ভারী লেন্সের চশমার ফাঁক দিয়ে ঘরের জানালা দিয়ে বাইরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন আমজাদ হোসেন। কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ স্পষ্ট। চোখ কুঁচকে আসছে। সাধারণত শারীরিক যন্ত্রণায় যেমনটি হয়। কিন্তু আমজাদ হোসেনের ক্ষেত্রে বিষয়টি উল্টো। শরীরে কোনো যন্ত্রণায় নেই। তবে মনের ভেতর একরাশ যন্ত্রণা তাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। এ যন্ত্রণার শেষ নেই! সহসা পরিত্রাণের কোনো আশাও দেখতে পান না তিনি।
বর্ষাকাল আসতে ঢের দেরি। তবুও এই বৈশাখে কালো মেঘে ছেয়ে আছে আকাশ। তবে এই মেঘ কালবৈশাখীর পূর্বাভাস বলে মনে হয় না তার কাছে। কেবলই মনে হচ্ছে, কিছুক্ষণের মধ্যেই অঝোরে ঝুম বৃষ্টি নামবে। আর এবার বোধহয় বর্ষাকালের আগে থেকেই বর্ষা শুরু হয়ে যাবে!
সত্যি সত্যিই কিছুক্ষণের মধ্যে অঝোর ধারায় বৃষ্টি নামে। বৃষ্টির মধ্যে এক ধরনের প্রশান্তির বাতাস জানালার গ্রিল গলিয়ে আমজাদ হোসেনের শরীর ছুঁয়ে যায়। ঠা-া এই বাতাসে মন কিছুটা প্রফুল্ল হয়। বিশেষ করে বৃষ্টির মনোরম দৃশ্যও এই বয়সে তাকে যথেষ্টই অভিভূত করে। এছাড়া নদীর পানিতে রিমঝিম বৃষ্টির যে অণুরনন, তা তাকে সেই ছোট্টবেলা থেকেই দোলা দেয়। এই একটা বিষয়ে সাতষট্টি-ঊর্ধ্ব জীবনে কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি।
আমজাদ হোসেনের বাড়িটা মহানন্দা নদীর পাড় ঘেঁষে, পুরাতন সিঅ্যান্ডবি ঘাটে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ ফুলকুঁড়ি ইসলামী একাডেমি ছেড়ে সোজা নদীর দিকে এগোলেই হাতের বামে বাঁক ঘুরলেই বাড়িটা যে কারোরই নজরে পড়ার কথা। এই কারণে যে, আশপাশের সব বাড়ি চকচক করলেও এ বাড়ির কোনো চাকচিক্য নেই। শেষ কবে বাড়িটিতে রঙ করা হয়েছে, তাও স্মৃতি হাতড়ে বলতে হবে।
আট ইউনিটবিশিষ্ট চারতলা বাড়ির দোতলার একটি ইউনিটেই থাকেন আমজাদ হোসেন। নিজের বাড়ি। একা মানুষ। তাই সাতটি ইউনিটই ভাড়া দিয়েছেন। ভাড়া হিসেবে মাসে পঁয়ত্রিশ হাজার টাকা মতোন পেয়ে থাকেন। পেনশন আর মুক্তিযোদ্ধার ভাতাসহ সবমিলিয়ে প্রতি মাসে ভালোই টাকা পান। পেনশনের এককালীন টাকা দিয়ে ব্যাংকে দশ বছর মেয়াদি ফিক্সড ডিপোজিটও আছে। মেয়াদ পূরণ হতে আরো বছর তিনেক বাকি। এছাড়া তিন বিঘার আমবাগানটি প্রতি তিন বছরের জন্য বিক্রি করে মোটা অঙ্কের টাকাও পান।
টাকার অভাব বোধ না করলেও শান্তির অভাবটা কয়েক বছর ধরেই টের পাচ্ছিলেন। আছে একাকীত্বের যন্ত্রণাও। স্ত্রী রাবেয়া গত হয়েছেন কয়েক বছর। ছেলেপুলে বলতে দুই ছেলে। একজন রাজশাহীতে, সরকারি চাকুরে। বড়টা ঢাকায়, ব্যবসা করে। দুই ছেলেরও ভালো রোজগার। বড় ছেলের দুই মেয়ে। ছোটটির এক ছেলে। নাতি-নাতনি সবাই স্কুলপর্যায়ে।
মোবাইল ফোনে অ্যালার্ম বেজে উঠলে ভাবনায় ছেদ পড়ে আমজাদ হোসেনের। বুঝতে পারেন, সকাল ১০টা বেজে গেছে। এইবার রান্নার প্রস্তুতি নিতে হবে। গত ২০ দিন ধরে এই-ই চলছে। সহজভাবে বলতে গেলে, দেশে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের শুরুর পর থেকেই। স্থায়ী একজন বুয়া ছিল, বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। সেই তিনবেলা রান্না করে খাওয়াত। কিন্তু সেই যে মার্চে করোনা সংক্রমণ শুরু হলো, তখন থেকে বুয়াও কাজ করবে না বলে জানান দিচ্ছিল। ঠেলেঠুলে কোনোরকমে তাকে দিয়ে মার্চ মাস পুরোটা কাজ করিয়ে নেয়া গেছে। তারপর আর রাখা যায়নি।
এরপর থেকে নিজেই রান্না করে খেতেন আমজাদ হোসেন। সকালবেলা হালকা নাস্তা সেরে নিতেন। সকাল ১০টা থেকে দুপুরের খাবারের আয়োজন করতে বাসতেন। এজন্যই মোবাইলে অ্যালার্ম দিয়ে রাখা। একে তো পুরুষ মানুষ, তার ওপর বয়স্ক। সামান্য আলু ভর্তা, ভাত করতেই সময় লেগে যায়।
রান্নার মেনু বলতে কখনো খিচুড়ি, কখনোবা ডিম ভাজা, কখনোবা আলু ভাজি। এসবই রাবেয়াকে কাজে সঙ্গ দিতে গিয়ে তার আয়ত্তে এসেছে। মাছ-মাংস খাওয়ার ইচ্ছে জাগলেও তা পূরণ হওয়ার নয়। কেননা সেগুলো কেটে রান্না করা তার পক্ষে সম্ভব হয় না। গরুর মাংসটা আবার পছন্দ নয়। অবশ্য ভাড়াটিয়ারা থাকলে হয়তো এ উপকারটুকু পেতে পারতেন। কিন্তু করোনার ছোবলে ভাড়াটিয়ারাও চলে গেছে, নিজ নিজ বাড়িতে। কেউ কেউ এপ্রিল মাসের ভাড়া দিয়ে গেছে। অন্যরা এসে দেবে, জানিয়েছে। এত্ত বড় বাড়িটাতে তাই শুধু আমজাদ হোসেনের দীর্ঘশ্বাসই শুনতে পাওয়া যায়।
বুয়াকে ভালোই মাইনে দিতেন। মাসে ৬ হাজার টাকা। সেই সঙ্গে সকাল-দুপুর খাওয়া। এছাড়া দুটি ঈদে ৩ হাজার করে ৬ হাজার টাকা দিতেন বোনাস হিসেবে, খুশি হয়েই। এসব বাদে মন চাইলে শাড়িও কিনে দিতেন। সেটাও বছরে তিনটের কম নয়। এতসব করতেন এজন্য যে, বিশ বছর ধরে বুয়া তার বাড়িতেই কাজ করত। চাকরি থেকে অবসরে যাওয়ার দুই বছরের মাথায় রাবেয়াও তার জীবন থেকে হঠাৎই চিরবিদায় নেন। স্ত্রীর মৃত্যুতে মুষড়ে পড়েছিলেন আমজাদ হোসেন। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলেছেন।
রাবেয়া চলে যাওয়ার পর বুয়াই তার সংসারটাকে আগলে রেখেছিল। তাই তাকে বেশি বেতন দিতে কার্পণ্য বোধ করেননি। তাছাড়া রাবেয়া মারা যাওয়ার পর খরচও সেরকম নেই। দুজনেরই ঘোরার শখ ছিল। ছেলেদের বিয়ে দেয়ার পর প্রচুর ঘুরেছেন তারা। প্রতিবছরই ঘুরতে বের হতেন। দেশে এবং দেশের বাইরে, ভারতেও। দেশের ভেতরে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত, কুয়াকাটা, সুন্দরবন, সিলেট, দিনাজপুর, পঞ্চগড়- সব জায়গায় ঘুরতে গিয়েছেন। আর ভারতের শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং, কলকাতা, বহরমপুর। নেপালও গিয়েছেন। তবে অবসর নেয়ার পর সেভাবে ঘুরতে যাওয়া হয়নি। পেনশনের জন্য কাগজপত্র ঠিক করতেই অনেকটা সময় পার হয়ে যায়। তারপর তো রাবেয়াও চলে গেল। তাই এখন বেশির ভাগ টাকা ব্যাংকেই জমা পড়ে আছে। রাবেয়া মারা যাওয়ার পর এই পাঁচ বছরে কম করে হলেও ৫০ থেকে ৬০ লাখ টাকা ব্যাংকে জমে থাকার কথা।
