সোমবার, ১৩ জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ২৯ পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১২ রজব, ১৪৪৬ হিজরি

Last Updated on ডিসেম্বর ১৯, ২০২৪ by

শুকতলা ক্ষয়ে আজকের প্রয়াস গড়ে তুলেছেন হাসিব হোসেন

সালটা ১৯৯৩। মানসে ছিল সমাজসেবার ব্রত। এই ব্রতকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে উঠেপড়ে লেগেছিলেন। যে মায়ের হাত ধরে হাঁটতে শিখেছিলেন, সেই মমতাময়ী মা-ই আবারো হাত বাড়িয়ে দেন সন্তানের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে। ছেলের হাতে ধরিয়ে দেন ২ হাজার টাকা। আজকের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে ওই ২ হাজার টাকা মূল্য বিচার করা সম্ভব নয়। কিন্তু শুরুটা ওই ২ হাজার টাকা দিয়েই।
মায়ের দেয়া ২ হাজার টাকাকে পুঁজি করে সামাজিক উন্নয়নের যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন তিনি। আগপাছ না ভেবে। চালু করেন বিভিন্ন সামাজিক ও অর্থনৈতিক কর্মসূচি; যেমন- অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, ওয়াটার অ্যান্ড স্যানিটেশন, সঞ্চয় ও ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি ইত্যাদি। তাও মাত্র তিনজন কর্মী নিয়ে। আর এখন সহস্রাধিক কর্মীর ঠিকানা এটি।
এতক্ষণ যার কথা বলা হচ্ছিল, তিনি আর কেউ নন; তিনি হলেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার কৃতী সন্তান হাসিব হোসেন- প্রয়াস মানবিক উন্নয়ন সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক। প্রতিষ্ঠিত ঠিকাদার ব্যবসায়ী প্রয়াত আনসার হোসেনের সন্তান হাসিব হোসেন পারতেন অন্য পেশায় জড়িয়ে নিজেকে উচ্চতর পর্যায়ে নিয়ে যেতে। কিন্তু তিনি শুধু নিজেকেই গড়তে চাননি, পাশাপাশি চেয়েছিলেন কর্মসংস্থান সৃজন করতে। আজকের প্রয়াস তার অন্যতম উদাহরণ। এই নিয়ে বিশদ ব্যাখ্যারও প্রয়োজন পড়ে না।
তবে ১৯৯৩ সাল থেকে প্রয়াসের পথচলা শুরু হলেও এর ভিতটা হাসিব হোসেনের মনের ভেতর গড়ে উঠেছিল ১৯৮৮ সালে। গল্পটা একটু বলা যাক।
সেবার সারাদেশ বন্যাকবলিত হয়েছিল। সেই বন্যায় জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হয় চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ সারাদেশের। বন্যায় মানুষের দুর্ভোগের হাহাকার ছুঁয়ে গিয়েছিল সেই সময় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত হাসিব হোসেনকে। তখনকার হালকা-পাতলা গড়নের সেই মানুষটি কয়েকজন তরুণকে নিয়ে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার ও অসহায় মানুষদের সেবা ও সাহায্যে এগিয়ে আসেন। বিভিন্ন সংগঠন ও বিত্তশালী ব্যক্তিদের কাছ থেকে খাদ্য, বস্ত্র, ওষুধ সংগ্রহ করে তা বিতরণ করেন। কোনো সাংগঠনিক কাঠামো ছাড়ায় তাদের এই কার্যক্রম সেই সময় সকলের কাছে প্রশংসিত হয়। আর এভাবেই ভবিষ্যৎ ‘প্রয়াস মানবিক উন্নয়ন সোসাইটি’ গঠনের বীজ মনের মধ্যে রোপিত হয় ত্রাণকার্যে নেতৃত্ব দেয়া হাসিব হোসেনের মনে।
প্রয়াস গড়ে তোলার শুরুতে সঙ্গে নিয়েছিলেন তিনজন কর্মীকে, যাদের প্রথমে বেতন দেয়া হয়েছিল মাত্র ১৫০ টাকা। আর এখন তার কর্মীবাহিনীর সংখ্যা সহস্রাধিক। শুরুতে নিজেই সাইকেলের প্যাডেল ঘুরিয়ে স্যান্ডেলের শুকতলা ক্ষইয়েছেন। তবু দমে যাননি কর্মোদ্যমী এই মানুষটি।
