শনিবার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ২৯ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১১ জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি

Last Updated on জুন ১২, ২০২৪ by

মা দিবসে আত্মোপলব্ধি

জাহাঙ্গীর সেলিম

১২ মে ছিল মা দিবস। পত্রপত্রিকায় ও অন্যান্য গণমাধ্যমে প্রতিবছর দিবসটির তাৎপর্য তুলে ধরা হয়। অবশ্য গণমাধ্যমের কল্যাণে প্রায় প্রতিদিন কোনো না কোনো দিবসের উপস্থিতি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় এবং দিবস পালনের সংখ্যাও অনেক। একদিনে একাধিক দিবসের উপস্থিতিও লক্ষণীয়। এই যে এতসব দিবস পালন করা হোক বা না হোক এর উদ্দেশ্য, আদর্শ, মর্মবাণী জনজীবনে কোনো প্রভাব ফেলতে কী পরিমাণে সক্ষম হয়েছে? যেমন ধরা যাক জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি হলো ধূমপান। কিন্তু স্বপ্রণোদিত স্বেচ্ছায় তামাক সেবনের কুফল সম্বন্ধে অবহিত হয়ে ক’জন এসব বদ অভ্যাস ত্যাগ করেছে, সেটি এক বড় প্রশ্ন? দেশীয় ও বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর তামাক উৎপাদন শুধুমাত্র ধূমপানের উপকরণ হিসেবে সীমাবদ্ধ নেই। জর্দা, খইনি, গুলসহ নানা ধরনের উৎপাদিত পণ্য জনস্বাস্থ্যের জন্য অনেক সময় জীবনমরণের প্রশ্ন জড়িত। ফলে জেনেশুনেই মানুষজন বিষপান করছে। যদিও বছরে একটি তামাকবিহীন দিবস রয়েছে। তবে আবেদন একদম বৃথা যায় না, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাব পড়ে। গ্রামে-গঞ্জে দেখা না গেলেও শহুরে কিছু ধূমপায়ীদের জনগণের উপস্থিতিতে কিছুটা ইতস্ততবোধ করতে দেখা যায়। তবে বক্ষ্যমাণ লেখাটি তামাক বিষয়ক নয়। মা দিবস সম্বন্ধে কিছু লিখতে গিয়ে প্রসঙ্গক্রমে উক্ত বিষয়টি উল্লেখ করা হলো।
মা দিবসের গুরুত্ব, তাৎপর্য বা প্রয়োজনীয়তা সর্বজনীন, দেশ ভেদাভেদ এখানে ধর্তব্যের মধ্যে পড়ে না। যদিও দিবসটি পশ্চিমা জগৎ থেকে উদ্ভাবিত হয়ে ধীরে ধীরে বিশ^জনীনে পরিণত হয়েছে, তবে এর গুরুত্ব অপরিসীম এবং আত্মোপলব্ধি করার বিষয়। পশ্চিমা জগতের অনেক কিছু আমরা সাদরে গ্রহণ করেছিÑ অনেকটা জেনে বা না জেনে। যদিও বিশ^ায়নের পর আমাদের মতো তৃতীয় বিশে^র অনেক দেশ তাদের চাপিয়ে দেয়া আকাশ সংস্কৃতির