শনিবার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ২৯ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১১ জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি

Last Updated on জুন ৯, ২০২৪ by

স্বস্তির জয় টাইগারদের
‘শ্রীলঙ্কা শ্রীলঙ্কা শ্রীলঙ্কা” এই স্লোগানে তখন মুখরিত চারপাশ। মাত্রই বাংলাদেশের দুটি উইকেট পড়েছে তখন, ওভার শেষ দুটি বল থেকে রান আসেনি। অভাবনীয় এক জয়ের সুবাস পেয়ে লঙ্কান দর্শকরা তখন জেগে উঠেছে। ‘নাগিন ডান্স’ দিচ্ছেন তাদের কেউ কেউ। ঠিক উল্টো অবস্থা তখন বাংলাদেশের সমর্থকদের। সবাই ¤্রয়িমান। আরও একবার আশা ভঙ্গের শঙ্কায় সবার চোখেমুখে উৎকণ্ঠার ছাপ। একটু পরই আবার উল্টো চিত্র। দাসুন শানাকার ফুল টসে মিড উইকেট দিয়ে বল গ্যালারিতে পাঠালেন মাহমুদউল্লাহ। গ্যালারির ছবিটাও পাল্টে গেল একটি পলকেই। এবার লাল-সবুজের গর্জনে কেঁপে উঠল যেন গোটা গ্র্যান্ড প্রেইরি এলাকা। শ্রীলঙ্কার নীল জার্সি গায়ে চাপানো হাজারও দর্শক তখন ডুবে গেলেন নীল বেদনায়। পেন্ডুলামের মতো দুলতে থাকা ম্যাচের ভাগ্য বাংলাদেশের দিকে হেলে পড়ল ওই ছক্কাতেই। মাঠে যেমন লড়েছে দুই দলের ২২ ক্রিকেটার, ডালাসের গ্র্যান্ড প্রেইরি স্টেডিয়ামের গ্যালারিতেও তেমনি ছিল তুমুল লড়াই। সেই লড়াইটা সমর্থকদের। বাংলাদেশের লাল-সবুজই বেশি ছিল মাঠে। তবে শ্রীলঙ্কান সমর্থকেরাও সংখ্যায় ও সাজের বৈচিত্রে পিছিয়ে ছিলেন না খুব একটা। একসময় ভারত-পাকিস্তান ম্যাচের যে উত্তেজনা ছিল এই অঞ্চলে, সেরকমই কিংবা আরও বেশি রোমাঞ্চ, চাপ ও যুদ্ধংদেহী অবস্থা থাকে এখন বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কার লড়াইয়ে। গ্যালারির লড়াইয়ে জয়টাও এখানে গুরুত্বর্পূ। সেই লড়াইয়ের রঙও ক্ষণে ক্ষণে বদলাল এই ম্যাচে। ম্যাচের প্রথম ভাগে ১৪ ওভারে ১০০ রান তুলে ফেলা শ্রীলঙ্কা ভয়াবহ ধসে ২০ ওভারে থমকে গেল ১২৪ রানে। রান তাড়ায় পাওয়ার প্লেতে বাংলাদেশের তিন উইকেট হারানো, লিটন দাস ও তাওহিদ হৃদয়ের জুটি, এরপর একের পর এক উইকেট হারানো ও শেষের উত্তেজনা, সবকিছু মিলিয়ে ম্যাচজুড়ে নাটকীয়তার নানা শাখা-প্রশাখায় প্রিয় দলের সঙ্গে বিচরণ করল সমর্থকদের আবেগও। জগন্নাথ বিশ্বাবিদ্যালয়ের শিক্ষক ইমরান তাদেরই একজন। শিক্ষা ছুটিতে এসে এখানে পড়াশোনা করছেন বছর তিনেক ধরে। বাংলাদেশের রান তাড়ায় অষ্টাদশ ওভারে রিশাদ হোসেন ও তাসকিন আহমেদ পরপর দুই বলে আউট হওয়ার পর আসন ছেড়ে উঠে এসে গ্যালারির ওপরের দিকে অস্থির হয়ে হাঁটতে দেখা গেল তাকে। চেনাপরিচয়ের পর তিনি বললেন, উত্তেজনা নিতে পারছেন না বলে এভাবে হাঁটাহাঁটি করছেন তিনি। রিশাদ, তানজিমরা কেন মাহমুদউল্লাহকে স্ট্রাইক দেওয়ার চেষ্টা না করে বড় শট খেলার চেষ্টা করছেন, কেন সহজ ম্যাচ এত কঠিন হয়ে উঠল, এরকম নানা আক্ষেপ তার। মাঠে আর টিভি পর্দার সামনে থাকা কোটি কোটি ক্রিকেট অনুসারীর প্রশ্নগুলিও একই থাকার কথা। দ্বাদশ ওভারে ওয়ানিন্দু হাসারাঙ্গাকে যখন টানা তিনটি ছক্কায় ওড়ালেন হৃদয়, এরপর তো জয়টা ¯্রফে আনুষ্ঠানিকতা হয়ে ওঠার কথা। ৫১ বলে তখন প্রয়োজন কেবল ৩৪ রানের, উইকেট বাকি ৭টি। বলপ্রতি রান করলেও তিন ওভার আগে খেলা শেষ হয়ে যায়। কিন্তু সেই ম্যাচটিও হারার আয়োজন প্রায় করে ফেলেছিল বাংলাদেশ। হৃদয় আর একটু সময় টিকে থাকলে ম্যাচ হয়তো তখনই শেষ হয়ে যেত। তবে টানা তিন ছক্কার পরের বলে এলবিডব্লিউ হয়ে যান তিনি। ম্যাচ শেষে সংবাদ সম্মেলন কক্ষে ঢোকার আগে অপেক্ষায় থাকার সময় অধিনয়িক নাজমুল হোসেন শান্ত এটা নিয়ে বলছিলেন, “তিনটি ছক্কা মারার পর হৃদয় আসলে একটু দ্বিধায় পড়ে গিয়েছিল যে আরেকটি বড় শট খেলবে নাকি খেলবে না। এই কারণেই আউট হয়ে গেছে।