বুয়াও আমজাদ হোসেনের বিপদের সময় থাকল না। তার এখানে কাজ করে হয়তো ভালোই টাকাপয়সা জমিয়েছে। তা না হলে এ করোনার দুর্যোগেও কাজ ছেড়ে কেউ যেতে পারে! বুয়াকেই বা দোষ দিয়ে লাভ কি? নিজের সন্তানরাও তো এই করোনার বিপদের সময় তাকে গ্রহণ করল না। এ যে কত বড় কষ্ট বাবা হিসেবে, তা হয়তো বলে বোঝাবার নয়।
নাহ! আজকে আর রান্না করতে ইচ্ছে করছে না। দুপুরটা কলা-পাউরুটি খেয়েই কাটিয়ে দেবে। বিকেলের দিকে শহরের দিকে বের হবে। কোনো হোটেল খোলা পেলে রাতের খাবার কিনে নিয়ে চলে আসবে।
ঘর থেকে বেরই হলেন না আমজাদ হোসেন। জানালা দিয়ে নদীর পানে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন। একসময়ের ভরা নদী এখন মরা খালে পরিণত হয়েছে। কালের পরিক্রমায় মহানন্দাও তার যৌবন হারিয়ে ফেলেছে। জানালা দিয়েও নদীর ঢেউ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন, বাতাসের সামান্য বেগ থাকায়। কয়েকটি মাছ ধরা ছোট ডিঙিকেও দেখা গেল। বৃষ্টি থেমে গেছে। তাই জেলেরা জাল ঠিকঠাকমতো আছে কিনা তা পরখ করে নিচ্ছে।
আমজাদ হোসেন ভাবেন, ওই জেলেরা তার চেয়েও সুখে আছে! তাদের কোনো পিছুটান নেই, সন্তানদের কাছ থেকেও হয়তো আশা করে না তারা! কি জানি হতে পারে, হয়তো। কখনো তো জানার চেষ্টা করেননি। তবে হ্যাঁ, তাদের চলন-বলন দেখে, তাদের কথাবার্তা শুনে এই ধারণাগুলো জন্ম নিয়েছে তার মনে, ওই জেলেদের সম্পর্কে।
প্রায়শই ওই জেলেদের কাছ থেকে মাছ কিনতেন তিনি। রাবেয়া বেঁচে থাকতে প্রায় প্রতিদিনই মাছ কেনা হতো, রাতের বেলা। সে সুবাদে তাদের সঙ্গে কথা বলা। জেলেদের মধ্যে একজন তো তারই সমবয়সী।
আমজাদ হোসেন মনে করেন, সমবয়সী ওই জেলের সঙ্গে কথা বলা দরকার। জানা দরকার, তার জগৎসংসার সম্পর্কে। বাবা হয়েও সে কীভাবে হেসেখেলে দিনাতিপাত করতে পারছে, মাছ ধরতে পারছে! ভেবে স্থির করেন, তাকে একদিন ডেকে পাঠাবার। প্রতিদিন মাছ কেনার কারণেই মোবাইল নম্বর আগে থেকেই নেয়া ছিল। ফোন করলেই হবে। অবশ্য বুয়া চলে যাওয়ার পর এ পর্যন্ত একদিনও মাছই খাওয়া হয়নি। তাতে কি? ডেকে পাঠাতে তো আর কোনো অসুবিধে নেই। দীর্ঘদিনের সম্পর্ক, নিশ্চয়ই না করতে পারবে না।
মোবাইলটা হাতে নেন আমজাদ হোসেন। কন্টাক্ট তালিকা থেকে জেলের নম্বরে ডায়াল করেন। রিং হচ্ছে। ধরবে কিনা বুঝতে পারছেন না। ঘড়ির দিকে চট করে চোখ বুলিয়ে নেন। দেখেন বেলা ১২টা বাজে। এ সময় তার নদীতে থাকার কথাও নয়।
জেলে ফোনটা ধরতেই আমজাদ হোসেন বলে উঠেন, “দীননাথ, কাল মঙ্গলবার আমার সঙ্গে দেখা করতে পারবে? তোমার ডিঙি নিয়েই বাড়ির সামনে চলে এসো। ডিঙিতে বসেই তোমার সঙ্গে কথা বলে নেবক্ষণ।”
“হ্যাঁ বাবু, পারব।” মোবাইলের ও-প্রান্ত থেকে জবাব দেন দীননাথ।
“কোন সময় পারবে?”
“তা বাবু, বিকেল ৩টার দিকে নদীতে জাল ফেলতে শুরু করি। ধরুন, সাড়ে চারটে নাগাদ চলে আসতে পারব।”
“ঠিক আছে, তবে ওই সময়ই এসো। আমি নদীর ধারে পৌঁছে যাবো।” বলেই ফোনটা কেটে দেন, দীননাথকে ‘কেন’ প্রশ্ন করার সুযোগ না দিয়ে।
এরপর আমজাদ হোসেন দুপুরের খাওয়ার প্রস্তুতি নেন। খাওয়ার পরই নামাজ পড়বেন বলে মনস্থির করেন।
রান্নাঘরে ঢুকে পাউরুটি বের করেন। সেই সঙ্গে ফ্রিজে থাকা জেলিটাও বের করে নিয়ে সোজা ডাইনিং টেবিলে গিয়ে বসেন। কলা টেবিলেই ছিল। কিন্তু আজ কেন জানি খুব একটা খাওয়ার প্রতি চাহিদা নেই। দুপুরে খেতে হয়, তাই খাওয়া। পাউরুটির কয়েকটা স্লাইসে জেলি লাগিয়ে খেয়ে নেন। পরে দুটো কলাও। ডাইনিং টেবিলেই কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিয়ে বাথরুমে ঢুকে পড়েন ওজু করতে।
নামাজ পড়ার পর বিছানায় গা এলিয়ে দেন আমজাদ হোসেন। ভাবনার সাগরে ডুব দিতে মন চায় তার। কিন্তু হয়ে উঠে না। ঘুরেফিরে একটা স্মৃতিই মনের মধ্যে ভেসে উঠে। চাইলেই যা দূর করতে পারছেন না। ভাবেন, তার সঙ্গে যা ঘটেছে, রাবেয়া বেঁচে থাকলে কি তা ঘটত। কখনোই না। আবার পরক্ষণেই ভাবেন, ঘটলেও এতটা কষ্ট পেতেন না। এখন যতটা পাচ্ছেন। রাবেয়া হয়তো সেসব ভাবার সময়ই দিত না।
ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন, তা বলতে পারবেন না। আসরের আজানের শব্দে ঘুম ভাঙে তার। মসজিদটা কাছে, তাই আজান বেশ জোরেই শোনা যায়। তা না হলে যে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়েছিলেন, সহসাই ভাঙার কথা ছিল না।
দ্রুতই বিছানা ছেড়ে উঠেন, নামাজ পড়ার জন্য। জীবনে এই একটি কাজে কখনো ঢিলেমি করেননি তিনি। আজানের সঙ্গে সঙ্গেই মসজিদে প্রবেশ করতেন। এমনকি চাকরির সময়েও। কালেভদ্রে দু’একদিন যে এদিক-ওদিক হয়নি, তা কিন্তু নয়। তবে অবসরে যাওয়ার পর তার পরিবর্তন ঘটেনি কোনো দিন। এখন অবশ্য মসজিদে যাওয়া হয় না, ওই যে করোনা ভাইরাস। এই এক প্রাণঘাতী অদৃশ্য শত্রু, যাতে বিপর্যস্ত গোটা বিশ্ব। বাদ যায়নি নিজের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশও।
আবারো পুরোনো ঘটনাটা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। ভাবেন, করোনায় সবচেয়ে বেশি বিপদগ্রস্ত মানুষ তিনি, হয়তো! যা তাকে অর্ধেকটাই মৃত করে তুলেছে। নাহ! মসজিদে গিয়েই নামাজ পড়বেনÑ জোরালোভাবে মনস্থির করেন তিনি। যেদিন সন্তানদের কাছে চরম আঘাত পেলেন করোনার কারণে, সেদিনই তো মরে গেছেন মনের দিক থেকে। এখন শুধু দেহটাই বেঁচে আছে। এটাকে যতদিন একাকী ঠেলে নিয়ে যেতে পারেন? তাহলে শুধু শুধু মিছে ভয়ে মসজিদ থেকে দূরে থাকা কেন?
মসজিদে গিয়েই আসরের নামাজ পড়ে আসেন আমজাদ হোসেন। মুসল্লি ছিল না বললেই চলে। তাকে দিয়ে ছয়-সাতজন মতো হবে। নামাজ সেরে বের হয়ে যাদের সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলতেন, তাদের কাউকেই দেখতে পাননি। সবাই তো আর আমজাদ হোসেন নয়! সবার সন্তানও তো আবার তার সন্তানদের মতো নয়! তাদের আসতে বারণ করার অনেকেই আছে, শুধু তারই নেই! একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস বের হয়ে যায় আমজাদ হোসেনের।
বাড়ি ফিরে চায়ের তেষ্টা অনুভব করেন। রান্নাঘরে ঢুকে পানি গরম করে টি-ব্যাগ দিয়ে এক মগ চা বানিয়ে বারান্দায় গিয়ে বসেন। সামনে নদীতে জেলেদের ডিঙি চলাচল করতে দেখা যায়। সবাই জাল নিয়ে ব্যস্ত। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার পর জাল তুলবে সবাই। যা মাছ উঠবে রাতেই বিক্রি করে দেবে। রাত আটটার দিকে টোলঘর অথবা বারঘরিয়া বাজারে গেলেই নদীর মাছ মিলবে। খালঘাটের ওখানেও নদীর মাছ বিক্রি হয়, তবে কখনো সেখানে মাছ কিনতে যাওয়া হয়নি তার। তাছাড়া বেশির ভাগ সময় জেলেরাই বাড়িতে এসে মাছ দিয়ে গেছে, ভালো দাম পাওয়ার আশায়। কদাচিৎ শখের বসে কখনো টোলঘর, কখনো বারঘরিয়া বাজারে গিয়েছেন মাছ কিনতে।
চা খাওয়া শেষ হতেই একটু বাইরে হাঁটতে মন চাইল আমজাদ হোসেনের। যদিও শহরের দিকে যাওয়ার কথা ছিল এই সময়। শহরে যাওয়ার চিন্তাটা বাদ দেন।
চারতলার বাড়ির পুরোটাই নীরব। শুধু তিনি রয়ে গেছেন, নিজের বাড়ি বলে। ভাড়াটিয়ারা থাকলে তাদের সঙ্গে কথা বলে সময় পার করা যেত। তা তো হওয়ার নয়।
তালা মেরে বাড়ি থেকে বের হন আমজাদ হোসেন। নদী পাড়ের এই রাস্তায় করোনাকালেও মানুষের আনাগোনা চোখে পড়ে। তফাৎ, মানুষগুলো শুধু এখানকারই; শহরের কেউ নেই। নদী পাড়ে সিমেন্ট দিয়ে তৈরি বেঞ্চগুলোতে স্থানীয়রাই কেবল। অথচ আগে এমনটি দেখা যেত না। তখন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদেরই দেখা যেত বেশি। অনেক স্বামী-স্ত্রীদেরও দেখা যেত।
হাঁটতে হাঁটতে টোলঘর পর্যন্ত এসে পড়েন। যে টোলঘর সারাদিন কর্মমুখর থাকত, সেটাও এখন নীরব হয়ে পড়েছে। পরিবেশটাই কেমন জানি ভূতুড়ে হয়ে উঠেছে। এখানে এসে পুলিশের পদচারণা দেখতে পান। বুঝতে পারেন, মহানন্দা সেতুতে বিকেল বেলা মানুষের ভিড় জমে। সেটা না হতে দেয়ার জন্যই পুলিশ।
এখানে এসে বারঘরিয়া দৃষ্টিনন্দন পার্কটা একবার ঘুরে আসতে মন চাই আমজাদ হোসেনের। কিন্তু পুলিশ যেতে দেবে কিনা বুঝে উঠতে পারেন না। আচ্ছা, হাঁটা তো শুরু করা যাক। বাধা দিলে ফিরে যাবেন ক্ষণ।
ধীরে ধীরে সেতুর দিকে এগোতে লাগলেন। না, পেছন থেকে কেউ ডাক দিল না। বোধহয় বয়স্ক লোক ভেবেই! গতি না বাড়িয়ে আস্তে আস্তে সেতুর বাঁ পাশ ধরে হাঁটতে থাকলেন। সেতুর মাঝামাঝি যেতেই পণ্যবোঝাই একটি দশ চাকার ট্রাক শনশনিয়ে চলে যায়। পণ্যবোঝাই ট্রাকটির ভারে পুরো সেতু দুলতে থাকে, না পার হওয়া পর্যন্ত। আচ্ছা, এই যে সেতুটি দুলে উঠল ওই ট্রাকের ভারে; এর চালক কি সেটা অনুভব করতে পেরেছে? নিশ্চয়ই না। অথচ তার পণ্যবোঝাই ট্রাকের কারণেই অনেকে কম্পিত হলো, কিন্তু সে টের পেল না! টের পেলে তারই বা কী করার আছে? সত্যিই তো! তবে এটাও সত্য যে, যার আচরণের দ্বারা অন্য কেউ কষ্ট পায়, মনে আঘাত পায়; কিন্তু এটা বুঝতে চায় না, আচরণটা যে করে।
সেতু পার হয়ে চলে এসেছেন আমজাদ হোসেন। বামেই দৃষ্টিনন্দন পার্ক, যা সর্বদাই মানুষের কোলাহলমুখর থাকত বিকেল থেকে রাত অবধি পর্যন্ত। সে জায়গা এখন মরুভূমির মতো খাঁ খাঁ করছে। একটি চটপটি কিংবা ফুচকার দোকানও চোখে পড়ছে না। মানুষ না এলে দোকানই বা থাকে কী করে!
সেতুর সিঁড়ি দিয়ে দৃষ্টিনন্দনে নেমে পড়েন। নেমেই রাবেয়ার মুখচ্ছবি তার মানসপটে ভেসে ওঠে। বয়স হলেও চটপটির প্রতি বিশেষ আগ্রহ ছিল রাবেয়ার। তাও আবার এখানে এসে খাওয়ার। তার অবশ্য খুব একটা আগ্রহ ছিল না। আগে বাড়িতেই বানিয়ে খেত। কিন্তু যবে থেকে এই দৃষ্টিনন্দনে এর দোকান বসতে শুরু করেছে, তবে থেকেই এখানে এসে চটপটি খাওয়ার অভ্যাস তৈরি হয়েছিল রাবেয়ার। কোনো দিন সন্ধ্যের মধ্যে বাড়িতে ফিরলেই মাগরিবের নামাজ পড়ে রাবেয়াকে এখানে নিয়ে আসতেই হতো।
রাবেয়ার কারণে কিনা, আজ তার চটপটি খেতে খুব ইচ্ছে করছিল। অথচ রাবেয়া চলে যাওয়ার গত কয়েক বছরে বেশ আসা হয়েছে বারঘরিয়া বাজারে। অবশ্য দৃষ্টিনন্দনে নয়। কিন্তু চটপটি খাওয়া হয়নি। এখানে আসতেন বারঘরিয়ার এক বন্ধুর সঙ্গে আড্ডা দিতে। বন্ধু অনেকবার অফার করলেও খেতে মন চাইনি আমজাদ হোসেনের। অথচ আজ খেতে মনে চাইছে; কিন্তু চটপটির দোকান নেই।
বুঝতে পারেন, সন্তানদের আচরণে একাকীত্বের যন্ত্রণায় তার রাবেয়াকে মনে পড়ছে বারবার। দাম্পত্য জীবনে সুখিই ছিলেন তারা। জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাত-কষ্ট-সুখ একে অপরের সঙ্গে ভাগাভাগি করে পথ চলেছেন। অথচ জীবনের সবচেয়ে বড় যন্ত্রণাটুকু ভাগ করে নেয়ার জন্য রাবেয়া রইল না। এটাই নিয়তি! আচ্ছা, রাবেয়া বেঁচে থাকলে কি সন্তানদের এই আচরণ সইতে পারত? না। ও বেচারি সইতে পারত না। তাই তো বুঝি আল্লাহ তাকে আগেই উঠিলে নিলেন তার কাছ থেকে!
চটপটি খাওয়ার আশা বাদ দেন আমজাদ হোসেন। এদিকে মাগরিবের সময় ঘনিয়ে আসে। বাড়িতে ফিরতে হবে। ফাঁকা বাড়ি। তাছাড়া করোনার কারণে অনেক মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছে। বলা তো যায় না! এবার একটু গতি দিয়ে হাঁটা শুরু করেন। ইচ্ছে মাগরিবের আজানের সঙ্গে সঙ্গেই বাড়িতে ঢোকবার। তাছাড়া রাতের জন্য ভাতও রান্না করতে হবে। বাইরে খাবার পাওয়ার আশা নেই। ভাবেন, আজকের দিনটা আলু-ভর্তা দিয়েই পার করে দেবেন।
#
মঙ্গলবার, বিকেল সাড়ে ৪টা। দীননাথের সঙ্গে কথা বলার জন্য বাড়ির সামনে নদী তীরে এসে দাঁড়ান আমজাদ হোসেন। ওপারে দীননাথ হাতের ইশারা করে বোঝাতে চাচ্ছে, চলে এলো বলে।
এপারে ডিঙি নিয়ে আসতে দীননাথের দশ মিনিট দেরি হয়। কেননা তার জাল ফেলা সম্পন্ন না করে আসতেও পারছিল না। আমজাদ হোসেন ডিঙিতে চড়ে ছইয়ের নিচে গিয়ে বসেন। তারপর যতটা সম্ভব চেহারার মধ্যে সপ্রতিভ ভাব রাখার চেষ্টা করেন। ভেতরের চাপা আর্তনাদ দীননাথকে বুঝতে দেয়া যাবে না। যাকে বলে মধ্যবিত্তীয় রোগ! অধস্তনের কাছে ছোট হওয়া সাজে না।
ছইয়ের নিচে বসেই ভাবনার সাগরে ডুব দেন। ভুলেই যান, ডিঙিতে জেলে দীননাথও আছে।
দীননাথের সঙ্গে দেখা করার আরেকটা উদ্দেশ্যও ছিল তার। সন্তানদের যে আচরণে তিনি যন্ত্রণাবিদ্ধ হয়েছেন, সেটি শেয়ার করতে চেয়েছিলেন। তার নিজের কাছেই মনে হয়েছিল, বিষয়টি কারো সঙ্গে শেয়ার করলে তিনি হয়তো হালকা বোধ করবেন। আর শেয়ার করার জন্য তিনি বন্ধুদের বদলে জেলে দীননাথকেই বেছে নিতে চেয়েছিলেন, অন্যদের মধ্যে জানাজানি না হওয়ার সম্ভাবনা থেকে। কেননা সারাজীবন বন্ধুদের কাছে তিনি সন্তানদের নিয়ে গর্বই করে গেছেন। আজ সেই সন্তানদের খারাপ দিকটাই বা কীভাবে তাদের কাছে তুলে ধরেন? তিনি যে মধ্যবিত্তীয় বাবা!
আবার সন্তানদের এহেন নিষ্ঠুর আচরণইবা তিনি কীভাবে হজম করবেন? প্রতিউত্তরও পান না। সন্তানদের কাছে বেশি কিছু তো চাননি। টাকাপয়সাও চাননি। বরং দিয়েই গেছেন। বড় ছেলে ব্যবসার বায়না ধরলে তাকে পনের লাখ টাকা দেন। এর এক বছর পর ছোট ছেলেকেও একই পরিমাণ টাকা দেন, না চাইতেও। অবশ্য এর জন্য রাবেয়াই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। ওর যুক্তি ছিল, বড় ছেলেকে দিয়েছ, ছোটটাকেও দাও। না দিলে একসময় এই নিয়ে মনোমালিন্য ঘটবে। রাবেয়া দুই সন্তানকে সমানভাবেই সবকিছু দিত। কেউই অভিযোগ করতে পারবে না, কাউকে কম দেয়া হয়েছে।
সংসারটা ভালোই চলছিল। রাবেয়া তার যোগ্য স্ত্রীই ছিল। সবকিছু হাসিমুখে আগলে রাখত। সন্তানদের প্রতি তাদের কখনো ক্ষোভ কিংবা রাগ জন্মায়নি। অথচ নিয়তির নির্মম পরিহাস! সেই সন্তানদের প্রতি আজ তার ক্ষোভ উগড়ে পড়তে চাচ্ছে।
আমজাদ হোসেন জীবনে ভালোবাসা এবং টাকা দুটোই চেয়েছিলেন। পেয়েওছিলেন। কিন্তু আজ! টাকাপয়সা থাকলেও ভালোবাসা নেই। সুখও নেই। শান্তি তো চাপা পড়ে গেছে শহুরে সভ্যতায়। এখন উপলব্ধি করছেন, পকেটে কত টাকা আছে সেটা বড় বিষয় নয়; মনের মধ্যে সন্তুষ্টি বা তৃপ্তি আছে কিনা আগে তার খোঁজ করা। এই যে চারতলা বাড়ি, বাগান, ব্যাংকে ফিক্সড ডিপোজিট এসবই তো সন্তানদের হবে; তার অবর্তমানে। তাহলে বাবাকে ওরা বোঝা মনে করল কেন? আচ্ছা, ওরা কী ধরেই নিয়েছে, বাবাকে দেখুক আর না দেখুক সম্পত্তি তো এমনিতেই তাদের হয়ে যাবে। ভাবনাটা ভুলও নয়। এমনটাই তো হয়।
