শুক্রবার, ১১ জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ২৭ আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ১৫ মহর্‌রম, ১৪৪৭ হিজরি

Last Updated on জুন ১৩, ২০২৫ by

রাজশাহীতে ২ দফা ম্যারাথন সভার পরও আড়তদার-চাষির পরস্পরকে দোষারোপ

চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার কানসাট বিশ্বনাথপুর গ্রামের আমচাষি মিজানুর রহমান সকাল সাড়ে ৭ টায় কানসাট আম বাজারে ১২ ভ্যানে ২’শ মণ আম নিয়ে এসেছেন। ২ ঘণ্টা ধরে বসে থাকলেও কোনো ক্রেতা ভিড়ছেনা। এতগুলো আম এখন কি করবেন তার মাথায় আসছেনা। চিন্তিত মনে তাকিয়ে আছেন আমের দিকে। ২ ঘণ্টা পর একজন বেপারী আসলেও দাম বলছেন গতকালকের থেকে মণে ৫শ টাকা কম। আবার ৫২ কেজিতে মণ ধরে আম নিতে চাচ্ছেন। বুধবার রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ের নতুন নিয়মের কথা বলতেই সে বেপারী রেগে চলে গেলেন।
ক্ষোভের সাথে মিজান এ প্রতিবেদককে বলেন, আমের ভরপুর সময়ে জেলার আমকে ধ্বংস করার জন্য একটি গ্রুপ উঠে-পড়ে লেগেছে। এ আম এখন চাষীর গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি উল্টো প্রস্তাব দেন এসব নিয়ে নাটক বাদ দিয়ে ১০ বছর আগে যেভাবে ৪৫ কেজিতে মণ ধরে আম বিক্রি হতো সেটায় চালু হওয়া দরকার। যত এ নিয়ে চাপাচাপি হবে, ততই চাষি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
দিনাজপুর জেলার একটি বাগান থেকে ২ ভ্যান আম নিয়ে আসা কানসাটের অপর চাষী মনিরুল ইসলামও একই সুরে কথা বলেন। তিনি জানান, একদিকে ওজন জটিলতা নিয়ে ইদুর বিড়াল খেলা, অন্যদিকে আমের সরবরাহ বাজারে বেশি হওয়ায় দাম কম। তাই বাধ্য হয়ে যে দামই হোক আম বিক্রি করতেই হবে।
এ অবস্থা শুধু এ ২ চাষির নয়, কানসাটে অবস্থান করা প্রায় ৩শ চাষিসহ পুরো জেলার বিভিন্ন বাজারের আম চাষিদের।
গত ৫ জুন বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে আমের ওজন জটিলতা ও কমিশন নিয়ে আলোচনা ভেস্তে যাবার পর গত বুধবার আবারো দিনব্যাপি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। আড়তদারদের দরকষাকষির পর বিকেলে সর্বসম্মতিক্রমে ৪০ কেজিতে মণ ধরে আম কেনাবেচা এবং আড়তদারদের কেজি প্রতি দেড় টাকা কমিশন দেয়ার মাধ্যমে গত বৃহস্পতিবার থেকে রাজশাহী বিভাগের সব বাজারে আম কেনাবেচার সিদ্ধান্ত হয়।
রাজশাহীর বানেশ্বর, চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাট, শিবগঞ্জ, ভোলাহাট ও রহনপুর এবং নওগাঁর সাপাহারের আম আড়তদার সমিতির নেতারা, আমচাষি, ব্যবসায়ী, বিভিন্ন উপজেলার উপজেলা নির্বাহী অফিসার এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জের জেলা প্রশাসকের উপস্থিতিতে এ সিদ্ধান্ত হয়।
সভার সিদ্ধান্তটি স্থানীয়ভাবে মাইকে প্রচার করে সে মোতাবেক সবাইকে আম কেনা-বেচার আহবানও জানানো হয়। কিন্তু বৃহস্পতিবার বাজার পরিস্থিতি ছিল ঠিক উল্টো। রাজশাহীতে সিদ্ধান্ত সব পক্ষ মেনে নিলেও চাষি-ব্যবসায়ী ও আড়তদার একে অপরকে দায়ী করছেন।
ওজনের নামে কোনো আম নেয়ার কথা না থাকলেও চাষিদের অভিযোগ প্রতিবার ওজনের সময় একটি করে আম নেয়া হচ্ছে। কেজি প্রতি দেড় টাকা কমিশন নেয়ার পরও ৪০ কেজির বেশি আম চাওয়া হচ্ছে। অন্যথায় এক ভ্যানের ৪ ডালির মধ্যে ২ ডালি আম বেছে বাদ দেয়া হচ্ছে।
এদিকে বিভাগীয় কমিশনারের নেতৃত্বে এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসন, কৃষি বিপণন অধিদপ্তর ও বাজার মনিটরিং টিম মাঠে থাকার কথা থাকলেও কাউকে চোখে পড়েনি আমবাজারগুলোতে। অন্যদিকে অনিয়ম বা হয়রানি হলে তাৎক্ষণিকভাবে প্রশাসনকে জানানোর আহবান জানানো হলেও কেউ অভিযোগও জানাতে যায়নি।
