মোস্তাক হোসেন
অন্নদাশঙ্কর রায় তাঁর ‘শোকাশ্রু’ প্রবন্ধে বলেছেন, ‘পঁচিশে মার্চের ঘটনার পর থেকে আমার মনকে এই বলে শান্ত রেখেছিলাম যে, কাঁদবার সময় এটা নয়; এটা লড়বার সময়। লড়ছে যারা তাদের লড়তে সাহায্য করতে হবে। বল যোগাতে হবে। নিজেকে শক্ত হতে হবে। আগে তো যুদ্ধ শেষ হোক, দেশ মুক্ত হোক, তারপরে নিহতের জন্য শোক।’
পাকিস্তানি সামরিকজান্তারা পঁচিশে মার্চের শোক কাটিয়ে ওঠার সময় দিতে না দিতে বা শোক সহ্য করতে না করতেই পুনরায় আরো একটি স্থায়ী শোকসাগরে ভাসিয়ে দিল নারকীয় হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে। পরাজয়াসন্ন অবস্থায় বাংলার মুক্তিকামী জনগণকে চিরতরে মেধাশূন্য করে রাখতে উদ্গ্রীব হয়ে উঠে পাকহানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসররা। এই সোনার বাংলা ছেড়ে যাবার প্রাক্কালে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলার বিনির্মাণে বাঙালিরা যেন আত্মনিয়োগ করতে না পারে বা বাংলাদেশের পুনর্গঠন বাধাগ্রস্ত হয়, সেই উদ্দেশ্যে বাংলার শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হত্যা করে পঙ্গু করতে চেয়েছিল। বাংলার বীরসন্তানদের অপ্রতিরোধ্যতার কাছে পরাজিত হয়ে ঘৃণিত, নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটায়। যার ভয়াল চিত্রের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, কালের সাক্ষী হিসেবে রায়ের বাজার শহীদ বুদ্ধিজীবী বধ্যভূমিসহ বাংলাদেশের অন্যান্য বধ্যভূমি।
পাকিস্তান সৃষ্টিলগ্ন হতে দুটি ভূখণ্ডের মধ্যে ব্যাপক বৈষম্য পরিলক্ষিত হতে থাকে। পশ্চিম পাকিস্তান সকল প্রশাসনিক কার্যক্রমে তাদের একচ্ছত্র প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। আর এ কারণে পূর্ব পাকিস্তানের জনগোষ্ঠী অর্থাৎ বাঙালিরা চরমভাবে শাসিত ও শোষিত হচ্ছিল। যদিও দুই পাকিস্তানের ক্ষেত্রে ভূখ-ের হিসেবে বাংলাদেশের জনসমষ্টি বেশি এবং ভাষা ও সংস্কৃতি আলাদা বা ভিন্ন। কিন্তু ধর্মের মোড়কে বেঁধে এক করার অপচেষ্টা। এরপরও ভাষা ও সংস্কৃতির ভিন্নতা সত্ত্বেও একই ধর্মের কারণে বাংলার জনগণ তাদেরকে সাদরে গ্রহণ করেছিল। অথচ পশ্চিম পাকিস্তানিদের মধ্যে ভারতবর্ষ পৃথকীকরণের সুচনালগ্ন থেকে রাষ্ট্র পরিচালনার পরিবর্তে সা¤্রাজ্যবাদ প্রতিষ্ঠার মনোভাব দেখা দেয়, একেবারে ব্রিটিশ সা¤্রাজ্যবাদীর কায়দায়। দীর্ঘমেয়াদি শোষণের দুরভিসন্ধি চিন্তা-ভাবনায় বাঙালিদের সংস্কৃতি ধ্বংসের লক্ষে পাকিস্তানে একভাষা প্রচলনের নামে এ দেশে বাংলা ভাষার পরিবর্তে উর্দু ভাষা চালুর ঘোষণা দেয়। এতে তারা উভয় দিকেই লাভবান হবার আশা করতে থাকে এই ভেবে যে, এক. বাঙালিদের নতুন ভাষা আয়ত্ত করতে অসুবিধার কারণে প্রশাসনিক কার্য পরিচালনার ওজুহাতে পশ্চিম পাকিস্তানিদের বেশি বেশি করে নিয়োগ দেয়া যাবে, দুই. বাঙালির সংস্কৃতির বাহক বাংলা ভাষার প্রচলন কমে যাবার ফলে পশ্চিম পাকিস্তানিদের শাসন-শোষণ করার সুবিধাসহ সা¤্রাজ্যবাদ প্রতিষ্ঠা সহজ হবে।