তখনকার প্রয়াস আর আজকের প্রয়াসের মধ্যে ব্যবধান অনেক। তবে এটা তো অনস্বীকার্য যে, শুরুটা ভালো না হলে আজকের ‘প্রয়াস’ গড়ে উঠতে পারত না। ‘প্রয়াস’ এখন শুধু একটি সংস্থার নামই নয়, চাঁপাইনবাবগঞ্জে একটি ব্র্যান্ড হিসেবে দাঁড়িয়েছে, এ কথা জোর দিয়ে বলা যায়।
সৃজনশীল এই মানুষটির হাতে গড়া প্রয়াসের আর্থসামাজিক উন্নয়ন কর্মসূচি যে টেকসই উন্নয়নে অবদান রাখছে তার উদাহরণ মেলে চাঁপাইনবাবগঞ্জের গ্রামীণ এলাকায় নজরকাড়া বিভিন্নমুখী সামাজিক উন্নয়নের ধারা চোখে পড়লে। তার দক্ষতা ও দূরদর্শিতার ফলে প্রয়াস চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার গণ্ডি ছাড়িয়ে অন্য জেলাতেও বিস্তৃত হয়েছে। প্রযুক্তিবান্ধব হাসিব হোসেন প্রয়াসকে আগলে রেখেছেন সন্তানের মতো, বটবৃক্ষের ছায়া হয়ে। প্রয়াসের এই উন্নয়ন যাত্রা কখনোই ভেঙে পড়ার নয়। এখানে রয়েছে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও সুশাসনের চর্চা, যা এই প্রতিষ্ঠানকে বহুযুগ পর্যন্ত দীর্ঘস্থায়ী করবে।
প্রয়াস চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ দশের বিভিন্ন প্রান্তে আর্থসামাজিক উন্নয়নে যে ভূমিকা রেখে চলেছে, তা কোনো দিনই হারিয়ে যাবার নয়। জনগণের জীবনযাত্রার সাথে শেকড়ায়ন হয়ে গেছে এর। প্রয়াস কোথায় কোথায় বা কোন কোন ক্ষেত্রে কাজ করছে? এ প্রশ্ন এখন অবান্তর। বরং কোন ক্ষেত্রে কাজ করছে না- সেটা প্রশ্ন না করে খুঁজে বের করাই ভালো।
মহামারি কোভিড-১৯ বা করোনা ভাইরাস মোকাবিলায়ও মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিল প্রয়াস। অনুদান দিয়েছিল প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলেও, যা পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) তহবিলে জমা দেয়ার মাধ্যমে প্রদান করা হয়েছিল। এটাও সম্ভব হয়েছিল সৃষ্টিশীল এই মানুষটির জন্য।
সংস্কৃতিমনা মানুষ হাসিব হোসেন শুধু প্রয়াস মানবিক উন্নয়ন সোসাইটি গড়ার মধ্য দিয়ে থেমে থাকেননি। সহযোগী সংগঠন হিসেবে গড়ে তুলেছেন- প্রয়াস ফোক থিয়েটার ইনস্টিটিউট (পিএফটিআই), জেলার একমাত্র কমিউনিটি রেডিও রেডিও মহানন্দা, প্রয়াস হসপিটাল, প্রয়াস ডায়াবেটিক কেয়ার, প্রয়াস ফার্মা, প্রয়াস এগ্রো, প্রয়াস সুপার শপ, উদ্যোক্তা উন্নয়নে অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ‘ধামা.কম.বিডি’, গবাদিপশু উন্নয়নে খামার, কৃষি পণ্যের ভ্যালুচেইনে কাজ করতে ফ্যাক্টরি এবং সফটওয়্যার ও প্রযুক্তি উন্নয়নে প্রয়াস আইটি ইত্যাদি।
প্রয়াস ফোক থিয়েটারের কার্যক্রম সারাদেশব্যাপী বিস্তৃত হয়েছে এবং সরকারি বিভিন্ন জনসচেতনতামূলক প্রচার কার্যক্রমে প্রায় নিয়মিত অংশ নিচ্ছে। আর রেডিও মহানন্দা তো জেলার হেঁসেলঘর পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। ‘রেডিও মহানন্দা’কে চেনাবার জন্য এখন বিশেষণ ব্যবহার করতে হয় না।
নিজেও স্বাস্থ্য সচেতন। স্বাস্থ্য ঠিক থাকলে অর্থনীতির চাকা ঠিক থাকবে- এই মূলমন্ত্রে বিশ্বাসী হাসিব হোসেন। তাই প্রয়াসের উপকারভোগীদের স্বাস্থ্যসেবার পাশাপাশি আলাদাভাবে প্রয়াস হসপিটালও গড়েছেন।
প্রয়াস মানবিক উন্নয়ন সোসাইটি সফলতার ৩১ বছর পেরিয়ে আজ ৩২ বছরে পথচলা শুরু করল। জয়তু প্রয়াস মানবিক উন্নয়ন সোসাইটি। আগামীতে এভাবেই মানুষের কল্যাণে কাজ করে এই জেলার পাশাপাশি সারা বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে কাজ করে যাবে- এটাই এখন অনেকের প্রত্যাশা।

 

About The Author

শেয়ার করুন