আজ আমজাদ হোসেনের কেবলই মনে হয়, বাপ-ছেলের সম্পর্কের গভীরতাটাই ভুলিয়ে দিতে বসেছে করোনা ভাইরাস। আবার এও ভাবেন, করোনা একটা উসিলা মাত্র। রাবেয়া মারা যাওয়ার পর থেকেই হয়তো তারা বাবাকে বোঝা মনে করে চলছিল। যার বহিঃপ্রকাশ করোনাকালে ঘটল।
এই তো এক মাস হলো ঘটনাটি ঘটার। মার্চের ২০ বা ২১ তারিখ হবে। সেদিন সকালে গায়ে ভীষণ জ্বর এসেছিল আমজাদ হোসেনের। কী করবেন, ভেবে পাচ্ছিলেন না। একা মানুষ, বুয়া ছাড়াও কেউ ছিল না। ভয় হচ্ছিল করোনা হয়ে যায়নি তো? দেশের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর করোনার যেসব উপসর্গের কথা বলেছে, তার মধ্যে জ্বরও আছে। সে জায়গা থেকে মনের মধ্যে ভয় ঢুকে তার। এ ভয়ই সারাক্ষণ তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। কিন্তু তা তো হওয়ার নয়, পরক্ষণেই ভাবেন। কেননা গত দশ দিন তিনি বাড়ি থেকে বেরই হননি। ৮ তারিখ সরকারিভাবে দেশে করোনা শনাক্ত হওয়ার খবর প্রচারের পরই দুই মাসের বাজার একসঙ্গে করে নিয়েছিলেন।
জ্বরের চোটে বেহুশ হওয়ার জোগাড় হয়েছিল তার। এ সময় আপনজন কেউ পাশে থাকলে ভালো লাগত। আপনজনদের কাছে গিয়ে থাকলেও হতো। এ ভাবনা থেকে প্রথমেই ফোন দিয়েছিলেন ছোট ছেলেকে। রাজশাহীতে থাকার কারণেই ছোট ছেলেকে ফোন দেয়া।
“বাবা রাতুল, আমার প্রচ- জ্বর। আমাকে তোদের কাছে নিয়ে যাবি? কিংবা তোরা এখানে এসে থাকবি? মনে হচ্ছে, তোদের সঙ্গে থাকলে আমার ভালো লাগত?” কোনো কুশল বিনিময় না করে ছেলেকে সরাসরি কথাগুলো বলে ফেলেন।
ছেলের কোনো জবাব পাওয়ার আগে ও-প্রান্ত থেকে বৌমার কণ্ঠস্বর শুনতে পান। বৌমা রাতুলকে বলছে, ‘কে ফোন করেছে?’ রাতুল বৌমাকে উত্তর দেয়, ‘বাবা। বলছে, ভীষণ জ্বর। গিয়ে নিয়ে আসতে বলছে।’ এ কথা শুনে বৌমা ঝনঝনিয়ে উঠে। রেগে গিয়ে বলে, ‘তোমার কি কোনো হুঁশ-বুদ্ধি হবে না নাকি? বলছে, জ্বর। তার মানে তো করোনা। আমি বাপু বলে দিচ্ছি, এখানে আনা যাবে না। আনলে ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে আমি আমার বাপের বাড়ি চলে যাবো। আর এখানেই বা আসবে কেন? কাজের বুয়া নেই নাকি? তাকে ক’টা টাকা বেশি দিলেই তো ভালোভাবে দেখভাল করবে।’
বৌমার সব কথাই স্পষ্ট শুনতে পান আমজাদ হোসেন। জ্বর তাকে যতটা না কাহিল করেছিল, তার চেয়ে বেশি করল বৌমার কথাগুলো। বন্দুকের তীক্ষè বুলেটের মতো বৌমার কথাগুলো বুকে বিদ্ধ হয়। যে বুলেটের ক্ষত সারাজীবনেও সারবার নয়!
এরপর ছেলে রাতুল ফোনের ও-প্রান্ত থেকে জবাব দেয়।
“বাবা, মানে, ইয়ে আর কি…।”
আমজাদ হোসেন বুঝতে পারেন, ছেলে কি বলতে চাইছে। তাই দেরি না করে, কথা না বাড়িয়ে শুধু বলেন,
“তোরা ভালো থাকিস।” বলেই ফোনটি কেটে দেন।
বড় ছেলেকে ফোন দেবেন কিনা, তা নিয়ে ভাবেন। সেও যদি একই আঘাত করে, তাহলে? করতেই পারে। আধুনিক যুগ! এখন তো মা-বাবার প্রতি ভালোবাসা সন্তানরা বছরে একটা দিবসের মধ্যেই ঠেলে ফেলে দিয়েছে। তবুও। নিজের বড় সন্তান বলে কথা। ছোটটি যে আচরণ করেছে, বড়টিও তা করবে; কেনই বা তার এ কথা মনে হচ্ছে। করলে করবে। বড় ছেলে একই আচরণ করলে না হয় ষোলকলায় পূর্ণ হবে!
অজানা আশঙ্কা আর দুরু দুরু মন নিয়ে বড় ছেলে আনককে ফোন দেন। রিসিভ করতে ছোট ছেলের মতোই আনককে বলেন,
“বাবা আনক, আমার প্রচ- জ্বর। আমাকে তোদের কাছে নিয়ে যাবি? কিংবা তোরা এখানে এসে থাকবি? মনে হচ্ছে, তোদের সঙ্গে থাকলে আমার ভালো লাগবে।”
“বাবা, মানে বলছিলাম কি, তোমার বৌমারও শরীরটা ভালো না। ও বলছিল, ওর এ অবস্থায় বাবাকে নিয়ে এলে…।”
ছেলেকে কথা শেষ করতে দেন না আমজাদ হোসেন। বলেন,
“বাবা, আর কিছু বলতে হবে না। বুঝে গেছি।”
এ কথা বলেই ফোনটা কেটে দেন। ল্যান্ডফোন হলে রিসিভারটা দড়াম করে রেখে দিয়ে নিজের ক্ষোভ প্রকাশের সুযোগ থাকত। মোবাইল ফোনে তা হওয়ার নয়। ছেলে মিথ্যে বলছে তা বুঝতে বেগ পেতে হয় না তার। একদিন আগেই বৌমা আর নাতনিদের সঙ্গে কথা হয়েছে। হাসিখুশিই ছিল। বাপকে নিয়ে যাওয়ার কথা বলতেই আজ বৌমার শরীর খারাপ হয়ে গেল। আমজাদ হোসেন আরেকটি কথা বেশ বুঝতে পারেন। তাহলো তার ফোন দেয়ার আগে নিশ্চয়ই রাতুল ও তার বউয়ের সঙ্গে বড় ছেলে আনক ও তার বউয়ের কথা হয়ে গেছে। এজন্য আনকও একই আচরণ করল বাবার প্রতি।
কখন যে দু’চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়েছিল, টেরই পাননি। গালে হাত দিতে গিয়ে বুঝতে পারেন। এ অশ্রুকে কোন ভাষায় আখ্যায়িত করবেন, তা ভেবে পান না। আনন্দের, না চরম অপমানের। নাকি এটি তার প্রাপ্যই ছিল?
যে সন্তানদের চাওয়া-পাওয়াকে জীবনের ব্রত বলে মনে করেছিলেন, আজ সে সন্তানদের কাছেই তিনি পরজীবী হয়ে উঠেছেন। বোঝা হচ্ছেন। সমাজে অন্যদের দেখেও মনের মধ্যে উদয়ই হয়নি যে, নিজের সন্তানদের কাছে এরকম আচরণ তিনি কখনো পেতে পারেন। কয়েক বছর আগের কথা। পত্রিকার এক রিপোর্টে পড়েছিলেন, সন্তানেরা সরকারি চাকরিজীবী আর মা থাকেন কুঁড়েঘরে। দেখভালের কেউ নেই। সেই খবরটি পড়ে ওই বৃদ্ধার সন্তানদের চরম শাপ-শাপান্ত করেছিলেন। আজ সেই শাপ-শাপান্ত করতে হবে নিজের ছেলেদের! কখনো কি ভেবেছিলেন?