দ্বিধা না করে শট খেলে দিলেই হতো, ওই বলটিও মারার মতোই ছিল।” হৃদয়ের ওই তিন ছক্কাই অবশ্য শেষ পর্যন্ত মহামূল্য হয়ে উঠেছে। শেষটা যেভাবে করেছে বাংলাদেশ, তাতে ওই হ্যাটট্রিক ছক্কা না হলে হয়তো হেরেই যেত বাংলাদেশ। বাংলাদেশের খেলা দেখতে ঢাকা থেকে প্রায় ৫৫ ঘণ্টা ভ্রমণের পর ডালাসে এসে গ্যালারিতে বসে গলা ফাটিয়েছেন অনুপন হোসেন পূর্নম। সহজ ম্যাচ কঠিন করে জেতায় বিরক্তি আছে তারও। তবে তার নিজের কাছে তৃপ্তির জায়গা এই মার্কিন মুল্লুকে এসে দলকে সমর্থন জোগাতে পারাই। ম্যাচ হেরে গেলেও তার আত্মতৃপ্তিতে কমতি থাকতে না বলেই দাবি তার। জয়টা অবশ্যই তার প্রাপ্তির পাল্লাকে ভারি করেছে আরও। চাপের মধ্য শেষ পর্যন্ত জয়টা নাগালে এলো মাহমুদউল্লাহর ওই ছক্কায়। ১২ বলে যখন প্রয়োজন ১১ রান, উইকেট বাকি দুটি, মূল বোলারদের সবার চার ওভার করে শেষ হওয়ায় আক্রমণে এলেন দাসুন শানাকা। প্রথম বলটিই তিনি করলেন ফুল টস। মাহমুদউল্লাহর কবজির দাপটে তা আশ্রয় নিল গ্যালারিতে। বাংলাদেশের ড্রেসিং রুম থেকেও জগদ্দল পাথর নেমে গেল। বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সম্ভবত সবচেয়ে বিভীষিকার ম্যাচ ২০১৬ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ভারতের বিপক্ষে সেই লড়াইয়ে ফুল টসে ছক্কা মারতে গিয়েই আউট হয়েছিলেন মাহমুদউল্লাহ। এবারের ছক্কায় আগের সেই হতাশা চাপা পড়বে না মোটেও, তবে নতুন দিনের স্বস্তি অন্তত উপহার দিয়েছে এই শট। পরের বলেই সিঙ্গেল নিয়ে দশ নম্বর ব্যাটসম্যান তানজিমকে কেন তিনি স্ট্রাইকে পাঠালেন, এই প্রশ্ন তোলা যায় বটে। তবে এক ওভার আগে খেলা শেষ করার পর কৃতিত্বটুকুই তাকে বেশি দিতে হয়। এমন জয়ে দলের আত্মবিশ্বাস কতটা বাড়বে, সেই সংশয় আছে বটে। তবে জয়টা খুবই জরুরি ছিল। যে কোনো টুর্নামেন্টেই প্রথম ম্যাচে জয়টা বাংলাদেশের সবসময়ই দরকার মোমেন্টামকে সঙ্গী করার জন্য। এবার তো যুক্তরাষ্ট্রে কাছে সিরিজ হারসহ এমন সব প্রেক্ষাপট ছিল, প্রথম ম্যাচে জয়ের বিকল্প ছিল না। এই জয়টি তাই শুধু গুরুত্বপূর্ণই নয়, পরম কাক্সিক্ষতও। সংবাদ সম্মেলনে ঢোকার মুখে শান্ত সংবাদকর্মীদের কাছে জিজ্ঞেস করছিলেন, ‘শ্রীলঙ্কা তো দুইটা হেরে গেল, ওরা কি এখন বাদ?’ আনুষ্ঠানিকভাবে এখনও বাদ নয়। তবে বাংলাদেশ অধিনায়ক তো জানেন, লঙ্কানরা বাদ পড়া মানেই তাদের সম্ভাবনা উজ্জ্বল হওয়া। তার কৌতূহল সেখানেই। মাঠের লাউড স্পিকারে তখন বেজে চলেছে, ‘বিজয়েরই পথে প্রিয় বাংলাদেশৃ কোটি প্রাণের একই ধ্বনি বাংলাদেশ।’ ওই গানের সঙ্গে বাংলাদেশ ক্রিকেটের সাম্প্রতিক অবস্থার মিল নেই যদিও। বিজয়ের রথ এখনও ছোটাতে পারেনি দল। মন ভরানো জয়ও আসেনি। তবে এই জয়ের পর আরও সামনে ছুটে চলার আশার সূর্য তো অন্তত উঁকি দিয়েছে!

About The Author

শেয়ার করুন