সেদিন বৃষ্টি ঝরেছিল

67

রেহানা বীথি

– বড়ভাই, হালকা হবে, হালকা?
– দেন একটু কিছু। এই, অল্প… একেবারেই হালকা!
হাতের তালুতে কয়েকটা খুচরো টাকা নাচিয়ে বাড়িয়ে দিল সেই হাত।
– দেন বড়ভাই, হালকা দেন। প্লিজ গিভ মি। আই অ্যাম খুব হাংরি। এই দুই টাকা, পাঁচ টাকা!
– শালা, আবার ইংরেজি কপচানো হচ্ছে! যা এখান থেকে।
– দেন না বড়ভাই। আল্লাহ আপনার খুব ভালো করবে। ঘরভর্তি ছেলেপুলে হবে।
– ঘরভর্তি ছেলেপুলের দরকার নেই। যা আছে ওতেই চলবে। আচ্ছা যা, দেব। তো এই হালকা দিয়ে কি করবি?
– চা খাবো। সাথে দু’খানা বিস্কুট। একেবারেই হালকা, ঠিক না বড়ভাই? মোটা ঠোঁট দু’খানা প্রশস্ত করে হাসি দিল একটা।
– আর, সিগারেট খাবি না? তুই তো শালা ধোঁয়া ছাড়িস দারুণ! গোল গোল রিং ছড়িয়ে দিস বাতাসে। দেখি তো প্রায়ই ওই আমতলায়। গাছে হেলান দেয়ার ভঙ্গিমাটাও যা দারুণ না!
– কী যে বলেন বড়ভাই! আমার আবার দারুণ। ওই বসি আর কী!
– আচ্ছা, ঠিক করে বল তো, তোর বয়স কত? রয়েছিস তো সেই ছোট্টটি হয়ে। এদিকে গাল দুটোতে তো কচি ঘাসের অভাব নেই। পাক ধরল বলে। বিয়েটিয়ে করেছিস?
কীরে, লজ্জা পাচ্ছিস? দেব শালা কাতুকুতু! এই দিলাম!
বেঁটে দেহখানা এঁকেবেঁকে সরে আসে ভুট্টু। এমনই করে সবাই। ঠাট্টা, ইয়ার্কি। যেন সে একটা চিড়িয়াখানার জন্তু। বাপে নাম রেখেছিল জহরুল হক। কিন্তু এখন আর কেউ জানে না সে নাম। ভুট্টু নামেই পরিচিতি তার কয়েক বছর ধরে। হয়তো সে নিজেও ভুলে গেছে বাপের দেয়া জহরুল নামটি। ভুলবে না? স্বয়ং বাপকেই ভুলে গেছে সে। অমন বাপের কথা মনে রেখেই বা কি হবে? যেমনি তার মা মরল, অমনি কিনা বাপ হয়ে গেল তালোই! এ জীবনে তো আর কম কষ্ট পায়নি সে! মানুষের ঠাট্টা ইয়ার্কি, পথেঘাটে ঘুরে ঘুরে দেখা, তাচ্ছিল্য এসব তো সয়ে আসছে সে ছোটবেলা থেকেই। সেই যখন থেকে বোঝা গেল, সে বড় হবে কিন্তু আর বাড়বে না তখন থেকেই।
জন্মের পর যত বড় হতে থাকে, ধরা পড়ে তার অস্বাভাবিকতা। বয়স তার বেড়েই চলেছে শুধু দৈর্ঘ্য বাড়ছে না। চোখমুখেও কেমন বয়সের ছাপ! বড় দুই ভাই আর এক বোন। সবাই ঠিকঠাক। শুধু ওই জহরুলই রয়ে যাচ্ছে ছোট্টটি। ওর বয়সীরা বেড়ে চলেছে তরতর করে, হাসিঠাট্টা করছে ওকে নিয়ে। কয়েক বছর যে স্কুলে যায়নি, তা নয়। গিয়েছিল। দু’কলম লেখাপড়াও শিখেছিল। কিন্তু ওই যে হাসিঠাট্টা, ক্লাসের ছেলেমেয়েরা স্থির থাকতে দিত কি ওকে? নামও দিয়ে দিল ভুট্টু। ছোটখাটো কিনা! রাগ করে আর স্কুলেই গেল না ভুট্টু। যদিও ওর ভাইবোনগুলো যে খুব বেশি বিদ্বান হয়েছিল তা