এদিকে জেলার বিভিন্ন বাজারগুলোতে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, আড়তদারগণ যে যার মতো আম কিনছেন। আমচাষিরাও অনেকটা জিম্মি হয়ে আম দিতে বাধ্য হচ্ছেন। ভোলাহাট আমবাজারে ৫২ কেজিতে মণ ধরে আম কেনা-বেচা হয়েছে।
গোমস্তাপুরের রহনপুর আমবাজারে ৫০-৫২ কেজিতে মণ ধরে আম কেনা-বেচা হয়েছে। দেশের বৃহত্তম কানসাট আমবাজারে ৫২ কেজিতে মণ ধরে আম কেনা হচ্ছে এবং ৫২ কেজির জায়গায় ৪০ কেজির হিসেবে ৬০ টাকা কমিশন নেয়া হচ্ছে। বুধবার এ বাজারে ১০ টাকা কমে খিরসাপাত ৪০ থেকে ৫০ টাকা কেজি, লক্ষণভোগ ৩ টাকা কমে ১২ থেকে ১৭টাকা, গুঠি জাতীয় ১০টাকা থেকে ১৫টাকা কেজি দরে কেউ কেউ কিনেছেন। তবে বেশিরভাগ আড়তদার ৫২ কেজিতে মণ ধরে খিরসাপাত ২৪০০/২৮০০ টাকা, ল্যাংড়া আম ২০০০ থেকে ২২০০টাকা , লখনা আম ৮০০ থেকে ১০০০ টাকা দরে কেনাবেচা করেছেন।
দীর্ঘদিনের পুরাতন নিয়ম বাদ দিয়ে নতুনভাবে আম কেনা-বেচায় সময় প্রয়োজন দাবি করে আম ব্যবসায়ী ও আমচাষী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবু তালেব জানান, চাষীদের প্রশাসনের নির্দেশণা মোতাবেক আমের কোয়ালিটি ভেদে ৩ টি শ্রেণীতে ভাগ করতে হবে এবং ৩ ভাবে বিক্রি করার মানষিকতা থাকতে হবে। গড় ওজন করে দাম করলে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আর চাষি-আড়তদার সবাইকে উদারভাবে একে অপরের সহযোগী মনে করে ব্যবসা করতে হবে। নয়ত এর সুফল মিলবেনা।
গোমস্তাপুর উপজেলা আম আড়তদার সমিতির সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন দাবি করেন, সরকারের দেয়া নিয়ম মেনে ব্যবসা করতে পারলে করবেন, নয়ত ব্যবসা গুটিয়ে নিবেন। কারণ আড়তঘরের ভাড়া, বিদ্যুৎ বিল ও কর্মচারীর বিলসহ যে খরচ রয়েছে তা এ নিয়মে উঠানো কঠিন। তাছাড়া ৪০ কেজিতে মণ ধরে আম কিনে ঢাকার পাটির কাছে আম পৌছানোর পর ৩৫ কেজি হলে ৫ কেজি আম কে দিবে? এতে করে উত্তরবঙ্গ থেকে সব ক্রেতা দক্ষিণ বঙ্গে চলে যাবে। ক্ষতিগ্রস্ত হবে কৃষক।
রাজশাহী বিভাগের আড়তদার সমিতির আহবায়ক ও কানসাট আড়তদার সমিতির সভাপতি আবু তালেবের ভাষ্য, কৃষকের স্বার্থ রক্ষা করে তারা সব সিদ্ধান্ত মেনে নিলেও উল্টো চাষিরায় এখন সে নিয়ম মানতে চাইছেনা। যা দুঃখজনক।
শিবগঞ্জ উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ও আম উদ্যোক্তা শহিদুল হক হায়দারী বলেন, রাজশাহী বিভাগীয় প্রশাসনের এই উদ্যোগ কৃষক, বিক্রেতা ও ক্রেতা সকলের স্বার্থ রক্ষায় একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। কিন্তু এখন বাজারের যে অবস্থা তা দুঃখজনক। তিনি দাবি করেন, কানসাটে কিছুটা নিয়ম মানা হলেও জেলার বাইরের ক্রেতারা এ এলাকার কিছু ব্যবসায়ীর ইন্ধনে নওগার সাপাহারে অন্তত ১০-১২ টি ছোট ট্রাক নিয়ে আম কিনতে গেছে। এতে করে চাঁপাইনবাবগঞ্জের আম শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
শিবগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার আজাহার আলী জানান, ৪০ কেজিতেই মণ এবং কেজি প্রতি দেড় টাকা কমিশনের বাইরে কোনো আম নেয়া যাবে না। বাড়তি চার্জ বা অতিরিক্ত আম নেয়ার বিধান ধরেই আমবাজার পরিচালিত হবে। সিদ্ধান্তগুলো সর্বজনীনভাবে সব জেলায় কার্যকর হবে, যাতে বাজারে স্বচ্ছতা, ন্যায্যতা ও সুষ্ঠু বাণিজ্য পরিবেশ বজায় থাকে। আর এর জন্য জেলা প্রশাসক আব্দুস সামাদ বলেন, রাজশাহীর সভায় আম সংশ্লিষ্টরা যেভাবে চেয়েছেন সেভাবেই বাজার পরিচালিত হচ্ছে। এর ব্যতয় হবার সুযোগ নাই।
প্রসঙ্গত গত ৫ জুন ও ১১ জুন ২ দফা বৈঠকের পর সর্বসম্মতিক্রমে রাজশাহী বিভাগে একই পদ্ধতি হিসেবে ৪০ কেজিতে মণ ধরে এবং কেজি প্রতি দেড় টাকা কমিশন চার্জ নেয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

About The Author

শেয়ার করুন