আর ভাবতে পারছিলেন না। গায়ে জ্বরটা আরো জেঁকে বসেছিল। অগত্যা ডাক্তারবন্ধুকে ফোন লাগান। বিস্তারিত বলেন। শুনে ডাক্তারবন্ধু হেসেই জবাব দেন, ‘বন্ধু, ঘাবড়াবার কিছু নেই। এ সাধারণ জ্বর। এ সময় এই ধরনের জ্বর হয়েই থাকে। তোমার মতো সুঠাম দেহের শরীরকে সহজে কাবু করতে পারবে না। যাহোক, আমি চেম্বারের লোকের হাতে ওষুধ পাঠিয়ে দিচ্ছি। তিন দিনই সেরে যাবেক্ষণ। তবে খুব খারাপ লাগলে ছেলেদের কাছে গিয়ে থাকতে পারো।’ ডাক্তারবন্ধুর এই কথাতে মনটা আরো মুষড়ে পড়ে তার। সে বিষয়ে আর ভাবতেও চান না।
সত্যিই সুঠাম দেহের অধিকারী ছিলেন আমজাদ হোসেন। অবসর নেয়ার পরও অনেকেই বিশ্বাস করত না। বলত, আরো কয়েক বছর চাকরি আছে। তবে রাবেয়া মারা যাওয়ার পর শরীরের ওপর কিছুটা হলেও প্রভাব পড়েছে, যা কেবলমাত্র তিনিই অনুভব করতে পারেন।
শেষ পর্যন্ত ডাক্তারবন্ধুর ওষুধেই তিন দিনেই সেরে ওঠেন। শারীরিকভাবে সুস্থ হলেও মনের দিক থেকে অসুস্থ হয়ে পড়েন। শয়নে-স্বপনে-জাগরণে সবসময়ই দুই ছেলের আচরণের কথাই মনে পড়ত। এ যে কত বড় যন্ত্রণার, তা কাউকে বলে বোঝাবার মতো অবস্থায় ছিল না আমজাদ হোসেনের। এই এক মাস যাবৎ সেই দুঃসহ যন্ত্রণা বুকের মধ্যে বয়ে বেড়াচ্ছেন। না পারছেন উগলাতে, না পারছেন হজম করতে।
হঠাৎই শরীরে ঝাঁকুনি অনুভব করেন। ঝাঁকুনির চোটে সম্বিৎ ফিরে পান। দেখেন, দীননাথ তার গায়ে ঝাঁকুনি দিচ্ছে। বিষয়টি বুঝতে পেরে কিছুটা লজ্জিত হন। ভাবনার সাগরে ডুব দিয়ে কখন যে বেশ কিছু সময় পার করে ফেলেছেন, তা বুঝতে পারেননি।
“বাবু, আপনাকে কতক্ষণ ধরে ডেকে চলছি, শুনতেই পাচ্ছেন না। তাই বাধ্য হয়ে আপনাকে ঝাঁকুনি দিলাম। আমি তো ভয় পেয়ে গেছিলাম। তা বাবু, কি হয়েছে আপনার? কি ভাবছিলেন?” এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলেন দীননাথ।
“কই, না তো। সেরকম কিছু ভাবছিলাম না। আসলে অনেক দিন পর নদীতে এরকম পরিবেশে বসে মনটা একটু অন্যরকম হয়ে গিয়েছিল।”
কথা ঘোরানোর চেষ্টা করেন আমজাদ হোসেন। তবে তার উত্তর যে বিশ্বাস হয়নি, তা দীননাথের চোখমুখই বলে দিচ্ছে।
“তা বাবু, কি জন্য দেখা করতে বলেছেন? আর কিইবা কথা বলবেন আমার সঙ্গে?” জিজ্ঞেস করেন দীননাথ।
“সেরকম কিছু না। অনেক দিন মাছ কেনা হয় না। সেজন্য তোমাদের সঙ্গে কথাও হয় না। কাল হঠাৎ করেই তোমার কথা খুব মনে পড়ছিল। তাই ভাবলাম, তোমাকে ডেকে একটু কথা বলি।”
এ কথা বলার পর আবারো অন্যমনস্ক হয়ে পড়েন আমজাদ হোসেন। ভাবেন, এই জেলের সঙ্গে তার প্রতি তার সন্তানদের আচরণের কথা শেয়ার করাটা কতটুকু যুক্তিযুক্ত হবে। যেখানে তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের সঙ্গে এটা করতে পারেননি। তাছাড়া এই দীননাথও তো তার পরিবার সম্পর্কে জানে। নাহ! মনে হচ্ছে এর সঙ্গে শেয়ার করাটা ঠিক হবে না। যাই ঘটে থাকুক তার সঙ্গে, তার সন্তানেরা যে আচরণই করে থাকুক, তা কাউকে বলা যাবে না।
মধ্যবিত্তীয় বাবা থেকে বের না হতে পারা আমজাদ হোসেন সিদ্ধান্ত নেন, দীননাথের সঙ্গে শেয়ার করবেন না। শুধু দীননাথের জগৎটা জানার চেষ্টা করবেন। তার সেসব জেনে সেখানে যদি কিছু শেখার থাকে। তারপর দীননাথকে জিজ্ঞেস করেন,
“আচ্ছা, তোমার তো তিন ছেলে, এক মেয়ে। তা সবার বিয়ে দিয়ে দিয়েছ তো?”
প্রশ্নটা করে আবারো বেকুব সেজে যান আমজাদ হোসেন। এ খবর তো তার জানাই। তাই দীননাথ কিছু বলে উঠবার আগেই নিজেই আবার বলে উঠেন,
“আসলে কি, বিয়ে হয়ে গেছে তা জানি। তা ছেলেরা সব কেমন আছে? একসঙ্গেই থাকো বুঝি?”
দীননাথ স্পষ্টতই বুঝতে পারেন আমজাদ বাবুর কিছু একটা হয়েছে। তাই বারবার কথা ঘোরাচ্ছেন। কিন্তু জোর দিয়ে জিজ্ঞেসও করতে পারছেন না। গরিব মানুষ। ওসব বড়লোকি বিষয়ে তার নাক না গলানোয় ভালো।
“জি বাবু, ভালোই আছে। সবাই আলাদা, অন্যত্র থাকে।”
“তোমার সঙ্গে এর আগে অনেকবার কথা হলেও এসব জানা হয়নি কখনো। তা ওরা কবে থেকে আলাদা থাকছে?”
“ওদের বিয়ে দেয়ার পরপরই।”
“অ্যাঁ, বলো কি দীননাথ! বিয়ে দেয়ার পরপরই?।” কিছুটা বিস্মিত হয়ে বলেন আমজাদ হোসেন।
“জি বাবু।”
“তোমার কষ্ট হয়নি দীননাথ?”
“কষ্ট আর কীসের বাবু! দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেয়াটা তো একটা কষ্ট। সেখানে কেউ আলাদা হয়ে গেলে বা ছিটকে পড়লে তাতে কষ্ট আর কতটুকুইবা বাড়ে বলুন। একেবারে যে হয় না, তা কিন্তু নয়। তবে এখানেও এক ধরনের সুখ আছে।”
“সেটা কীরকম?”
জবাব দেন না দীননাথ। শুধু তার ঠোঁটের কোণে একচিলতে মুচকি হাসি দেখা যায়। যে হাসির কোনো অর্থ দাঁড় করাতে পারেন না আমজাদ হোসেন। তবে দীননাথের কথা বলার ভঙ্গিতে একটা নিজস্বতা আছে, আছে গাম্ভীর্য। মানতেই হয়। ভাবেন, হয়তো লেখাপড়া জানা।
“আচ্ছা দীননাথ, ছেলেরা আলাদা থাকার পরও তোমার কোনো খোঁজখবর নেয় না?” নিজের সন্তানদের কাছ থেকে পাওয়া অভিজ্ঞতা থেকে গুরুত্বপূর্ণ এ প্রশ্নটি করে ফেলেন আমজাদ হোসেন।
“নেয় বাবু। দু’একদিন পরপরই প্রত্যেকেই ওর মাকে, আমাকে ফোন করে। খোঁজখবর নেয়। প্রতি সপ্তাহে ভালো-মন্দ খাবার কিনে দিয়ে যায়। অসুখ করলে হাসপাতালে ছুট দেয়। মাস শেষে সামর্থ্য অনুযায়ী আমাদের সংসারের খরচের টাকাটাও দিয়ে যায়। আর বাবু, দুর্গাপূজাটা নাতি-নাতনিদের নিয়ে একসঙ্গেই পালন করি।”
একটু থেমে দীননাথ আবার বলেন, “আমাকে তো ওরা মাছ ধরতেই দিতে চাই না। আর দেশে করোনা শুরু হওয়ার পর তো একেবারেই না করে দিয়েছে। কিন্তু বাবু, বাপ-দাদার সঙ্গে সেই দশ-এগার বছর বয়স থেকে মাছ ধরছি, সে অভ্যেস কি সহজে ছাড়তে পারি? তাই ওদের বলে-কয়ে মানিয়ে নিয়েছি। তবে এই করোনাতে বাজারে যাওয়া বারণ। ছোট ছেলেই প্রতিদিন সকাল আর রাতে বাজারে বিক্রেতারে কাছে মাছ দিয়ে আসে।”
দীননাথের এসব কথা শুনে অবাক হন আমজাদ হোসেন। নিজের সন্তানদের সঙ্গে মেলানোর চেষ্টা করেন। ব্যথিত হন কিছুটা। করোনার কারণে দীননাথকে মাছ ধরতেই বারণ করেছে ছেলেরা। আর তাকে! বুয়ার ঘাড়ের ওপর দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়ে দায়মুক্তি পেতে চেয়েছে তার সন্তানেরা। নিয়তি, নির্মম নিয়তি!
