বিশ্ব পরিবেশ দিবসের প্রাসঙ্গিক ভাবনা
আবদুল্লাহ সাহেদ
সারা পৃথিবীর মতো বাংলাদেশেও বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালন করা হয় ৫ জুন। ১৯৭২ সালে সুইডেনের স্টকহোমে বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালনের শুরু হয়েছিল। শুরুতে পরিবেশ দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল ‘একটাই পৃথিবী’।
পরিবেশ দিবসের মূল উদ্দেশ্য থাকে পরিবেশ সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধি ও পরিবেশ রক্ষায় বিভিন্ন পদক্ষেপ। শুরু থেকে এখন পর্যন্ত মোট ৫২ বার পরিবেশ দিবস পালন করা হয়েছে। নেয়া হয়েছে পরিবেশ রক্ষায় বিভিন্ন পদক্ষেপও, কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, এই ৫২ বছরে পৃথিবীতে পরিবেশ ধ্বংস বেড়েছে বৈ কমেনি। ক্রমাগত জলবায়ুর পরিবর্তন, প্রাকৃতিক পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস ও বিভিন্ন ধরনের দূষণের কারণে পৃথিবী এখন এমন ঝুঁকির মধ্যে আছে, যা সত্যিই নজিরবিহীন।
বাংলাদেশের জন্য পরিবেশ দিবস খুবই প্রাসঙ্গিক। আমরা একদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে ভুক্তভোগী দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম, অন্যদিকে পরিবেশ দূষণের কোনো কোনো ক্ষেত্রে চ্যাম্পিয়নও বটে। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রধান নিয়ামক কার্বন নিঃসরণের ক্ষেত্রে আমাদের ভূমিকা নগণ্য হলেও পরিবেশ ধ্বংস ও দূষণের ক্ষেত্রে একেবারে প্রথম কাতারে। তাই জলবায়ু পরিবর্তনে অমাদের ভূমিকা কম বলে আত্মতৃপ্তির সুযোগ নেই, বরং যা আছে তা হলো পরিবেশ সংরক্ষণে যথাযথ ভূমিকা নেয়ার দায়িত্ব।
এই দায়িত্ব অবহেলার কারণেই ঢাকার বাতাস পৃথিবীর অন্যতম দূষিত, ঢাকা ও আশপাশে যতগুলো জলাভূমি আছে তার প্রায় সবগুলোই চূড়ান্ত মাত্রায় দূষিত, খাল ও নদী যেন ময়লার ভাগাড়, নর্দমা ও শিল্প বর্জ্যরে নিরাপদ ‘ডাম্পিং গ্রাউন্ড’। পাহাড় কাটা, নদী, খাল ও জলাভূমি ভরাট, বনভূমি ধ্বংস ইত্যাদি তো আমাদের প্রেক্ষাপটে প্রায় স্বাভাবিক ঘটনা। পাশাপাশি ইটভাটা, যানবাহনের কালো ধোঁয়া, শহুরে জীবনে যথেচ্ছাচার শব্দযন্ত্রের ব্যবহার, অপরিকল্পিত দালানকোঠা ও অবকাঠামো পরিবেশের বিপর্যয় ডেকে আনছে।
যদিও পরিবেশ সংরক্ষণে আমাদের আইন ও বিধিবিধানের বহরটা একেবারে কম না, রয়েছে একগুচ্ছ বিধিবিধান। যেমন, জাতীয় পরিবেশ নীতি (২০১৮), পরিবেশ আদালত আইন (২০১০), বাংলাদেশ জীববৈচিত্র্য আইন (২০১৭), পরিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা ব্যবস্থাপনা বিধিমালা (২০১৬), কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিধিমালা (২০২১), শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা (২০০৬) ইত্যাদিসহ আরো অনেক। এত এত আইন ও বিধিবিধান থাকা সত্ত্বেও আমাদের পরিবেশ কীভাবে দূষণের শিকার হচ্ছে তা সহজে বোধগম্য নয়!
বিশ্ব পরিবেশ দিবস ৫২তম বছর উদ্যাপন করছে। পরিবেশ সুরক্ষাকে সামনে রেখে ১৯৭২ সালে সুইডেনের স্টকহোমে জাতিসংঘের এক সম্মেলনে ৫ জুনকে বিশ্ব পরিবেশ দিবস হিসেবে নির্ধারণ করা হয়। এই দীর্ঘ ৫২ বছরে বিশ্বব্যাপী পরিবেশ সংরক্ষণে রাষ্ট্রসমূহ কতটুকু কার্যকর ভূমিকা রাখতে পেরেছে তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। পরিবেশবাদীরা বলছেন, বিশ্বে কার্বন নিঃসরণ বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে। গড় তাপামাত্রা বাড়ার কারণে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিসমূহ আরো দৃশ্যমান হয়েছে। অনেকেই বলছেন, এই পঞ্চাশ বছরে হয়তো পৃথিবীতে দারিদ্র্যের হার কিছুটা কমেছে, অনেক শিশুর শিক্ষায় অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়েছে, স্বাস্থ্যসেবার বেশ কিছুটা উন্নতি হয়েছে কিন্তু সমানতালে বিশ্বব্যাপী অসমতা বেড়েছে। আর এর পেছেনে মূল ভূমিকা রেখেছে কিছু মানুষের স্বার্থে প্রাকৃতিক সম্পদের যথেচ্ছাচার ব্যবহার।
পরিবেশ দূষণের সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের সংযোগ সরাসরি। পরিবেশ দূষণের কারণে জলবায়ু পরিবর্তন যেমন ত্বরান্বিত হয়, তেমনি পরিবেশ দূষণের কারণে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব আরো মারাত্মক রূপ লাভ করে, যার চূড়ান্ত ভুক্তভোগী মানুষ এবং প্রাণ-প্রকৃতি। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় ২০১৫ সালের প্যারিস চুক্তি অনুযায়ী বিশ্ব নেতৃবৃন্দ পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি শিল্পবিপ্লব পূর্ববর্তী সময় থেকে ১.৫ ডিগ্রির মধ্যে রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এই প্রতিশ্রুতি রক্ষায় প্রাকৃতিক পরিবেশের যথাযথ সংরক্ষণের কোনো বিকল্প নেই। যদিও উন্নয়নের সঙ্গে প্রাকৃতিক পরিবেশের সম্পর্ক কী হবে, এ আলোচনা দীর্ঘদিনের। ১৯৯২ সালের ব্রাজিলের রিও শহরের নাম অনুযায়ী পরিবেশ ও উন্নয়ন সম্পর্কিত ঘোষণায় উন্নয়নের অধিকারের পাশাপাশি পরিবেশ সংরক্ষণের ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। এই ঘোষণায় বর্তমানের পাশাপাশি ভবিষ্যতের চাহিদাসমূহ বিবেচনায় আনা হয়েছে। একই সঙ্গে বলা হয়েছে, উন্নয়নের পূর্বশর্ত হচ্ছে টেকসই ব্যবস্থাপনা ও পরিবেশের সংরক্ষণ।
উন্নয়নের জন্য প্রাকৃতিক পরিবেশের ধ্বংস নিঃসন্দেহে একটি সেকেলে ধারণা। এই ধারণা কেবল বিশেষ গোষ্ঠী ও শ্রেণীর স্বার্থরক্ষা করে। তবে পরিবেশ সংরক্ষণে সর্বসাধারণের সচেতনতা যেমন প্রয়োজনীয় একইসঙ্গে পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তাব্যক্তিদের সক্রিয়তা ও আইনের যথাযথ ব্যবহার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণভাবে পরিবেশ সুরক্ষার সঙ্গে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। প্রয়োজনীয় যোগ্য ব্যবস্থাপনার অভাবে আমরা প্রতিনিয়ত পরিবেশ দূষণ করছি।
যে কোনো দেশে স্বাভাবিকভাবে কমপক্ষে ২৫ শতাংশ বনভূমি প্রয়োজন। আর আমাদের মতো জনবহুল দেশে পরিবেশ দূষণমুক্ত রাখতে হলে কমপক্ষে দেশের এক-তৃতীয়াংশ বনভূমি আবশ্যক। কিন্তু নির্বিচারে ব্যাপকভাবে গাছপালা কেটে উজাড় করে ফেলায় আমাদের বনভূমি কমে ১০ শতাংশেরও নিচে এসে দাঁড়িয়েছে। যার ফলে অক্সিজেনের অভাবে আমাদের নানা ধরনের রোগে আক্রান্ত হতে হচ্ছে। গাছপালা কেটে ফেলায় বনভূমির অভাবে বৃষ্টিপাত কমে যাচ্ছে এবং আবহাওয়া হচ্ছে উত্তপ্ত থেকে উত্তপ্ততর। বাড়তি জমি লাভের জন্য পুকুর, দীঘি, জলাশয় ইত্যাদি ভরাট করায় ক্ষতিকর শুষ্ক ও রুক্ষ পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছে। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় বাঁধ নির্মাণ করে নদীর স্বাভাবিক গতিপ্রবাহকে রোধ করার ফলে চর পড়ে নদী শুকিয়ে ব্যাপক অঞ্চলে মরুকরণের প্রক্রিয়া পরিলক্ষিত হচ্ছে। এ মরুকরণ প্রক্রিয়ার ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় জমির উপরিভাগে লবণাক্ততা বাড়ছে ও সেচব্যবস্থার মাধ্যমে কৃষিকাজ অসম্ভব হয়ে পড়ছে।
