রশিল্পের একটি সমৃদ্ধ ক্ষেত্র হিসেবে বর্ণনা করেছেন। বেনারসের কিংখাব (ব্রোকেড) এবং জরি টেক্সটাইলের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ১৯ শতকে। ১৬০৩ সালের দুর্ভিক্ষের সময় গুজরাট থেকে রেশম তাঁতিদের স্থানান্তরিত হওয়ার পরে, সম্ভবত সতের শতকে বেনারসে রেশম কিংখাব বুনন শুরু হয়েছিল এবং আঠারো ও উনিশ শতকের সময় উৎকৃষ্টতার সাথে বিকশিত হয়েছিল। মোঘল আমলে চৌদ্দ শতকের দিকে স্বর্ণ ও রৌপ্য সুতোর ব্যবহার করে জটিল নকশার সাথে কিংখাব বুনন বেনারসের বিশেষত্ব হয়ে ওঠে।
গোরক্ষপুর, চান্দৌলি, ভাদোহি, জৌনপুর এবং আজমগড় জেলাকে ঘিরে এই অঞ্চলের হস্ত ও তাঁত রেশম শিল্পের সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত প্রায় ১.২ মিলিয়ন লোকের কুটির শিল্পের হাত ধরে ঐতিহ্যবাহী বেনারসি শাড়ির কাজ করা হয়। ২০০৯ সালে উত্তর প্রদেশের তাঁত সমিতিগুলো বেনারস কিংখাব ও শাড়ির জন্য ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) অধিকার অর্জন করেছে।
প্রায় প্রতিটি ছেলেমেয়ের স্বপ্নে থাকে বেনারসিতে জড়ানো লাল টুকটুকে বউ। লাল টুকটুকে বউ কথাটি কিন্তু নতুন বউয়ের মুখ দেখে নয় তার গায়ে জড়ানো লাল রঙের সুতোয় সোনালি চকমকি আর জরির তারে মোড়ানো বেনারসির রংটির কথাই বলে। আর বাবা-মাও তাই হয়তো মেয়ের সংসার জীবনের শুরুটা ঝলমলে বেনারসির মতো করে শুরু করে দিতে চান বলেই হয়তো বেনারসির কদর আজো আছে, হয়তো ভবিষ্যতেও থাকবে।