যে ছেলেরা দীননাথের নিয়মিত খোঁজখবর রাখে, তারা কীভাবে আলাদা হয়ে যায়? এ প্রশ্নের কোনো উত্তর না খুঁজে পেয়ে সরাসরি দীননাথকেই জিজ্ঞেস করেন আমজাদ হোসেন, “আচ্ছা, ছেলেরা তোমাদের এত খোঁজখবর রাখে, তারপরও ওরা আলাদা থাকে কেন?”
এ প্রশ্ন করার পরপরই আমজাদ হোসেন আবার বলে উঠেন, “দীননাথ, একটানা বসে কথা বলতে একঘেয়েমি লাগছে। ডিঙিটা নদীতে নেবে? তুমি বৈঠা বাইতে বাইতে না হয় কথা হবে।”
“জি বাবু।” বলেই দীননাথ ডিঙিটা নদীতে ভাসিয়ে বৈঠা নিয়ে বাইতে শুরু করেন। তারপর বলতে থাকেন, “আসলে বাবু, আমিই ওদেরকে আলাদা থাকতে বলেছি।”
এ কথা শুনে প্রচ- ঝাঁকুনি খান। বলে কি? হিসাব মেলাতে পারেন না। বাবা হয়ে নিজে থেকেই ছেলেদের আলাদা করে দিলেন? এ কেমন বাবা? জিজ্ঞেস করে বসেন আমজাদ হোসেন, “কিন্তু কেন?”
“সে তো লম্বা কাহিনী বাবু।”
“তাও বলো।”
“বাবু, জীবনে যা হতে চেয়েছি তা তো হতে পারিনি। পূর্বপুরুষের পেশাতেই থেকে যেতে হয়েছে। ক্লাস ফাইভে পড়ার সময়ই দেশে যুদ্ধ বেধে যায়। এরপর দেশ স্বাধীন হয়; কিন্তু আমার আর স্কুলে যাওয়া হয়নি। নেমে পড়তে হয় মাছ ধরা পেশায়, বাপ-দাদার সঙ্গে। তারপর তো এই পেশায় পঞ্চাশ বছর কেটে গেল।”
একটু থামেন দীননাথ। তারপর বড় করে নিঃশ্বাস নেন। বলতে শুরু করেন।
“বাবু, আমরা ছিলাম ছয় ভাইবোন। আমি ছোট। সবার বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর চার ভাইয়ের সংসারে সারাক্ষণ মনোমালিন্য, খিঁচ-খিঁচানি লেগেই থাকত। দুই ভাই অন্য পেশায় ছিল। রোজগারও ভালোই করত। তাই বউ, ছেলেমেয়েদের জন্য ক’দিন পরপর আলাদা করে ভালোমন্দ খাবার খাওয়াত। এই নিয়ে অন্য বউদের মধ্যে কথা কাটাকাটি লেগেই থাকত। আমার বউও এ নিয়ে মাঝে মধ্যে হালকাভাবে আমাকে শোনাত। সংসারে অশান্তি নিত্য লেগে থাকায় একদিন বাপে চার ছেলেকেই আলাদা করে দেন। আমি বারঘরিয়া থেকে রামজীবনপুর যাওয়ার রাস্তায় সরকারি জায়গায় বসতি গড়ে তুলি। সেও চল্লিশ বছর আগে। তখন আমার সন্তান হয়নি। সে সময়ই ভেবে নিয়েছিলাম, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া না শেখাতে পারি, অসুবিধে নেই; কিন্তু বিয়ে দেয়ার পর বাড়িতে রাখব না।”
আবারো থামেন দীননাথ। বয়স হয়েছে। একনাগাড়ে এত কথা বলতে একটু কষ্টই হচ্ছে বৈকি। কাছে থাকা বোতল থেকে এক ঢোক পানি খেয়ে নিয়ে গলাটা ভিজিয়ে নিয়ে আবার শুরু করেন।
“খুব ইচ্ছে ছিল ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করাব। কিন্তু বাবু, মাছ ধরে কত টাকাই বা আর আয় হয়? তাছাড়া জেলে তো অনেক, নদীতে মাছও কমে গেছে। মেয়েটাকে ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়িয়ে অল্প বয়সেই বিয়ে দিয়ে দিয়েছিলাম, গোদাগাড়ীতে। বড় আর মেজ ছেলে অষ্টম শ্রেণি পাস করার পর আর পড়াতে পারিনি। সবারই লেখাপড়ার প্রতি ঝোঁক ছিল বাবু। কিন্তু কি করব? এরপর বাবু, বাড় ছেলে ট্রাকের হেলপার হিসেবে কাজ শুরু করে পুরোপুরি ড্রাইভার হয়ে যায়। ভালোই রোজগার। জায়গা কিনে বাড়িও করেছে। মেজ ছেলে একটি সংস্থা থেকে ঋণ নিয়ে ছোট পরিসরে মুদি দোকান চালু করে, বারঘরিয়া বাজারে। ভগবানের কৃপায় সেও আজ ভালো রোজগার করে। জায়গাও কিনেছে। বাড়ি শুরু করবে বলে। আর ছোট ছেলেকে বড় দুজনই লেখাপড়া করিয়েছে। সরকারি কলেজে থেকে ডিগ্রি পাস করেছে। শহরেই একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে, ওখানেই থাকে। আরি আমি যা আয় করি নাতি-নাতনিদের পেছনেই খরচ করি।”
দীননাথ থামেন। ডিঙিটা থানার ঘাটের কাছাকাছি চলে এসেছে। আবার ঘুরতে হবে। দীননাথ কথা বললে কি হবে, ডিঙি চালাতে চালাতে সে তার জাল ঠিকই পরখ করে গেছে, যা আমজাদ হোসেনের চোখ এড়িয়ে যায়নি।
দীননাথ আর কোনো কথা না বলাতে আমজাদ হোসেন জিজ্ঞেস করলেন, “ছেলেরাকে কী জন্য আলাদা করলে, তা কিন্তু বললে না দীননাথ।”
একটু হেসে দীননাথ বলে, “ঠিক আছে বাবু, বলছি।”
নৌকাটা ঘুরিয়ে নিয়ে আবার শুরু করেন দীননাথ।
“বড় ছেলেটা তখন পুরোপুরি ড্রাইভার হয়ে গেছে। মেজটাও দুই বছর হলো দোকান দেয়া। সে সময় দুই ছেলের একসঙ্গেই বিয়ে দিয়ে দিয়েছিলাম। বিয়ের ছয় মাস একসঙ্গেই কাটিয়েছি। তারপর একদিন তিন ছেলে আর দুই বৌমাকে নিয়ে আমরা বসি। তাদের স্পষ্ট করেই বলি, ‘দেখ বাবারা, আমরা চাই তোমরা এখন অন্যত্র গিয়ে আলাদা থাক।’ এ কথা শুনে বাবু কি বলব, ছেলেরা একযোগে চিৎকার করে উঠেছিল। বলছিল, ‘বাবা একি বলছেন?’ আমি বলেছিলাম, ‘বাবা, তোমরা আমাদের ভুল বুঝিও না। যা বলছি, তোমাদের ভালোর জন্যই বলছি।’ ছেলেদের উত্তর ছিল, ‘এতে আবার আমাদের ভালোর কি আছে?’ আমি বলেছিলাম, ‘পরে বুঝতে পারবে। আর তোমরা তো পর হয়ে যাচ্ছো না। আলাদা থাকে মানে তো পর হয়ে যাওয়া নয়। এখন যেভাবে আমাদের দেখাশোনা করছ, তখনো করবে। শুধু অন্যত্র থাকবে। দেখ বাবারা, তোমরা কষ্ট পাবে তা বুঝি। কিন্তু তোমাদের মূর্খ বাবার এই কথাগুলো বোঝার চেষ্টা করো! চার ভাইয়ের সংসারে আমি ভুক্তভোগী হয়েছি। আমি জানি। তোমাদের তিন ভাইয়ের আয় সমান নয়, কারো কম তো কারো একটু বেশি। সবাই চাইবে বৌ-সন্তানদের জন্য সামর্থ্য অনুযায়ী ভালো খাওয়াতে-পরাতে। তোমাদের একজনের দেখে আরেকজনের মনে হিংসা-বিদ্বেষ জন্ম নেক, মনোমালিন্য ঘটুক তা আমি চাই না। আলাদা থাকলে এসব বিষয় কখনো জটিল আকার ধারণ করতে পারবে না, সম্পর্কেও চিঁড় ধরবে না। তোমরা নিজেদের মতো করেই সংসার চালাবে। বাবারা, আমার কথাগুলো মন দিয়ে উপলব্ধি করার চেষ্টা করো।’ বাবু, এরপর দুই ছেলে নীরবেই আমার কথা মেনে নিয়েছিল। দুই বছর পর ছোট ছেলেকেও আলাদা করে দিই। তবে বাবু, আমি খুব সুখি। ছেলেদের জন্য যতটুকু পারা যায় তা করার চেষ্টা করেছি। সেটা তারা বুঝতেও পেরেছে। যে কারণে আমার প্রতি তাদের কোনো অভিযোগ ছিল না। আর আলাদা করার কয়েক বছর পর আমার বলা কথাগুলোর চরম বাস্তবতা তারা উপলব্ধি করতে পেরেছিল, সমাজে দেখে। স্বীকারও করে নিয়েছিল, সিদ্ধান্ত ঠিক ছিল। তাই আমার কোনো কষ্ট নেই। কষ্ট থাকার কথাও নয়। ভগবানের আশীর্বাদে ছেলেরা আমাদের যতটুকু দেখে তাতে মন জুড়িয়ে যায়। ভগবানের কাছে সবসময় প্রার্থনা করি, আমরা সন্তানরা যেন ভালো থাকে। এছাড়া ভগবানের কাছে আমাদের দুজনের আর কোনো চাওয়ার নেই বাবু।”
জগৎসংসার সম্পর্কে দীননাথের দার্শনিক কথাবার্তা শুনে মুগ্ধ হন। এরপর কি বলা উচিৎ, তা খুঁজে পান না আমজাদ হোসেন। তিনি নিজে শিক্ষিত হয়েও জগৎসংসার সম্পর্কে এরকম রূঢ় অথচ বাস্তব সত্যকে কখনো উপলব্ধিতেই আনতে পারেননি। অথচ একজন দীননাথ, যার প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যার দৌড় পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত, সে কিনা অনায়াসেই পা-িত্যপূর্ণ কথা আর আচরণ দিয়ে সন্তানদের চরমভাবে আগলে রেখেছেন। আলাদা থাকলেও মা-বাবার প্রতি কর্তব্য-দায়িত্ব বোধ দীননাথের ছেলেরা ভুলে যায়নি। অথচ তিনি দীননাথ সম্পর্কে একটা ভুল ধারণা পোষণ করেছিলেন- তাদের পিছুটান নেই; সন্তানদের কাছ থেকেও হয়তো আশা করে না। আজ তার সে ভুল ভাঙে। দীননাথও সন্তানদের কাছ থেকে আশা করেন, তবে সেটা অন্যভাবে। আর সেজন্যই সে সুখি এবং শান্তিতেই আছে। আমজাদ হোসেন এখন বুঝতে পারলেন, দীননাথ কেন এর আগে উত্তর না দিয়ে শুধু মুচকি হেসেছিল।
দীননাথ জগৎসংসারের চরম বাস্তবতা সম্পর্কে সন্তানদের বোঝাতে সক্ষম হয়েছিল। দীননাথই তার চেয়ে জ্ঞানী এবং সমঝদার। দীননাথের সঙ্গে কথা বলার পর আমজাদের হোসেনের কেবলই মনে হচ্ছে, প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যা মানুষের মধ্যে মানবিক গুণ তৈরি করতে পারে না; শুধু গঁৎবাধা জীবন সম্পর্কে ধারণা দেয়া ছাড়া। সামাজিক বা বাহ্যিক শিক্ষা একজন মানুষকে বাস্তবতা বোধসম্পন্ন মর্যাদাবান বা ব্যক্তিত্ববান করে তুলতে পারে, যেটা প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যা পারে না।
এই যে দীননাথ অভ্যাসবশত এখনো নদীতে মাছ ধরে, এ কথা কোনো দিন কল্পনাও করেননি আমজাদ হোসেন। একটি বিষয়ে আজ সার্থক হলেন তিনি। তাহলো মনের মধ্যে সুপ্ত ইচ্ছে ছিল, দীননাথের সঙ্গে কথা বলে জগৎসংসার সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান লাভ করা। সেটা কিছুটা তিনি লাভ করতে পেরেছেন।
মাঝ নদী থেকেও মাগরিবের আজান স্পষ্ট শোনা যায়। তীরে ডিঙি ভিড়িয়ে বাড়ি ফিরতে কিছুটা সময় লাগবে। বুঝতে পারছেন, মাগরিবের নামাজটা বাড়িতেই পড়তে হবে। এ নিয়ে আফশোস নেই আজ, আমজাদ হোসেনের। যে ক্ষত তিনি এক মাস ধরে বয়ে বেড়াচ্ছেন, সে ক্ষততে আজ সামান্য হলেও প্রলেপ দেয়া গেল।
এবার দীননাথকে তীরে ডিঙি ভেড়াতে বলেন আমজাদ হোসেন। দীননাথও দেরি না করে দ্রুত তীরে ফিরেন। তারও তাড়া আছে। জাল উঠাতে হবে। তাই তীরে ফিরে আমজাদ হোসেন ডিঙি থেকে নামামাত্রই দীননাথ বলে উঠেন, “বাবু, এখন আর বসছি না। আসি, তা না হলে দেরি হয়ে যাবে।”
আমজাদ হোসেন জবাব দেন, “যাও দীননাথ। পরে আবার কথা হবে, দেখাও হবে।” এই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গেই আবার বলে উঠেন, “তোমার কাছ থেকে অনেক কিছু শেখার আছে দীননাথ।”
দীননাথ কিছুটা অবাক হন আমজাদ হোসেনের এই কথা শুনে। কিন্তু দেরি হয়ে যাওয়ার ভয়ে কথা না বাড়িয়ে ডিঙি ছেড়ে দেন।
আর তীরে দাঁড়িয়ে ডিঙি নিয়ে দীননাথের চলে যাওয়া দেখেন আমজাদ হোসেন। বৈঠার ছলাৎ ছলাৎ শব্দ কানে ভাসে। যে শব্দ এই মুহূর্তে তার মনকে দোলা দেয়, প্রশান্তি এনে দেয়। ভাবেন, কিছুটা স্বস্তি নিয়ে আজি বাড়ি ফেরা যাবে।
সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে আসে মহানন্দা নদীতে। সেতুর স্ট্রিটলাইটের আলোর ছটায় দীননাথের ডিঙি স্পষ্ট দেখা যায়। তবে বৈঠার ছলাৎ ছলাৎ শব্দ শুধু ধীরে ধীরে হারিয়ে যায়।
রচনাকাল জুন, ২০২০