ভারতে করোনা ভাইরাস লকডাউনের মধ্যে দেশের বারো কোটিরও বেশি মানুষ তাদের চাকরি বা কাজকর্ম হারিয়েছেন বলে একটি জরিপে বলা হচ্ছে।
দেশের প্রথম সারির থিংকট্যাঙ্ক ‘সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকোনমি’র গবেষণা জানাচ্ছে, শুধু এপ্রিল মাসেই ভারতে ১২ কোটি ২০ লাখ মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছেন, যার বেশির ভাগই ছিলেন দিনমজুর কিংবা ছোটখাটো ব্যবসায় কর্মরত শ্রমিক। খবর বিবিসির।
অর্থনীতিবিদরাও সতর্ক করে দিচ্ছেন, এই কর্মহীন মানুষের সংখ্যা দিনে দিনে আরো বাড়বে এবং শুধু শহরে নয়, এর মারাত্মক প্রভাব পড়তে চলেছে ভারতের গ্রামীণ অর্থনীতিতেও।
দুই মাস আগে গোটা ভারতজুড়ে যখন আচমকা লকডাউন জারি করা হয়েছিল, মাত্র চার ঘণ্টার নোটিশে কার্যত থেমে গিয়েছিল অর্থনীতির চাকা।
আবাসন শিল্পে কর্মরত লাখ লাখ শ্রমিক, রাস্তার পাশে ছোটখাটো দোকানের কর্মী, ঠেলাওয়ালা বা রিকশাওয়ালা- সবার রুটিরুজি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল রাতারাতি।
ভারতের নামী গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকোনমি’ বা সিএমআইই-র জরিপ বলছে, এপ্রিলের শেষেই দেশে এই ধরনের কাজ হারানো লোকের সংখ্যা গিয়ে ঠেকেছে প্রায় সোয়া বারো কোটিতে।
পেটে ভাত নেই এই কর্মহীনদের
সিএমআইই-র প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মহেশ ব্যাস বলছিলেন, “এই যে বারো কোটি বিশ লাখ মানুষের হাতে কাজ নেই- এদের একটা বিরাট অংশ, অন্তত ৯ কোটি ১০ লাখ মানুষের আজ কাজ না থাকলে পরের দিনের ভাত জোটে না।”
তিনি বলেন, “ফলে দেশের জনসংখ্যার একটা বিশাল অংশ এখন চরম দারিদ্র্য আর অনাহারের সম্মুখীন। ভাইরাসের বিপদের সঙ্গে এই সংখ্যাটার তুলনা করলে আমাদের কিছু অপ্রিয় সিদ্ধান্ত নিতেই হবে।”
“আর শুধু এই অসহায় মানুষগুলোই নয়, বহু বড় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানও পরিস্থিতি সামলাতে পারছে না, যারা এতকাল বাঁধাধরা মাইনে পেয়ে এসেছেন, তাদের ওপরেও কিন্তু আঘাত আসছে”, বলেন মহেশ ব্যাস।
লকডাউনের জেরে ভারতে মারুতি বা মাহিন্দ্রার মতো অটোমোবিল জায়ান্টের কারখানায় উৎপাদন যেমন থেমে গেছে, তেমনি দিল্লিতে মল কিংবা রাস্তার পাশে চায়ের দোকান, সাপ্তাহিক হাটবাজার সবই বন্ধ হয়েছে।
কোটি কোটি অভিবাসী শ্রমিক বাধ্য হয়ে রওয়ানা দিয়েছেন গ্রামের দিকে, যাদের জন্য এ দিনও সরাসরি আর্থিক সাহায্য দাবি করেছেন বিরোধী দল কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট সোনিয়া গান্ধী।
সরকারের উদ্দেশে এক ভিডিও বার্তায় তিনি বৃহস্পতিবার (২৮ মে) দাবি জানিয়েছেন, “গরিব মানুষের অন্তত দুশো দিনের কাজের অধিকার এখন নিশ্চিত করা দরকার, যাতে তাদের রুটিরুজি জোটে।”
সোনিয়া গান্ধী আরো বলেছেন, “ছোট ও মাঝারি ব্যবসাগুলোকে সাহায্য করে এখনই কোটি কোটি চাকরি বাঁচানো উচিত।”
বস্তুত ভারতে হোটেল, অ্যাভিয়েশন তথা পর্যটন ও পরিষেবা শিল্প যেমন ধুঁকছে, তেমনি নির্মাণ বা অটোমোবিল শিল্পেও লাখ লাখ কর্মী ও শ্রমিকের ওপরেও ঝুলছে চাকরি হারানোর খাঁড়া।
চাপ পড়বে গ্রামীণ অর্থনীতিতেও
এর পাশাপাশি উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতিবিদ সঞ্চারী রায় মুখার্জি বলছেন, অসংগঠিত খাতের কোটি কোটি শ্রমিক গাঁয়ে ফিরে আসায় গ্রামীণ অর্থনীতিও অবধারিত সংকটে পড়তে যাচ্ছে।
অধ্যাপক রায় মুখার্জির কথায়, “এই যে অভিবাসী শ্রমিকরা ফিরে আসছেন তারা কেউ হয়তো আবাসন নির্মাণে যুক্ত ছিলেন, কেউ হয়তো মুম্বাই বা দিল্লিতে জরির কাজ করতে গিয়েছিলেন। কিন্তু তাদের বেশির ভাগই অসংগঠিত খাতের, তাতে কোনো ভুল নেই।” “আর মৌলিক অর্থনীতির পাঠ বলে, এদের ফিরে আসা মানেই গ্রামীণ অর্থনীতির ওপর চাপ বাড়া। মানে ধরুন, কোনো পরিবারের যদি এক টুকরো চাষের জমি থাকে, সেখানে এখন দুজনের জায়গায় পাঁচজন কাজ করবে”, বলেন তিনি।
অর্থনীতিবিদ সঞ্চারী বলেন, “আর এরা প্রচুর সংখ্যায় ফিরে এসেছেন এবং আগামী এক-দেড় বছরের মধ্যে তারা যে কাজের জন্য শহরে আর ফিরতে চাইবেন না সেটাও নিশ্চিন্তে বলা যায়।”
“ফলে যদি অনাবৃষ্টি, ঘূর্ণিঝড় বা পঙ্গপালে ফসলের কোনো ক্ষতি নাও হয়, তারপরও কিন্তু দেখা যাবে কৃষিখাতে চাহিদার চেয়েও বাড়তি শ্রমিক থাকবে। আর তাতে তাদের মজুরিও কমবে”, সতর্ক করে দিচ্ছেন সঞ্চারী রায় মুখার্জি।
ফলে ভারতে লকডাউন দুই দিন বা দুই মাস পরেই উঠুক, শহরে বা গ্রামে অর্থনীতির চাকাকে আবার সচল করে তোলা এর মধ্যেই একটা দুঃসাধ্য চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে।
ভারতে ওয়ার্কিং পপুলেশন বা কর্মরত জনসংখ্যার ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ এর মধ্যেই কাজ হারিয়েছেন, এই সংখ্যা শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে ঠেকে বিশেষজ্ঞরা উদ্বেগের সঙ্গে সে দিকেই তাকিয়ে আছেন।