দুর্নীতি ও অনিয়মের বিষয়টি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতেই রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের বিদ্যালয় পরিদর্শক জিয়াউল হকের বিরুদ্ধে প্রধান শিক্ষক সাবিরুদ্দিন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ করেছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গিয়েছে। বেশিরভাগই বিদ্যালয় পরিদর্শকের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত অভিযোগের জন্য নিন্দা জ্ঞাপন করেছেন।
গত ১২ জুলাই প্রতিষ্ঠানের প্যাডে বিদ্যালয় পরিদর্শক জিয়াউল হকের বিরুদ্ধে শিক্ষামন্ত্রী বরাবর অভিযোগ দায়ের করেন প্রধান শিক্ষক সাবিরুদ্দিন। জিয়াউল হক শিবগঞ্জে জমি কেনার জন্য তার কাছে ৭ লাখ টাকা ঘুষ দাবি করেন এবং ঘুষ না দেয়ায় অ্যাডহক কমিটি আটকে রাখার অভিযোগ করেন তিনি।
তবে তিনি অভিযোগপত্রে শিবগঞ্জ উপজেলার কয়েকটি স্কুলের সাথে বিদ্যালয় পরিদর্শকের অসদাচরণের কথা বললেও কানসাট উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. শাহজাহান আলী এবং তেলকুপি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মহা. আবদুল মান্নান জানান, অভিযোগ সম্পর্কে তারা অবহিত ছিলেন না। পত্রিকায় রিপোর্ট প্রকাশের পর জানতে পেরেছেন। এই শিক্ষকদ্বয় আরো জানান, বিদ্যালয় পরিদর্শক তাদের সঙ্গে কখনো অসদাচরণ করেননি।
রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার কয়েকটি বিদ্যালয়ের প্রধান ও সহকারী প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিদ্যালয় পরিদর্শক হিসেবে জিয়াউল হক রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডে যোগদান করার পর থেকেই তারা কোনোরকম হয়রানি ছাড়াই কাজ করতে পারছেন। এরকম একজন মানুষের পক্ষে কারো কাছে কমিটি অনুমোদনের নামে ৭ লাখ টাকা ঘুষ চাওয়ার প্রশ্নই আসে না। ওই প্রধান শিক্ষক হয়তো তার নিজের কোনো অনিয়ম চাপা দিতেই এরকম মিথ্যা অভিযোগ দায়ের করেছেন বলে মনে করেন তারা।
আরেকজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বলা হচ্ছে ঘুষ না দেয়ায় বিদ্যালয় পরিদর্শক বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির অনুমোদন আটকে রেখেছেন। জানা মতে, কমিটির অনুমোদন দেন বোর্ড চেয়ারম্যান। বিদ্যালয় পরিদর্শক শুধু ফাইল রেডি করেন। আরেকটি বিষয় হলো, একজন অধস্তন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বোর্ড চেয়ারম্যানের কাছে অভিযোগ দায়ের না করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ দেয়ায় এটাই পরিষ্কার হয় যে, এটি সম্পূর্ণ মিথ্যা অভিযোগ এবং ঘটনা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার অপচেষ্টা মাত্র।