অপরিকল্পিত জনসংখ্যার চাপে প্রকৃতি ক্রমশই বিপর্যয়ের দিকে এগোচ্ছে। শিল্প ও অন্যান্য বর্জ্য পরিশোধনের ক্ষমতা ক্রমেই প্রকৃতি হারিয়ে ফেলছে। আবার অক্সিজেন তৈরির অন্যতম স্থান বনভূমি প্রতি বছর অন্ততপক্ষে ১ শতাংশ করে কমে যাচ্ছে। এ প্রক্রিয়া রোধ করা না গেলে একবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি অক্সিজেনের দারুণ ঘাটতি দেখা দিবে। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বৃক্ষনিধন, শুষ্কতা, জলাবদ্ধতা, লবণাক্ততা, বন্যা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ইত্যাদির কারণে মরুকরণ প্রক্রিয়ায় বিশ্বের ৩০ কোটিরও বেশি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যার অর্ধেকই হলো এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের। এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকার সৃষ্টিনির্ভর কৃষিভূমি, সেচভূমি, চারণভূমি ও বনভূমির প্রায় ৩৩ লাখ বর্গমাইল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
‘ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর দ্য প্রটেকশন অব নেচার’র হিসাব মতে, গত প্রায় ১০০ বছরে পৃথিবী থেকে ৭৬ প্রজাতির প্রাণী, কয়েক হাজার রকমের গাছপালা বিলুপ্ত হয়েছে। আরো প্রায় ২৬ প্রজাতির পাখি বিলুপ্তির পথে। প্রতি বছর ২০ কোটি টনের বেশি মনো-অক্সাইড, ৫ কোটি টন হাইড্রো কার্বন, ১২ কোটি টন ছাই ও ১৫ কোটি টন সালফার ডাই-অক্সাইড, কলকারখানা থেকে নির্গত হয়ে পৃথিবীর পরিবেশকে আক্রান্ত করছে (নিউ ইয়র্ক টাইমস থেকে)।
পরিবেশ বিনষ্টের সর্বাপেক্ষা ভয়ংকর দিক হলো, ওজোনস্তরের বিরূপ প্রতিক্রিয়া। ওজোনস্তর ছাড়া পৃথিবীতে প্রাণের অস্তিত্ব সম্ভব নয়। বায়ুদূষণের ফলে এক ধরনের গ্যাস বায়ুম-লের নির্দিষ্ট স্তরে ওজোন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, যা সূর্যের ক্ষতিকর অতিবেগুনি রশ্মি থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করে। বিশেষজ্ঞদের মতে, পারমাণবিক বিস্ফোরণের কারণে ওজোনস্তর অতি উত্তপ্ত হলে বায়ুম-লে অন্যতম উপাদান নাইট্রোজেন ভেঙে যায় এবং প্রচুর পরিমাণ নাইট্রিক অক্সাইড সৃষ্টি হয়, যা ওজোন প্রতিবন্ধকতায় ফাটল ধরায়। এ প্রক্রিয়ায় ওজোনের ক্ষতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। তাছাড়া বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, পারমাণবিক বিস্ফোরণের ফলে অসহনীয় আবহাওয়া, অস্থিতিশীল জলবায়ু ও অস্বাভাবিক তাপমাত্রা ওঠানামা করার ফলে সামুদ্রিক প্রাণী ও গাছপালা বিলুপ্ত হয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে।
এখন সময় এসেছে সব প্রতিবন্ধকতা দূর করে পরিবেশ সুরক্ষায় সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করা। এজন্য আমাদের দেশের নতুন প্রজন্মকে এই কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা খুবই প্রয়োজন। সচেতনতা বৃদ্ধির যেমন বিকল্প নেই একই সঙ্গে যারা পরিবেশ দূষণের জন্য দায়ী, পরিবেশ দূষণের মাধ্যম মুনাফা অর্জনে ব্যস্ত তাদের কাছ থেকে যথাযোগ্য ক্ষতিপূরণ আদায় করা আবশ্যক। এভাবে সবপর্যায়ে জবাবদিহি নিশ্চিত করা গেলেই পরিবেশ দিবসের আসল উদ্দেশ্য অর্জিত হবে।
আবদুল্লাহ সাহেদ : ব্যাংকার, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট