রুটিন করে লোডশেডিং দেয়ার পরামর্শ প্রধানমন্ত্রীর

10

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে সীমিত পরিসরে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে সরকার লোডশেডিং দিতে বাধ্য হচ্ছে। এ ব্যাপারে সকলের সহযোগিতাও প্রত্যাশা করেন তিনি ।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা প্রতিটি ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিয়েছি। কিন্তু এখন আমাদের লোডশেডিং দিতে হবে এবং বিদ্যুতের উৎপাদন সীমিত করতে হবে কারণ, আমাদের বিদ্যুতের ভর্তুকির পরিমাণ বহুগুণ বেড়ে গেছে।’
শেখ হাসিনা বুধবার চুয়েট ক্যাম্পাসে এক অনুষ্ঠানে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘চুয়েট শেখ কামাল আইটি বিজনেস ইনকিউবেটর’ নামে দেশের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসভিত্তিক আইটি বিজনেস ইনকিউবেটর উদ্বোধনকালে এ কথা বলেন। এদিন গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে প্রধানমন্ত্রী চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ব¦বিদ্যালয়ে শেখ জামাল ডরমিটরি এবং রোজী জামাল ডরমিটরি’র ও উদ্বোধন করেন।
প্রধানমন্ত্রী দেশবাসীকে তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী বিদ্যুৎ সংরক্ষণের আহ্বান জানানোর পাশাপাশি এলাকাভিত্তিক নির্দিষ্ট সময়ভিত্তিক লোডশেডিংয়ের জন্য একটি রুটিন তৈরি করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন। তিনি বলেন, ‘কোন এলাকায় কত সময় লোডশেডিং দেয়া হবে তার একটি রুটিন তৈরি করুন। কারণ, জনগণ যেন সেজন্য প্রস্তুত হতে পারে এবং তাদের দুর্ভোগ কমানো যায়।’
অনুষ্ঠানে ‘চুয়েট শেখ কামাল আইটি বিজনেস ইনকিউবেটর’র ওপর একটি অডিও-ভিডিও প্রমাণ্যচিত্র প্রদর্শিত হয়।
অনুষ্ঠানে আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক স্বাগত বক্তৃতা করেন। সঞ্চালনা করেন আইসিটি বিভাগের সিনিয়র সচিব এনএম জিয়াউল আলম।
প্রধানমন্ত্রী রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী তেল, এলএনজি, ডিজেলসহ সবকিছুর দাম বেড়েছে এবং আমেরিকা ও ইউরোপের রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের কারণে পরিস্থিতির যে অবনতি ঘটছে তা উপলব্ধি করে দেশবাসী সরকারকে এ লক্ষে সহায়তা করবে বলে আশা প্রকাশ করেন।
তার সরকার বর্তমানে বিদ্যুৎ খাতে মোট ২৮ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিচ্ছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো চালু রাখার জন্য গ্যাসের চাহিদা মেটাতে এলএনজি আমদানিতে আমাদেরকে ২৫ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হবে।’ বর্তমান বাজেটে ৮৪ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি বরাদ্দ রাখা হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ভর্তুকি না কমালে সরকার টাকা কোথা থেকে পাবে।’
প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং রাশিয়ার ওপর আমেরিকা ও ইউরোপের নিষেধাজ্ঞার ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাঁচামালের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে এবং সরকারকে কী পরিমাণ ভর্তুকি বাড়াতে হয়েছে তারও একটি পরিসংখ্যান তুলে ধরেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রতি কিউবিক মিটার এলএনজি ক্রয়ে সরকারের ব্যয় ৫৯ দশমিক ৬০ টাকা। কিন্তু আমরা সেটা গ্রাহকদের কাছে বিক্রি করছিলাম মাত্র ৯ দশমিক ৬৯ টাকায়। যেটা সম্প্রতি ১১ টাকায় উন্নীত করা হয়েছে। তারপরও বিশাল অঙ্কের ভর্তুকি রয়ে গেছে সেখানে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে প্রতি ইউনিটে উৎপাদন ব্যয় ১২ দশমিক ৮৪ টাকা কিলোওয়াট ঘণ্টা, কিন্তু একক প্রতি পাইকারি মূল্যে আমরা দিচ্ছি ৫ দশমিক ০৮ টাকায়। ফার্নেস ওয়েলের প্রতি একক ইউনিটের উৎপাদন ব্যয় হচ্ছে ১৭ দশমিক ৪১ টাকা, সেটাও আমরা ৫ দশমিক ০৮ টাকায় দিচ্ছি। ডিজেলে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় ৩৬ দশমিক ৮৫ টাকা, সেখানেও আমরা ৫ দশমিক ০৮ টাকা দরে বিদ্যুৎ বিক্রি করছি। কয়লা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় ১২ দশমিক ৩৭ টাকা, কিন্তু বিক্রি হচ্ছে ৫ দশমিক ০৮ টাকায়। অর্থাৎ সারা বিশ্ব এখন একটা ভয়াবহ পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছে।

তাঁর সরকারকে জনগণের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার মত মৌলিক চাহিদাগুলোর জোগান দেয়ার পর আবার কৃষিতেও ভর্তুকি দিয়ে এত বিশাল অংকের ভর্তুকি আর কতদিন দেয়া সম্ভব হবে সে প্রশ্নও তুলে সবাইকে মিতব্যয়ী ও সঞ্চয়ী হওয়ার আহবান পুণর্ব্যক্ত করেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, যদিও জাতিসংঘের মহাসচিবের উদ্যোগে একটা চ্যাম্পিয়ন গ্রুপ হয়েছে। সেখানে আমি সদস্য হিসেবে আছি। সেখানে আলোচনা হয়েছে, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য এবং সার যাতে আনতে দেয় সে বিষয়ে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু নিষেধাজ্ঞা এবং সুইফট বন্ধ করার কারণে আমরা ডলার দিয়ে রাশিয়া বা ইউক্রেন থেকে জিনিস কিনতে পারছি না। কাজেই ফাইন্যান্সিয়াল ম্যাকানিজম যে কী হবে এটার উত্তর কেউ দিতে পারেনি।

অতীতে সরকার পরিবর্তন হলেই উন্নয়ন কাজের ধারাবাহিকতা নষ্ট হওয়ার যে রীতি দেশে প্রচলিত রয়েছে তা যেন আর না হয় সেটাও দেখার জন্য তিনি সকলের প্রতি আহ্বান জানান।
তার সরকার যে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তুলছে তার ফলাফলটা এ দেশের নতুন প্রজন্ম পাবে এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে আজকের উদ্যোক্তা তৈরিতে শেখ কামাল বিজনেস ইউকিউবেটর স্থাপনকেও তিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে বর্তমানে সারাদেশে ৯২টি হাইটেক পার্ক / সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক / আইটি ট্রেনিং অ্যান্ড ইনকিউবেশন সেন্টার স্থাপনের কাজ চলমান রয়েছে। ইতোমধ্যে ৯টি পার্ক স্থাপনের কাজ সমাপ্ত হয়েছে। দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়নের জন্য ৬৪ জেলায় শেখ কামাল আইটি ট্রেনিং অ্যান্ড ইনকিউবেশন সেন্টার স্থাপন করা হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা মোবাইল এবং ল্যাপটপ উৎপাদনে সহায়ক ১৫৬টিরও বেশি যন্ত্রাংশের ওপর ১ শতাংশ হারে আমদানি শুল্ক হ্রাস করে দিচ্ছি। ফলে, বিশ্বের খ্যাতনামা ব্র্যান্ডের ১৫টি কোম্পানির মোবাইল ফোনসেট আমাদের দেশেই তৈরি হচ্ছে এবং ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ লেখা মোবাইল ফোন ও ল্যাপটপ দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। তিনি বলেন, আগামীতে গার্মেন্টস পণ্যের সাথে আমাদের ডিজিটাল ডিভাইসও সমানতালে বাংলাদেশে উৎপাদন এবং রপ্তানি হবে। আর রপ্তানি খাতে আগামীতে এটাই হবে একটি উল্লেখযোগ্য পণ্য, যেটা রপ্তানি করে আমরা অনেক বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারব। আর সে লক্ষ্য নিয়েই তার সরকার কাজ করে যাচ্ছে এবং সমগ্র বাংলাদেশেরই সেভাবে প্রতিষ্ঠানও গড়ে তুলছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম কোনোভাবেই যেন আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকে পিছিয়ে না থাকে সেভাবেই আমরা তাদের প্রযুক্তি শিক্ষার ব্যবস্থাটা করছি। তিনি বলেন, যে সমস্ত অবকাঠামো আমরা তৈরি করছি তা হবে আগামী প্রজন্মের মেধা, বুদ্ধি, জ্ঞানের বিকাশ কেন্দ্র এবং তাদের জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও দেশপ্রেমের ওপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠবে জাতির স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ। জাতির পিতা সেই উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ দেখে যেতে না পারলেও তার সেই স্বপ্ন পূরণই আমাদের দায়িত্ব।