মঙ্গলবার, ৩ ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১৮ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৩০ জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি

Last Updated on নভেম্বর ১০, ২০২৪ by

রুঢ় বাস্তবতার কবি আবু তালেব মোল্লা

ড. ইমদাদুল হক মামুন

বাস্তবতার কবি, জীবনের কবি, দিনযাপনের কবি আবু তালেব মোল্লা। জীবনের ছোটখাটো ঘটনাগুলোর সাথে মেধা মনন ও মানসিকতার একটা সম্মিলন ঘটিয়েছেন তিনি তার প্রায় কবিতায়। প্রকৃতির ছোটখাটো ঘটনাগুলোর সাথে জীবনের একটা মেলবন্ধন ঘটানোর চেষ্টা যেমন করেছেন; তেমনি কখনো ঘরকন্নার টুকিটাকি বিষয়ের সাথেও জীবন কীভাবে জড়িত সেটা তুলে ধরেছেন। শীতের সকালের রোদ, বসন্তের অভিযোগ, ডায়েরিতে পঞ্চাশ টাকা লিখে রাখা, মুড়ির সাথে নিজের জীবনের প্রতি ভালোবাসা, বয়স বাড়ার সাথে সাথে টিকে থাকার জন্য। নিজের ক্ষমতার পরিধি সংক্ষিপ্ত করে ফেলা, আলমারিতে সংসার জীবনের সুখ-দুঃখ গেঁথে রাখা, হাঁটতে হাঁটতে না পাওয়ার বেদনাগুলো সঙ্গীর কাছে তুলে ধরাÑ এমনি আরো কত কি! মনের গহীনে জীবনের কত অব্যক্ত রব, কত আশা একা একা বছরের পর বছর ধরে থেকে যায়। জীবনের এসব ঘটনাগুলো যেন নীরব আবহ সংগীতের মতই আষ্টেপৃষ্ঠে থাকে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার রামচন্দ্রপুর গ্রামে ৯ জ্যেষ্ঠ, ১৩৬৯ বঙ্গাব্দ অনুসারে ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ মে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা খোশ মোহাম্মদ মোল্লাহ্ ও মাতা হাজেরা বেগম। পিতা হরিমোহন সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষক ছিলেন। শৈশবে তিনি পরিবারের সঙ্গে নবাবগঞ্জ শহরে বসবাসের জন্য চলে আসেন। শিক্ষাজীবন শুরু হয় এই শহরেই। সরকারি মডেল প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক, হরিমোহন সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক এবং নবাবগঞ্জ সরকারি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ১৯৮১ সালে ভর্তি হন। এ বিষয়ে বিএ (অনার্স) এবং এমএ পাস করেন। এই সময়ে অনুষঙ্গ সাবজেক্ট হিসেবে দর্শন ও বাংলা ভাষা ও সাহিত্য অধ্যয়ন করেন।
১৯৯০ সালে গ্রামীণ ব্যাংকে তার কর্মজীবন শুরু হয়। চলে ২০১৬ সালের অক্টোবর মাস পর্যন্ত। চাকরি থেকে অসময়ে অবসর নিয়ে রাজশাহী শহরে বাস করছেন। চাকরিতে থাকাকালীন তিনি বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় সমাজের তৃণমূল জনগোষ্ঠীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে কাজ করার সুযোগ পান। এটি বোধহয় তার একটি মূল্যবান অভিজ্ঞতা।