নয়। তবে টেনেটুনে স্কুল পেরিয়েছিল। গরিবের ঘরে এই ঢের। তাই দিয়েই পিয়নের চাকরি করে খায়। বোনটা পরের ঘরে মোটামুটি সুখেই আছে। দুই ভাই বিয়ে করে ব্যস্ত নিজের সংসার নিয়ে। জহরুলকে কেউ দু’চোখে দেখতেই পারে না। মা যতদিন ছিল, এই বেঁটে ছেলেটাকে তবু আগলে রেখেছিল। মা মরে যাওয়ার পর বাপটা আবার নতুন বউ আনল ঘরে। বুড়ো বয়সে তাকে দেখার তো লোক প্রয়োজন! বিয়ে না করলে চলে?
শুরু হলো জহরুলের দুঃখের জীবন। সইতে না পেরে নদী পেরিয়ে চলে এলো এই মফস্বল শহরে। এ-বাড়ি ও-বাড়ি ঘোরে, কোর্ট-কাছারি, অফিস, দোকানপাটে গিয়ে হাত পেতে ‘হালকা’ চায়। রাত হলে শুয়ে থাকে স্টেশনে নয়তো কোনো দোকানের সামনের বেঞ্চিতে। কেউ নাম জানতে চাইলে বলে, ভুট্টু। লোকজন ওকে নিয়ে তামাশা করে মজা পায়। তা পাক। দুটো পয়সা তো হাতে দেয়! ভুট্টু কখনও রাগ করে না কারো ওপর। যাদের ওপর রাগ করার অধিকার ছিল, তাদের ওপরই যখন নেই তখন আর কাকে রাগ দেখাবে সে? বুড়োটে চেহারার ওই মুখটাতে হাসি লেগে থাকে সর্বক্ষণ। আগে লুঙ্গি পরত। টাকা জমিয়ে দুটো হাফপ্যান্ট কেনে সস্তার দোকান থেকে। সেগুলো ছিঁড়ে গেলে, আবারও। কিনেছে শীতের পোশাকও। এক অফিসের নাইটগার্ডের সাথে খাতির আছে বেশ। একটা চটের ব্যাগে শীতের কাপড়গুলো তার কাছেই রাখে। শীত এলে নিয়ে এসে পরে।
‘হালকা’ চেয়ে চেয়ে জীবন তার কেটে যাচ্ছে বেশ। নদীর ওপারে যাওয়ার জন্য প্রাণটা হু হু যে করে না কখনও, তা নয়। গিয়েছিল একবার। কঠিন মুখ করে বাপটা বেরিয়ে গিয়েছিল বাড়ি থেকে। আর বাপের সেই বউ? তেড়ে এসে এই মারে কী সেই মারে! চলে এসেছিল ভুট্টু। তারপর আর নদী পার হয়নি সে। হয়তো হবেও না কোনোদিন। কেন হবে? কেউ তো চায় না ওকে। হাসিমুখে হাত পাতে সে সবার কাছে। হাসিমুখে কেটে যায় ওর দিনগুলো। রাতগুলো কেটে যায় স্বপ্ন দেখে। বসে আছে পাশে এক মেয়ে, ওর মতো বেঁটেখাটো নয়, বেশ লম্বা। ছিমছাম সুন্দর মুখখানা তার! হেসে হেসে গল্প করছে ওর সাথে, যেন কত আপনজন। যেন… যেন ওর বউ! পাখির ডাকে জেগে ওঠে ভুট্টু ভোরবেলায়, স্বপ্নসুখে, হেসে হেসে।
মোটেও সেদিনের মতো নয় ওর দিনগুলো এখন। ওই যে যেদিন নদী পেরিয়ে গিয়েছিল ওর ফেলে আসা গাঁয়ে! সন্ধ্যার মুখোমুখি সেই দিন, মেঘে আঁধার চারিদিক! মায়ের হাতে লাগানো কদম গাছটা ফুলে ফুলে ভরা ছিল সেদিন। বৃষ্টিতে ভেজা কদমফুল চুঁয়ে চুঁয়ে পানির ফোঁটা পড়েছিল ওর মাথায়। সেখান থেকে চোখের পাতায়। ও নিজেই বুঝতে পারেনি, ওর চোখ বেয়ে যা পড়ছিল, তা কি কদম থেকে ঝরা বৃষ্টি নাকি ওর চোখের!