প্রভাবে হাজার বছরের আমাদের লালিত সংস্কৃতি, মূল্যবোধ এবং জীবনধারায় প্রভূত পরিবর্তন বিস্তার লাভ করেছে। সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিপর্যয়ের সাথে মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটেছে এ প্রজন্মের। এসবের প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়Ñ পোশাক পরিচ্ছদে, পথেঘাটে চলাফেরা, খাওয়া-দাওয়া, কথাবার্তা, বয়োজ্যেষ্ঠদের সাথে আচার ব্যবহারে বেপরোয়া ভাব। আমাদের সমাজজীবন ছিল সামাজিক বন্ধনে পরস্পরের সাথে আবদ্ধ, সহযোগিতা, সহমর্মিতা, বিপদে আপদে একে অন্যের সহায় এবং সুখ-দুঃখ ভাগাভাগির পাশাপাশি আমাদের গর্বের একান্নবর্তী পরিবারে জন্মের পর থেকে ছেলেমেয়েদের ¯েœহ-আদরে বড় হয়ে ওঠার সুযোগ। হায়রে একান্নবর্তী পরিবারÑ এখন শুধুই কল্পনায়। একান্নবর্তী পরিবারে কর্ত্রী ছিলেন বয়োজ্যেষ্ঠ হিসেবে দাদী/নানী বা পরিবারের বড় বৌ। সেই ব্যবস্থা বিদেশী সমাজতাত্ত্বিক/মনোবিদদের কাছে ছিল পরম বিস্ময়ের এবং তাদের মনের মধ্যে ধিক্কারও জন্মাত। আমাদের পারিবারিক বা সমাজব্যবস্থা সে রকম ছিল, কিন্তু কালের আবর্তে বা সমাজ বিবর্তনের সাথে আমাদের গর্ব করার মতো পারিবারিক বন্ধন হারিয়ে গেল।
বিশ^ায়ন শুরুর পর থেকে সামষ্টিক বিষয়ের পরিবর্তে ব্যক্তিগত বিষয়াদি প্রাধান্য লাভ করতে থাকে। বিশ^ায়ন পুঁজিবাদের অপর নাম। পুঁজিবাদ মানুষকে আত্মকেন্দ্রিক, ভোগবাদী ও মুনাফালোভীতে পরিণত করেছে। পরিবারগুলোর বিচ্ছিন্নতা এক নির্মম উদাহরণ, মা বাবা, ভাই বোন, সন্তান বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। পাশ্চাত্যের অনুকরণ করে আমরাও বৃদ্ধদের বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে মুক্তি খোঁজার চেষ্টা করছি। যদিও এ রকম আশ্রমের সংখ্যা দেশে অনেক কম এবং শহরে সীমাবদ্ধ। নগণ্য সংখ্যক এ ধরনের হতভাগ্য আশ্রমে থেকে পরিবার-পরিজনদের অপেক্ষায় দিন গুণে, এই বুঝি কেউ তার খোঁজখবর নিতে এসেছে। পাশ্চাত্য দেশগুলোতে ছেলেমেয়েরা যুবা বয়সেই পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একলা চলার পথ অনুসরণ করে, কালেভদ্রে বা অকস্মাৎ বয়সের ভারে ন্যুব্জদের সাথে ছেলেমেয়েদের ক্ষণিকের জন্য দেখা হয়।