নাচোল মুন্সী হযরত আলী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সাদিকুল ইসলাম জানান, বিদ্যালয়ের যে কোনো কাজে তিনি (বিদ্যালয় পরিদর্শক) শিক্ষকদের তার কক্ষে বসিয়ে মনোযোগ সহকারে কথা শুনে ভালো পরামর্শ দেন। কোনো শিক্ষক বা প্রতিষ্ঠানকে তিনি অযথা বিপদে ফেলার চেষ্টা করেন না। তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে তিনি এর তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান।
এ বিষয়ে খোঁজ করতে গিয়ে আরো যেসব বিষয় সামনে এসেছে তাহলো, বিনোদপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র জিয়াউল হক গতবছর ৫ মে রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডে বিদ্যালয় পরিদর্শক হিসেবে যোগ দেন। এর কিছুদিন পর বিনোদপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সাবিরুদ্দিন অ্যাডহক কমিটির অনুমোদনের জন্য ফাইল বোর্ডে জমা দেন। বিদ্যালয় পরিদর্শক জিয়াউল হক পূর্বের রেকর্ড দেখে জানতে পারেন, এর আগে তিন দফা অ্যাডহক কমিটি দিয়ে বিদ্যালয়টি পরিচালিত হয়েছে, যা বিধিসম্মত নয়। এছাড়াও একই ব্যক্তিকে সভাপতি করে তিন দফা অ্যাডহক কমিটি গঠন করা হয়েছিল। চতুর্থ দফায়ও ওই একই ব্যক্তিকে সভাপতি করে অ্যাডহক কমিটি অনুমোদনের জন্য সুপারিশ করেন প্রধান শিক্ষক। এই কারণে ওই অ্যাডহক কমিটি অনুমোদন না দিয়ে বোর্ড পছন্দমতো ব্যক্তিকে সভাপতি মনোনীত করে অনুমোদন দেয়।
নিয়মানুযায়ী ৬ মাস মেয়াদি অ্যাডহক কমিটি গঠন করা হয় পূর্ণাঙ্গ কমিটি নির্বাচনের জন্য। আর দুই বারের বেশি অ্যাডহক কমিটি গঠনের নিয়ম নেই।
জানা গেছে, ২০২২ সালের ৩১ অক্টোবর চতুর্থ দফা অ্যাডহক কমিটিতে ওই স্কুলের সাবেক ছাত্র তরুণ সমাজসেবক শামীম রেজাকে সভাপতি করে অ্যাডহক কমিটির অনুমোদন দেয় শিক্ষা বোর্ড। শামীম রেজা সভাপতি হওয়ার পর নির্বাচনসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রধান শিক্ষককে কারণ দর্শানোর চিঠি দেন।
পরবর্তীতে এই অ্যাডহক কমিটির মেয়াদ শেষ হলে পঞ্চম দফায় প্রধান শিক্ষক সাবিরুদ্দিন তার আগের পছন্দের লোককে সভাপতি করে অ্যাডহক কমিটি অনুমোদনের জন্য শিক্ষা বোর্ডে ফাইল জমা দেন। কিন্তু এরই মধ্যে বিদ্যালয়ের ১৬ জন শিক্ষক প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির বিষয়ে রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডসহ বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ জমা দেয়ায় অ্যাডহক কমিটির অনুমোদন আটকে যায়।
অ্যাডহক কমিটির সাবেক সভাপতি শামীম রেজা বলেন, সাবিরুদ্দিন প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদানের পর থেকেই স্কুলের তহবিল নয়ছয় করা শুরু করেন। তার দুর্নীতি ও অনিয়মের তালিকা এত লম্বা যে, তা এক কথায় বলা সম্ভব নয়। এমন কোনো খাত নেই, যে খাতের টাকা তিনি তছরুপ করেননি। বিদ্যালয়ের মার্কেটের কমপক্ষে ৫টি ঘর নামমাত্র মূল্যে নিজ নামে বরাদ্দ নিয়েছেন। প্রধান শিক্ষক গঠিত বিভিন্ন কমিটিকে পাশ কাটিয়ে এসব অপকর্ম করেছেন। এছাড়াও প্রধান শিক্ষক ভারতীয় হাই কমিশন স্কুলকে বিল্ডিং ও স্টেডিয়াম বানিয়ে দিবে বলে প্রচার করে সেই প্রজেক্ট নিয়ে আসার খরচ হিসেবে স্কুলের তহবিল থেকে ৭/৮ লাখ টাকা লোপাট করেছেন। তদন্ত করলেই এসবের প্রমাণ বেরিয়ে আসবে। তিনি বলেন, আমি সভাপতি হওয়ার পর বিদ্যালয়ের শৃঙ্খলা এবং আর্থিক বিষয়ে স্বচ্ছতা ফিরিয়ে আনতে তার কাছে আর্থিক বিষয়ে ব্যাখ্যা চাইলেও তিনি কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি।