ছাত্রজীবনে তিনি বাম ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার তিনি স্বপ্ন দেখেন এবং সেভাবে নিজেকে প্রস্তুত করেন। জীবিকার প্রয়োজনে তাকে চাকরিতে যেতে হয়। আশির দশকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের একজন কর্মী হয়ে সকল আন্দোলন-সংগ্রামের কর্মসূচিতে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালীন সাংগঠনিক কাজে যুক্ত থেকে সংগঠনকে শক্তিশালী করার জন্য মেধা ও শ্রম ব্যয় করেছেন। এই সময়গুলোয় তিনি বেশ কিছু কবিতা লিখেন কিন্তু বন্ধুদের পড়ে শোনানো বা পড়ানো ছাড়া প্রকাশের কোনো চেষ্টা করেননি। সেইসব সংরক্ষণেও নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে লেখা দুটি এবং কলেজে পড়ার সময়ে লেখা একটি কবিতা স্মৃতি থেকে সংক্ষিপ্তভাবে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থে স্থান পায়। সেগুলো হলো- ‘ফিলিস্তিন হায় ফিলিস্তিন’, ‘কংক্রিটের দেয়াল’ এবং ‘অসমাপ্ত বাগান’।
সাহিত্যের প্রতি তার অনুরাগ ছোটবেলা থেকেই। স্কুলজীবনে গল্প উপন্যাস পড়ার ঝোঁক ছিল। লেখারও ইচ্ছে পোষণ করতেন। একবার একটা গল্প লিখতে শুরু করেন, কিন্তু শেষ করেননি। গল্পটা বাবার হাতে গেলে তিনি লিখতে উৎসাহিত করেন। কিন্তু যে কবিতা লিখবে, সে কেন গল্প লিখবে! তাই হয়তো জীবনের মতোই গল্প অসমাপ্ত থেকে গেছে। পিতার সঙ্গে তার বাম চিন্তাভাবনা নিয়ে একটা মতবিরোধ ছিল। কিন্তু পিতাপুত্রের শ্রদ্ধা ও স্নেহ, আশ্রয় ও আস্থার জায়গাটি আজীবন উভয়ের অত্যন্ত কোমল এবং অটুট থেকেছে। যাহোক, দশম শ্রেণীতে পড়ার সময় কাজী নজরুল ইসলাম রচিত ‘সিন্ধু’ কবিতার ক্লাসে তার সাহিত্যের ঝোঁক কবিতার দিকে মোড় নেয়। ক্লাস নিচ্ছিলেন স্বয়ং পিতা খোশ মোহাম্মদ মোল্লা। একনিষ্ঠ মনোযোগে সেদিন তিনি কবিতা বোঝার চেষ্টা করেন। এবং কবিতা তাকে ভীষণভাবে আলোড়িত করে, তিনি কবিতার প্রেমে পড়েন।
২০১৬ সালে মেহেরপুরে কর্মরত থাকাকালে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ বিদীর্ণ উপত্যকার পঙক্তিমালা একুশে বইমেলায় মিহির মজিদ ছদ্ম নামে প্রকাশ হয়। এরপর দীর্ঘশ্বাস ও তার প্রমিত অনুবাদ, অস্মিতা, সেদিনও বৈরী বাতাস ছিল, অনাবৃতা ও অন্যান্য কবিতা, তুমি শীর্ষক সেমিনার, চিত্রলেখার পত্রপাঠ প্রকাশ হয়। প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে আরো কিছু গ্রন্থ।
মানুষের মন, তার পরিবর্তনের সাথে প্রকৃতির পরিবর্তনকে কবি তার কবিতার বড় একটা অনুষঙ্গ হিসেবে ব্যবহার করেছেন। মানুষের আচরণিক পরিবর্তনের মাঝেও কবি প্রকৃতিকে ব্যবহার করেছেন। সূর্য ওঠা এবং ডোবা দিয়ে জীবনের পতন আর উত্থানকে বিশ্লেষণ করেছেন। আকাশের রঙের পরিবর্তন সাধারণত একটা সাময়িক পরিবর্তন। এটা সাধারণত সূর্য আর মেঘের খেলা মাত্র। কিন্তু এই স্বাভাবিক ও সাময়িক পরিবর্তনকে কবি সাধারণ পরিবর্তন হিসেবে নেননি। তিনি দেখেছেন আকাশের রঙ যখন বদলায়, সে সময় মানুষের মনেরও রঙও বদলায়। কখনো শাড়ি, কখনো চাদর, কখনো ঠোঁটের লিপস্টিকের রঙ, কত কিছুর সাথেই তিনি এই উদার রঙিন আকাশকে ব্যবহার করেছেন।
একটা হাহাকার, না পাওয়ার বেদনা, হারানোর শূন্যতা ফুটে উঠেছে কবিতার ছত্রে ছত্রে। কিন্তু তারপরেও বিশ শতকের শূন্যতাবোধ থেকে এটি সম্পূর্ণ আলাদা। এখানে হতাশা নেই, ব্যর্থতা বোধও নেই, কিন্তু আছে না পাওয়ার কষ্ট; যা বৃষ্টির মতো ঝরে পড়েছে কবির কাব্যে। কষ্টটা মূর্ত হলেও কিন্তু অসাধারণ উপমায় বর্ণিতÑ “বৃষ্টিভেজা পাতায় যেমন ঝরে পড়ে রোদ”। দুর্দান্ত উপমা। বলতে পারি, লেখকের লেখার ঢং একেবারে ভিন্ন। খুব সাবলীলভাবে অসাধারণ ব্যঞ্জনাময় পঙক্তি তিনি রচনা করে গেছেন। যেমন “কিছু সময়কে উড়িয়ে দিয়ে হাতে কলম নিয়েছি, চক্রবাল আলোর নীচের কথাগুলো গুছিয়ে নেওয়া দরকার। তলব করেছিল যে,  স্রোতের ফেনা সামলে সে এখন সমুদ্রের মুখ দেখে।”, “মগজ গিলে খায় গনগনে রোদ।” প্রভৃতি।
জীবনের প্রান্তে এসে পাওয়া আর না পাওয়ার হিসাব কষছেন। জীবনের ব্যর্থতাগুলো এসে উঁকি দিচ্ছে বারবার। এটা মানুষের স্বাভাবিক আচরণ। কিন্তু জীবন তো আর মসৃণ রাস্তা নয়! সুন্দর নির্মল জীবনের জন্য তার আকাক্সক্ষা বারংবার রিনিঝিনি করে বাজতে থাকে কবিতার পাতায় পাতায়। শুধু কবিতার পাতায় বললে ভুল হবে, হয়ত জীবনেও। এভাবে সেভাবে ইনিয়ে বিনিয়ে পদ্মার শীতল পানি ছোঁয়া, বিশুদ্ধ ঠা-া বাতাসের পরশ পাওয়া, এই নির্মল সময়কে এনে কবি প্রতিস্থাপন করতে চান অবিশ্বাসের এই সময়ে। তিনি হেরে যাচ্ছেন বারবার সময়ের কাছে। অতীতের সোনালী দিনগুলোর মধুর সময়কে ফিরিয়ে আনার নিশ্চিত ব্যর্থ প্রচেষ্টা। সমুদ্রের মতো বিশাল হওয়ার ব্যর্থ প্রচেষ্টা। সেখানেও কবি সুন্দর সময়কে খুঁজে পাওয়ার ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। মেলা ফুরিয়ে যায় কবিতায় কবির যেন সেই আকুলতা। শুধু তাই নয়, মানুষের চেতনাকে ভর করে সেই সোনালী জীবনটা ফিরে পেতে চাইছেন অগোচরে। বর্তমান প্রেক্ষিতও উঠে এসেছে কবিতায়। নীতি নৈতিকতা বিসর্জনের যে রাজনীতি বর্তমানে প্রচলিত, সেদিকটায় তীক্ষè দৃষ্টি দিয়েছেন। সমাজে, রাষ্ট্রে দুর্নীতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, সবকিছু শেষ করে দিচ্ছে, নির্মূল করে দিচ্ছে দেশের সম্পদ। একদিকে দেশের অবস্থা অন্যদিকে ব্যক্তিজীবন বা স্বর্ণালী সময়Ñ এ দুইয়ের টানাপোড়েন চলছে কবিতার পঙক্তিতে পঙক্তিতে।
কবি বিশ্বাস করেন, যেখানে শিল্পীর বসবাস, সেখানে খুন হতে পারে না। কিন্তু একুশ শতক যে জঙ্গমের শতক! এখানে যে সেই শীতল বাতাসের বড্ড অভাব। বিশ্বাসের বড্ড অভাব। ভালোবাসার বড্ড অভাব। এটা মেনেই নিতে পারছেন না কবি। এই জীবন তিনি চান না। কিন্তু জীবিকার তাগিদে হয়ত সেই ধূসর জগতে তাকে ফিরতেই হয়। সেই ফেলে আসা সুন্দর বিশুদ্ধ আনন্দঘন দিন কবি ফিরে পেতে চান তার চেতনায় ও বাস্তবতায়। এ সমাজ, এ পরিবেশ, এ মানুষ, এ প্রেম, এ ভালো লাগা, এ বন্ধুত্ব সবকিছু। কিন্তু কেউ যে কথা রাখে নাÑ যুগে এসে পড়েছেন তিনি, না বোষ্টমি, না সময়, না কাল, না তার পাত্রগুলো! এখন যে চারপাশে খুনি, ভূমিদস্যুতা অবিশ্বাসীদের আনাগোনা অনেক বেশি। আজ বাজেভাবে শব্দগুলোও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। লেখকদের লেখাগুলোও পদলেহনে ব্যস্ত। সেখানে কোনো সৃষ্টি নেই, কোনো দায়িত্ব নেই। নির্লজ্জ চাটুকারিতার আবরণে আজ বিবেক জড়িয়ে আছে! কবি চান না, এই বিবেকহীন পদলেহনে ব্যস্ত নপুংসকের বাজে জগৎ। এখান থেকে বের হয়ে আসাই যেন তার একমাত্র সাধনা। কবিতার ছত্রে ছত্রে বারবার ঘুরে ফিরে এসেছে সেই ব্যাকুলতা। সুন্দর একটা পৃথিবী পাওয়ার ব্যাকুলতা। যেখানে সবাই অনাসৃষ্টিতে ব্যস্ত, সেখানে কবি তার জগতকে সুন্দর, নির্মল, বিশ্বাসের জগৎ করে তুলতে চাইছেন। মানুষের রুচির দুর্ভিক্ষ তৈরি হয়েছে এখন। সৃজনশীলতা বহুদূর। স্থূল চিন্তায় মশগুল সমাজ। কবি দেখছেন ভবিষ্যৎ সমাজকে। রুচি এবং সংস্কৃতির দুর্ভিক্ষ তৈরি হয়ে গেছে অথবা হতে যাচ্ছে আমাদের সমাজে; আজ, নয়ত কাল। তখন গোটা সমাজের শৈল্পিক চেতনা সমাধিস্থ হবে। পুঁজিবাদী সমাজের প্রধান অবলম্বন আগ্রাসী চেতনা। সেই আগ্রাসী চেতনারই এক দেশের ফলাফল অন্য দেশ বা অন্য জাতিকে ধ্বংস করা। তারই মহড়া যেন চলছে পৃথিবীতে। কতটা বীভৎস পরিস্থিতি বর্তমান পৃথিবীতে, তারই ছোট্ট একটা চিত্র কবি তুলে ধরেছেন তার কবিতায় অত্যন্ত সাবলীলভাবে। আবার মানুষ যখন বয়সের ভাটিতে যেতে থাকে তখন তার মধ্যে মৃত্যু চেতনা বাসা বাঁধে। স্বাভাবিক চিরন্তন এ বিষয় থেকে রবীন্দ্রনাথ বা জীবনানন্দ দাশের মতো কবিকেও মৃত্যু চেতনা গ্রাস করেছে।
দিন যাপন, ইতিহাস, ঐতিহ্যক, প্রেম, সময়, মৃত্যুচিন্তা, ছোট ছোট আবেগ, ভালো লাগা, সমাজ, রাষ্ট্র এখানে এক সূত্রে গাঁথা হয়ে গেছে। ছোট ছোট পঙক্তিতে অনেক গভীরের চেতনাকে তিনি সংস্থাপন করেছেন এ কাব্যগ্রন্থে। সব কবির কাছ থেকে উপাদান নিয়েও তিনি এক স্বতন্ত্র ভাবনার জন্ম দিয়েছেন, এখানেই কবির পা-িত্য, এখানেই তিনি আলাদা।

ড. ইমদাদুল হক মামুন : শিক্ষক, লেখক ও গবেষক

About The Author

শেয়ার করুন