সংসদে ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট পাস

35

বৈশ্বিক মহামারি করোনার (কোভিড-১৯) প্রেক্ষাপটে সৃষ্ট অর্থনৈতিক অভিঘাত সফলভাবে মোকাবলা করে চলমান উন্নয়ন অব্যাহত এবং উচ্চতর প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্য নিয়ে ২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার জাতীয় বাজেট মঙ্গলবার সংসদে পাস হয়েছে। জাতীয় সংসদে মঙ্গলবার সর্বসম্মতিক্রমে নির্দিষ্টকরণ বিল, ২০২০ পাসের মাধ্যমে এ বাজেট পাস করা হয়।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল গত ১১ জুন জাতীয় সংসদে ‘অর্থনৈতিক উত্তরণ ও ভবিষ্যত পথপরিক্রমা’ স্লোগান সম্বলিত এ বাজেট পেশ করেন। তিনি সেদিন পাওয়ার পয়েন্টে প্রস্তাবিত বাজেটের গুরুত্বপূর্ণ দিক, সরকারের পদক্ষেপ এবং বিভিন্ন খাতে বরাদ্দ প্রস্তাব তুলে ধরেন।
মঙ্গলবার বাজেট পাসের প্রক্রিয়ায় মন্ত্রীরা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের ব্যয় নির্বাহের যৌক্তিকতা তুলে ধরে মোট ৫৯টি মঞ্জুরি দাবি সংসদে উত্থাপন করেন। এই মঞ্জুরি দাবিগুলো সংসদে কণ্ঠভোটে অনুমোদিত হয়। এসব দাবির মধ্যে মঞ্জুরি দাবির যৌক্তিকতা নিয়ে বিরোধী দলের ৯ জন সংসদ সদস্য মোট ৪২১টি ছাঁটাই প্রস্তাব উত্থাপন করেন। এর মধ্যে স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ ও আইন, বিচার ও সংদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় খাতে ২টি মঞ্জুরি দাবিতে আনীত ছাঁটাই প্রস্তাবের ওপর বিরোধী দলের সদস্যরা আলোচনা করেন। পরে কণ্ঠভোটে ছাঁটাই প্রস্তাবগুলো নাকচ হয়ে যায়।
ছাঁটাই প্রস্তাবে আলোচনা করেন জাতীয় পার্টির কাজী ফিরোজ রশীদ, পীর ফজলুর রহমান, মজিবুল হক, রওশন আরা মান্নান, শামীম হায়দার পাটোয়ারী ও বিএনপির হারুনুর রশীদ। এরপর সংসদ সদস্যরা টেবিল চাপড়িয়ে নির্দিষ্টকরণ বিল-২০২০ পাসের মাধ্যমে ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট অনুমোদন করেন।
বাজেটে মোট রাজস্ব আয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সূত্রে আয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা এবং এনবিআর-বহির্ভূত সূত্র থেকে কর রাজস্ব ধরা হয়েছে ১৫ হাজার কোটি টাকা। কর-বহির্ভূত খাত থেকে রাজস্ব আয় ধরা হয়েছে ৩৩ হাজার কোটি টাকা। বাজেটে পরিচালনসহ অন্যান্য খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৬২ হাজার ৮৫৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে আবর্তক ব্যয় ৩ লাখ ১১ হাজার ১৯০ কোটি টাকা। অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ বাবদ ৫৮ হাজার ২৫৩ কোটি ও ৫ হাজার ৫৪৮ কোটি টাকা, বৈদেশিক ঋণের সুদ বাবদ ৩৬ হাজার ৯৯০ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে।
বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে ব্যয় ধরা হয়েছে ২ লাখ ৫ হাজার ১৪৫ কোটি টাকা। বাজেটে সামগ্রিক বাজেট ঘাটতি ১ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা দেখানো হয়েছে, যা জিডিপির ৬ শতাংশ। এ ঘাটতি অর্থায়নে বৈদেশিক সূত্র থেকে ৭৬ হাজার ৪ কোটি টাকা, অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ১ লাখ ৯ হাজার ৯৮৩ কোটি টাকা আহরণ করা হবে। অভ্যন্তরীণ উৎসের মধ্যে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ৮৪ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা এবং ব্যাংক-বহির্ভূত উৎস থেকে ২৫ হাজার ৩ কোটি টাকা সঞ্চয়পত্র ও অন্যান্য খাত থেকে ২৫ হাজার ৩ কোটি টাকা সংস্থানের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। বাজেটে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৮ দশমিক ২ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়া বাজেটে মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৪ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে।
২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠনের পর এটি হচ্ছে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকারের এ মেয়াদের দ্বিতীয় বাজেট। আর আর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের দ্বিতীয় বাজেট। বৈশ্বিক মহামারি করোনা পরিস্থিতিতে এবার সংক্ষিপ্ত পরিসরে বাজেট পেশ এবং পাস করা হয়।
বাজেট পাসের সময় সংসদ সচিবালয়ের ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ৮০ থেকে ৯০ জন সংসদ সদস্য বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। অধিবেশন কক্ষে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে আসন বিন্যাস করা হয়।
এর আগে গত ১১ জুন বাজেট পেশকালে বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্থফা কামাল বলেন, অর্থনীতির ওপর বৈশ্বিক মহামারি করোনার বিরূপ প্রভাব উত্তরণে সরকার একটি সামগ্রিক কর্মপন্থা নির্ধারণ করে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদে তা বাস্তবায়ন শুরু করেছে। বক্তৃতায় তিনি সরকারের নেয়া কর্মপন্থার উল্লেখ করে বলেন, এ কর্মপন্থার চারটি প্রধান কৌশলগত দিক রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে- কর্মসৃজনকে প্রাধান্য দেয়া এবং বিলাসী ব্যয় নিরুৎসাহিত করা। এছাড়া স্বল্প সুদে বিভিন্ন উৎপাদন খাতে ঋণ সুবিধা প্রদান, কর্মহীন হয়ে পড়া নি¤œআয়ের এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত জনগণকে সুরক্ষা দিতে সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের আওতা বৃদ্ধি ও বাজারে মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধি করা। এর বাইরে প্রয়োজনীয় প্রণোদনা প্রদানের ব্যবস্থাও এ বাজেটে রাখা হয়েছে। এ চারটি কর্মপন্থা বিষয়ে প্রস্তাবিত বাজেটে বিভিন্ন খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় করোনা মহামারির ফলে আর্থিক ক্ষতি মোকাবেলায় সরকারের পক্ষ থেকে নেয়া বিভিন্ন কার্যকর পদক্ষেপের কথা বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেন। বাজেটে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে মোট বাজেটের ১৫ দশমিক ১ শতাংশ, পরিবহন-যোগাযোগ খাতে ১১ দশমিক ২ শতাংশ, সুদ খাতে ১১ দশমিক ২ শতাংশ, স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন খাতে ৭ শতাংশ, ভর্তুকি ও প্রণোদনা খাতে ৬ দশমিক ৮ শতাংশ, জনপ্রশাসন খাতে ৬ দশমিক ৭ শতাংশ, প্রতিরক্ষা খাতে ৫ দশমিক ৪ শতাংশ, স্বাস্থ্য খাতে ৫ দশমিক ২ শতাংশ, সামাজিক নিরাপত্তা ও কল্যাণ খাতে ৪ দশমিক ৭ শতাংশ, জনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা খাতে ৪ দশমিক ৯ শতাংশ, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ৪ দশমিক ৭ শতাংশ, কৃষি খাতে ৩ দশমিক ৬ শতাংশ, পেনশন খাতে ৫ দশমিক ৯ শতাংশ, বিবিধ ব্যয় খাতে ৫ দশমিক ৯ শতাংশ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
বাজেটে বৈশ্বিক মহামারি করোনা (কোভিড-১৯) মোকাবেলার লক্ষে সামাজিক নিরাপত্তা, যোগাযোগ অবকাঠামো, ভৌত অবকাঠামো, আবাসন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, কৃষি, মানবসম্পদ উন্নয়ন খাতকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে।