সকল ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে আজ মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে পদ্মা সেতু : প্রধানমন্ত্রী

14

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতুকে বাংলাদেশের ‘গর্ব, সম্মান ও মর্যাদার প্রতীক’ আখ্যায়িত করে বলেছেন, সকল ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে বহুল প্রতীক্ষিত সেতুটি আজ প্রমত্তা পদ্মার বুকে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। তিনি বলেন, ‘আজ পদ্মার বুকে জ্বলে উঠেছে লাল, নীল, সবুজ, সোনালি আলোর ঝলকানি। ৪১টি স্প্যান যেন স্পর্ধিত বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি।’

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শনিবার সকালে মুন্সীগঞ্জের মাওয়া প্রান্তে বহুল প্রতীক্ষিত পদ্মা সেতুর উদ্বোধন উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে একথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি জানি আজকে বাংলাদেশের মানুষ গর্বিত। সেই সাথে আমিও আনন্দিত, গর্বিত এবং উদ্বেলিত। অনেক বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে এবং ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে আজকে আমরা এই পদ্মা সেতু নির্মাণ করতে সমর্থ হয়েছি। এই সেতু শুধু একটি সেতু নয়, এই সেতু দুই পাড়ের বন্ধন সৃষ্টি করেছে। এই সেতু শুধু ইট-সিমেন্ট-স্টিল-লোহার কংক্রিটের একটি অবকাঠামো নয়, এ সেতু আমাদের অহঙ্কার, আমাদের গর্ব, আমাদের সক্ষমতা আর মর্যাদার প্রতীক। তিনি বলেন, এই সেতু বাংলাদেশের জনগণের। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের আবেগ, আমাদের সৃজনশীলতা, আমাদের সাহসিকতা, সহনশীলতা আর আমাদের প্রত্যয় এবং এই জেদ যে, এই সেতু আমরা তৈরি করবই। যদিও ষড়যন্ত্রের কারণে এই সেতুর নির্মাণ দুই বছর বিলম্বিত হয়। কিন্তু আমরা কখনো হতোদ্যম হইনি, হতাশায় ভুগিনি, আত্মবিশ্বাস নিয়ে এগিয়ে চলেছি এবং শেষ পর্যন্ত সকল অন্ধকার ভেদ করে আমরা আলোর পথে যাত্রা করতে সক্ষম হয়েছি। জাতির পিতার ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের সেই অমোঘ মন্ত্র ‘কেউ দাবায়ে রাখতে পারবা না’র পুনরুল্লেখ করে তিনি বলেন, কেউ দাবায়ে রাখতে পারেনি, আমরা বিজয়ী হয়েছি।
তারুণ্যেও কবি সুকান্তের ভাষায় শেখ হাসিনা বলেন, ‘সাবাস, বাংলাদেশ, এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয় / জ্বলে পুড়ে-মরে ছারখার / তবু মাথা নোয়াবার নয়।’ আমরা মাথা নোয়াইনি, আমরা কোনো দিন মাথা নোয়াব না। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবও কখনো মাথা নোয়াননি, তিনি আমাদের মাথা নোয়াতে শেখান নাই, ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়েও তিনি জীবনের জয়গান গেয়েছেন। তিনি বাংলার মানুষের মুক্তি ও স্বাধীনতা চেয়েছিলেন এবং তাঁরই নেতৃত্বে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি।
জাতির পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করেই তার এবং তার সরকারের পথচলা উল্লেখ করে সরকারপ্রধান বলেন, তার পদাঙ্ক অনুসরণ করেই আজকে বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছে।
সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন। মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম পদ্মা সেতুর নির্মাণ বিষয়ক সূচনা বক্তৃতা করেন। তিনি প্রকল্প পরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম, উপপরিচালক কামরুজ্জামান, প্রজেক্ট ম্যানেজার অ্যান্ড সুপারভিশন কনসালটেন্ট ররার্ট জন এভিসসহ প্রকল্প বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজনের সঙ্গে অনুষ্ঠানে পরিচয় করিয়ে দেন।
প্রধানমন্ত্রী তার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের ভাষণে বলেন, পদ্মা সেতু নির্মাণ কাজের গুণগত মান নিয়ে কোনো অপোস করা হয়নি। এই সেতু নির্মিত হয়েছে বিশ্বের সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ও উপকরণ দিয়ে, সম্পূর্ণ স্বচ্ছতা বজায় রেখে। পুরো নির্মাণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে সর্বোচ্চ মান বজায় রেখে। পদ্মা সেতুর পাইল বা মাটির গভীরে বসানো ভিত্তি এখন পর্যন্ত বিশ্বে গভীরতম। ভূমিকম্প প্রতিরোধ বিবেচনায় ব্যবহৃত হয়েছে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি। এ রকম আরো বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্যের কারণে এই সেতুর নির্মাণ পদ্ধতি বিশ্বজুড়ে প্রকৌশলবিদ্যার পাঠ্যবইয়ে অন্তর্ভুক্ত হবেÑ এটা নিশ্চিত। কারণ, এটা একটা আশ্চর্য সৃষ্টি।