শামীম রেজা বলেন, নিতান্তই দরিদ্র শ্রী রতন কুমার প্রায় ৫ বছর ধরে ৪ হাজার টাকায় খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে নিয়মিত দায়িত্ব পালন করছিলেন। তার বেতন না বাড়িয়ে প্রধান শিক্ষক এক বছর আগে তার ছেলেকে ১০ হাজার টাকা বেতনে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে বিদ্যালয়ে ঢোকান। অথচ সে ঠিকমতো ক্লাসও নিত না। তিনি বলেন, আমি সভাপতি হবার পর বিরোধিতার মুখেও রতন কুমারের বেতন ৬ হাজার এবং প্রধান শিক্ষকের ছেলের বেতন কমিয়ে ৮ হাজার টাকা করি।
বিদ্যালয় পরিদর্শকের বিরুদ্ধে প্রধান শিক্ষকের ঘুষের অভিযোগ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে শামীম রেজা বলেন, এটা সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। প্রধান শিক্ষক পূর্বের সভাপতিকে পুনরায় সভাপতি করার জন্য শিক্ষা বোর্ডের কাছে আবদার করে। কিন্তু বোর্ড চেয়ারম্যান তার আবদারে সাড়া না দিয়ে আমাকে সভাপতি করে অ্যাডহক কমিটি দেওয়ায় তিনি মনোক্ষুণ্ন হন এবং এর জন্য তিনি বিদ্যালয় পরিদর্শককে দায়ী করেন। সেখান থেকেই ঘুষের এই মিথ্যা অভিযোগের চিন্তা।
এদিকে প্রধান শিক্ষক সাবিরুদ্দিনের দায়েরকৃত অভিযোগের প্রেক্ষিতে গঠিত দুই সদস্যের তদন্ত কমিটিকে সরেজমিন তদন্তপূর্বক ৭ কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের আদেশ দিয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। ২৩ আগস্ট এক চিঠিতে এ আদেশ দেয়া হয়।
বিদ্যালয় পরিদর্শকের বিরুদ্ধে ঘুষের অভিযোগ সম্পর্কে প্রধান শিক্ষক সাবিরুদ্দিন জানান, তিনি (জিয়াউল হক) ঘুষ চেয়েছেন। এর প্রমাণ আমি নিজেই। এছাড়া তিনি নিজেই প্রশ্ন করেন, ঘুষের কি কোনো ডকুমেন্টস থাকে নাকি। প্রধান শিক্ষক জানান, টাকা দিতে পারেননি বলে গতবার ৭ মাস পর কমিটি দিয়েছেন। এবারে এখন পর্যন্ত কমিটি আটকে রেখেছেন, টাকা দিতে পারিনি বলে।
অন্যদিকে বিদ্যালয় পরিদর্শক জিয়াউল হক তার বিরুদ্ধে দায়েরকৃত অভিযোগ সম্পর্কে বলেন, অভিযোগটি সম্পূর্ণ অসত্য এবং বানোয়াট। ওই প্রতিষ্ঠানের (বিনোদপুর উচ্চ বিদ্যালয়) ১০ জন শিক্ষক লিখিতভাবে বিধি মোতাবেক বিভিন্ন আর্থিক বিষয়ে গুরুতর অভিযোগ দাখিল করেন এবং চেয়ারম্যান মহোদয়ের সাথে সরাসরি দেখা করে এর তদন্তপূর্বক প্রতিকার চান। শিক্ষা বোর্ড এই বিষয়ে তদন্তের উদ্যোগ নিলে প্রধান শিক্ষক ঘটনা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য মন্ত্রণালয়ে আমার নামে এই অসত্য অভিযোগ দাখিল করেন।