আশ্রমে অবস্থানকারীদের কী করুণ চিত্র পত্রপত্রিকার বিভিন্ন প্রতিবেদন থেকে টের পাওয়া যায়। ঈদের মতো খুশির দিনেও আপনজনদের দেখা মেলে না। বিপরীতে অনেকে পরিবারের সাথে থেকেও উপেক্ষিত। কয়েক মাস আগে পত্রিকার মাধ্যমে জানা যায়- মাথাগোঁজর ঠাঁয় বসতবাটি করায়ত্ত করার কৌশল হিসেবে তার মেয়ে অন্য এক মৃত বয়স্কা মহিলাকে নিজের মা দাবি করে বিলাপ শুরু করে কবরস্থ করা হয়। ঘটনার কিছুদিন পর উক্ত মহিলা নিজের ডেরায় ফিরে আসার পর পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র উদ্ঘাটিত হয়। হরহামেশায় দেখা যায়, বৃদ্ধ বাবা বা মায়ের ভরণপোষণ ও পরিবারে আশ্রয় না দিয়ে রাস্তায় ফেলে যাওয়া এখন গা-সওয়া হয়ে গেছে। অন্যদিকে অনেকে পরিবারের সাথে থেকেও উপেক্ষিত, দেখাশোনা করা দূরে থাক সময়মত খাওয়া-দাওয়া পায় না। অসহায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের কিছু সম্বল থাকলেও বিপদ না থাকলে করুণ ভবিতব্য অপেক্ষা করে। তবে ঢালাও অভিযোগ ঠিক নয়, মানবতার দিকও রয়েছে। এসব সহায় সম্বলহীনদের জন্য সরকারের কিছু সহযোগিতা প্রদানের সুবিধা থাকলেও প্রকৃত ভুক্তভোগীরা প্রায় সময় বঞ্চিত।
এতসব অনাচার ও সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিরাজমান সামাজিক ক্ষতের বিপরীতে এক ব্যতিক্রমধর্মী মা দিবস পালনের বর্ণনা করে লেখাটি শেষ করছি। চলতি বছরে মা দিবস সরবে বা নীরবে চলে গেল। পত্রপত্রিকায় শিক্ষিত ও প্রতিষ্ঠিত ছেলেমেয়েদের বিচিত্র অভিব্যক্তি মুদ্রিত হতে দেখা যায়। এক দশক আগে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান অভিজাত হোটেলে নিজেদেরকে জাহির করার লক্ষে ঘটা করে শহুরে কিছু রতœগর্ভা মায়েদের সম্মাননা প্রদান করতে দেখা গেছে, এখন আর দেখা যায় না। তবে এ ধরনের আয়োজন ছিল সমাজের উচ্চবিত্তের মধ্যে সীমাবদ্ধ। পিছিয়েপড়া গ্রামীণ বা প্রান্তিক পর্যায়ে লাখ লাখ মহিলাদের সেখানে কোনো প্রবেশাধিকার ছিল না। সেসব গতানুগতিকের বাইরে এবার মা দিবসে ব্যতিক্রমধর্মী আয়োজন করে চাঁপাইনবাবগঞ্জের এক অজপাড়া গাঁয়ে অবস্থিত সিপারুল চিলড্রেন ফেয়ার প্রাথমিক বিদ্যালয়। আশপাশের প্রান্তিক পরিবারের চারজন মহিলাকে সম্মাননা প্রদান করে। সম্মানিতরা স্বল্প শিক্ষিত বা অক্ষরজ্ঞানহীন, কিন্তু সংসারধর্ম নিষ্ঠার সাথে নিজের দায়িত্ব পালন করে অনন্য উদাহরণের অধিকারী। এ রকম এক কৃতী মা হলেনÑ এলেসন বেগম। পাঁচ সন্তানের মধ্যে তিনজন প্রকৌশলী ও একজন বিসিএস উত্তীর্ণ। সেরা শাশুড়ি দুলালি রানী কর্মকার, স্বামী বিয়োগের পর তিন সন্তানকে লালন-পালন ও প্রতিষ্ঠিত করে একান্নবর্তী পরিবার হিসেবে সবকে আগলে রেখে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। আর এক সেরা শাশুড়ি হলেনÑ নিরক্ষর গোলেনুর বেগম, অভাব অনটন সত্ত্বেও পরম মমতায় গড়ে তুলে প্রত্যেককে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। সেরা বৌমা হিসেবে তহুরা বেগম, যৌথ পরিবারে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করে সকলের নিকট সমাদৃত।
এ ধরনের সম্মাননা দেয়ার ক্ষেত্রে নতুনত্ব রয়েছে। উল্লেখিত চারজন মা গ্রামীণ সমাজে অনন্য ও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করেছেন। আমাদের সমাজে হানাহানি, বৈরিতা, অসন্তোষ ইত্যাদি বিদ্যমান সত্ত্বেও এসব মায়েদের গুণাবলির কথা সকলের মাঝে জাগরিত হোক। পারিবারিক সুখ, শান্তি, ঐক্য, সহমর্মিতার উদাহরণ প্রতিষ্ঠিত হোক।

জাহাঙ্গীর সেলিম : লেখক, গবেষক ও কলামিস্ট

About The Author

শেয়ার করুন