শেখ হাসিনা বলেন, এ বিশাল কর্মযজ্ঞ থেকে বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পেরেছেন আমাদের দেশের প্রকৌশলীরা। ভবিষ্যতে নিজেরাই এ ধরনের জটিল সেতু বা অবকাঠামো নির্মাণ করতে সক্ষম হবো আমরা। তিনি বলেন, সেতু নির্মাণ যেমন কঠিন ছিল, তেমনি আঁকাবাঁকা, খর¯্রােতা উন্মত্ত পদ্মা নদীকে শাসনে রাখাটাও একটা কঠিন চ্যালেঞ্জ ছিল। সেই চ্যালেঞ্জও সফলভাবে মোকাবিলা করে নদীর দুই পাড়কে সুরক্ষিত করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেতুর উভয় দিকে রয়েছে উন্নত ব্যবস্থাপনাসমৃদ্ধ ও দৃষ্টিনন্দন সার্ভিস এরিয়া। তিনি বলেন, মাওয়া ও জাজিরা প্রান্তে সংযোগ সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে, যা মূল সেতুকে জাতীয় সড়ক যোগাযোগ নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত করেছে। সেতুর ৪১টির মধ্যে ৩৭টি স্প্যানের নিচ দিয়ে নৌযান চলাচলের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। সেতু নির্মাণ কাজ সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়নের স্বার্থে পদ্মা নদীর উভয় পাড়ের তিন জেলাÑ মুন্সিগঞ্জ, মাদারীপুর ও শরীয়তপুরের এ পর্যন্ত প্রায় ৬ হাজার ৫৯০ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভূমি অধিগ্রহণের ফলে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর পুনর্বাসনের যথাযথ ব্যবস্থা তার সরকার নিয়েছে এবং ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারসমূহকে আবাসিক ও বাণিজ্যিক প্লট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। অতিরিক্ত সহায়তা, ভিটা উন্নয়ন সহায়তা দেয়া হয়েছে। তাদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের জন্য প্রদান করা হয়েছে কর্মমুখী ও আয়বর্ধনমূলক বিভিন্ন প্রশিক্ষণ। তিনি বলেন, প্রকল্প এলাকায় পরিবেশ ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমের আওতায় বনায়ন কর্মসূচির পাশাপাশি জীববৈচিত্র্যের ইতিহাস ও নমুনা সংরক্ষণের জন্য জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে।
সরকারপ্রধান বলেন, বহুমুখী এই সেতুর উপরের ডেক দিয়ে যানবাহন এবং নিচের ডেক দিয়ে চলাচল করবে ট্রেন। সেতু চালু হওয়ার পর সড়ক ও রেলপথে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ২১টি জেলার সঙ্গে রাজধানী ঢাকার সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হবে। তিনি আশা প্রকাশ করেন, এ সেতুকে ঘিরে গড়ে উঠবে নতুন অর্থনৈতিক অঞ্চল ও হাইটেক পার্ক। ফলে, দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট হবে এবং দেশের শিল্পায়নের গতি ত্বরান্বিত হবে। পদ্মা সেতু এশিয়ান হাইওয়ের সঙ্গে সংযোগের একটা বড় লিংক। তাই আঞ্চলিক বাণিজ্যে এই সেতুর ভূমিকা অপরিসীম। তাছাড়া পদ্মার দুই পাড়ে পর্যটন শিল্পেরও ব্যাপক প্রসার ঘটবে।
প্রধানমন্ত্রী এ সময় দেশের একজন স্বনামধন্য ব্যক্তি বিশেষের ষড়যন্ত্রে পদ্মা সেতুর অর্থায়ন বন্ধে বিশ^ব্যাংকের পদক্ষেপ এবং তাকে, তার পরিবারের সদস্যবৃন্দ এবং মন্ত্রিপরিষদ ও সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ দেয়ার অপচেষ্টাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে তা মোকাবিলার ইতিবৃত্তও তুলে ধরেন। তিনি বলেন, এই সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা পর্যায়ে চক্রান্তকারীদের মিথ্যা ষড়যন্ত্রের কারণে আমার পরিবারের সদস্য ছোটবোন শেখ রেহানা, আমার দুই সন্তান সজীব ওয়াজেদ জয় এবং সায়মা ওয়াজেদ, রেহানার পুত্র রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক, আমার অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান, সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন, সাবেক যোগাযোগ সচিব মোশাররফ হোসেন ভুইয়াসহ কয়েকজন সহকর্মী চরম মানসিক যন্ত্রণার শিকার হয়েছিলেন। আমি তাদের প্রতি সহমর্মিতা জানাচ্ছি।
প্রধানমন্ত্রী পদ্মা সেতু নির্মাণ কাজের সঙ্গে জড়িত অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীসহ যারা মৃত্যুবরণ করছেন তাদের রুহের মাগফিরাত এবং আত্মার শান্তি কামনা করেন এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান। তিনি এই সেতু নির্মাণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকল কর্মকর্তা-কর্মচারী, দেশী-বিদেশী বিশেষজ্ঞ পরার্শক, ঠিকাদার, প্রকৌশলী, প্রযুক্তিবিদ, শ্রমিক, নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত সেনাবাহিনীর সদস্যসহ সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। তিনি দেশবাসীর প্রতিও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।