পশ্চিম পাকিস্তানিদের দুষ্টুচক্রের এ আভাস বাংলার শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীরা ঠিকই আঁচ করতে পেরেছিলেন। পশ্চিম পাকিস্তানিদের অভিলাষ যেন সফল না হয়, সেইজন্য এ দেশের সকল স্তরের জনগণ বাংলা ভাষা রক্ষার জন্য মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর রাষ্ট্রভাষা উর্দুর ঘোষণার পর প্রতিবাদ শুরু হয়। এই প্রতিবাদ এক সময় ভাষা আন্দোলনে রূপ নেয় এবং পরবর্তীতে ১৯৫২ সালে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার ও শফিউরের রক্তের বিনিময়ে দেশের জনগণ ফিরে পায় প্রাণের মাতৃভাষা বাংলা। মাতৃভাষা আন্দোলনের পর বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে পশ্চিম পাকিস্তানিরা এ দেশের জনসাধারণের অধিকার খর্ব করে শোষণ করতে থাকে। এরই প্রেক্ষিতে এ দেশের বুদ্ধিজীবীরা তাদের শোষণের বিরুদ্ধে বাঙালিদের একত্রিত করে প্রতিবাদ জানাতে আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করতে থাকে। সেই গঠিত আন্দোলনগুলো হলো- ১৯৫৪ সালে শাসনতন্ত্রের বিরুদ্ধে, ১৯৫৬ সালে সংবিধান প্রণয়নের বিরুদ্ধে, ১৯৬২ সালে শিক্ষা আইনের বিরুদ্ধে।
১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলনের দাবি ছিল বাংলার ন্যায্যতার দাবি। এই দাবির পরবর্তী রূপই মূলত স্বাধীনতা। ছয় দফার দাবি উত্থাপিত হয় লাহোর প্রস্তাবেরই ভিত্তিতে। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ব্রিটিশ সা¤্রাজ্যবাদিতার মনোভাব থেকে সরে আসতে পারেনি। তাদের চিন্তা-ভাবনায় আসে যে, বাঙালির নেতৃত্বদানকারীদের জেল-জুলুম করে ভয়-ভীতি প্রদর্শন করলে আমাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার সাহস জোগাবে না। সেই মোতাবেক ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র’ মামলার মাধ্যমে বাঙালির অধিকার রক্ষা আদায়ের নেতৃত্বদানকারীদের রাষ্ট্রদ্রোহী সাজিয়ে গ্রেপ্তার করে। এতে বাঙালি ছাত্র সংগঠনসহ সকল স্তরের জনগণ ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানের ডাক দেয়। গণঅভ্যুত্থানে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বেকায়দায় পড়ে যায় এবং তাদের দায়ের করা আগরতলা মামলা প্রত্যাহার করে নেয়। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের ফলে পাকিস্তানি সামরিক সরকার চাপের মুখে পড়ে ১৯৭০ সালে নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়।
১৯৭০ সালের নির্বাচনের জন্য বাংলাদেশের সকল রাজনৈতিক দল তাদের প্রতিনিধি নির্বাচনে নির্বাচনী কার্যক্রম চালাতে থাকে। বাংলার আপামর জনগণ মনেপ্রাণে উপলব্ধি করেছিল যে, এই নির্বাচনে বাঙালিরা জয়ী না হলে পশ্চিম পাকিস্তানিদের নির্যাতন হতে রেহায় বা পরিত্রাণ পাওয়া যাবে না। ১৯৭০ সালের পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠ বিজয়ী দল হিসেবে ১৬৭ আসনে জয়লাভ করে মোট ৩১৩ আসনের মধ্যে। কিন্তু বাঙালির বিশাল বিজয়ে পাকিস্তানের সামরিক সরকার ও পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ বিচলিত হয়ে পড়ে যে, তারা কোনোমতে বিজয়ী বাঙালি রাজনৈতিক নেতৃত্বের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা যাবে না। এরূপ অবস্থায় পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী একটি কুচক্রে জাল ফাঁদতে থাকল। সত্তরের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ৭ ডিসেম্বর, অথচ মার্চ মাস পর্যন্ত তারা ক্ষমতা হস্তান্তর না করে বাংলাদেশের জনগণকে কিভাবে দমিয়ে রাখা যায় তার নীলনকশা আঁকতে থাকে। নীলনকশামাফিক মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলি খানের নেতৃত্বে ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চলাইট নামের হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে নিরস্ত্র বাঙালিকে নির্বিকারে হত্যা করে। নিরস্ত্র বাঙালিদের হত্যা করার মধ্যদিয়ে বাংলার জনগণকে ভয় দেখিয়ে চুপ করানো মি. রাও খানের অপরারেশন সার্চলাইটের উদ্দেশ্য ছিল না। মি. রাও খান চেয়েছিল, পশ্চিম পাকিস্তানির দোসর বাহিনীর তালিকাকৃত ২০ হাজার গণতন্ত্রমনস্ক বাংলার বুদ্ধিজীবীদের গভর্নর হাউজে ডেকে হত্যার মাধ্যমে বাঙালিদের গণতন্ত্র চর্চার পথ রোধ করা। মি. রাও খানের পরিকল্পনা সফল হয়নি বটে, কিন্তু তার অপারেশন সার্চলাইট পরিচালনা করার মধ্যদিয়ে প্রতিবাদী ক্ষমতা ধ্বংস করার অভিপ্রায় সফল করতে চেয়েছিল।
বাংলার মুক্তিকামী জনগণ শোষকগোষ্ঠীর নির্যাতনে দমে না গিয়ে আরো প্রবল শক্তি সঞ্চয় করে তাদের প্রতিহত করতে থাকে। বাঙালির অপ্রতিরোধ্যতা দেখে বাংলার বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত ব্যক্তিবর্গ নিধনে মনোনিয়োগ করতে থাকল। কারণ তারা বুঝতে পেরেছিল যে, বাংলার গণতন্ত্রমনস্ক বুদ্ধিজীবীরা এ দেশের জনগণের নেতৃত্ব দিচ্ছে এবং এঁদের ধ্বংস করতে পারলেই আর বাঙালি মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। অপরদিকে ২৫ মার্চ কালরাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বন্দি করলে অন্যান্য রাজনৈতিক ব্যক্তি সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন। সেখানে প্রবাসী সরকার গঠনে করে পশ্চিম পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য মুক্তিবাহিনী গঠন করেন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। পাশাপাশি এ দেশ থেকে যাওয়া বিপুল শরণার্থীদের ব্যবস্থা করাও একটি বড় চ্যালেঞ্জ। বহির্বিশ্বের সাথে কূটনৈতিক তৎপরতা চালায় এবং অভ্যন্তরের গণতন্ত্রমনস্ক বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে যোগাযোগ চলতে থাকে।
প্রবাসী সরকারের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ চলতে থাকে এবং যুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তানিদের পরাক্রমশালী আক্রমণকে প্রবল বেগে প্রতিহত করতে করতে এগিয়ে যেতে থাকে বাংলার সূর্যসন্তানরা। মুক্তিবাহিনীর অপ্রতিরোধ্য আক্রমণে তারা হিমশিম খেতে থাকে। বাংলা মাকে শত্রুমুক্ত করতে মরণপণ যুদ্ধ চালিয়ে যায় মুক্তিকামী এ দেশের সূর্যসন্তানরা। প্রায় নয় মাস যুদ্ধ করতে হয়েছিল শোষকদের বিরুদ্ধে। এই অবিরাম যুদ্ধে বাংলার বীরসন্তানরা পশ্চিম পাকিস্তানি ও তাদের দোসর বাহিনীর অবর্ণনীয় ও নিষ্ঠুর নির্যাতন উপেক্ষা করে এগিয়ে যেতে থাকে। বাঙালির এই অপ্রতিরোধ্যতাকে মানতে পারছিল না পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক সরকার ও তাদের দোসররা। শোষকগোষ্ঠী ও তাদের দোসরদের কথা এই মুক্তিপাগল বাঙালিদের মধ্যে সঞ্চার করছে বাংলার শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীরা। সুতরাং বাঙালিদের নির্জীব করতে হলে অবশ্যই বুদ্ধিজীবীশূন্য করা জরুরি। তাদের পরিকল্পনাতেই ছিল বুদ্ধিজীবীশূন্য করা। কিন্তু ২৫ মার্চ কালরাত হতে পরাজিত হবার আগ পর্যন্ত নির্বিকারে বাঙালিদের হত্যা করেও বাংলার বীরসন্তানদের দমাতে না পেরে মেধাশূন্য করার অভিপ্রায়ে ব্যাপকাকারে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে। সবচেয়ে বেশি সংখ্যক বুদ্ধিজীবীকে ১০-১৪ ডিসেম্বরে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ও তাদের দোসররা নির্মমভাবে হত্যা করেছিল।
আজ ১৪ ডিসেম্বর, সেই গভীর শোকের দিন ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস’। এই দিনে তাঁদেরকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি।
মোস্তাক হোসেন : কলাম লেখক ও শিক্ষক, আলীনগর উচ্চ বিদ্যালয়, চাঁপাইনবাবগঞ্জ