চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার বিনোদপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোহা. সাবিরুদ্দিনের বিরুদ্ধে ‘পাহাড়সম’ দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে ভেতর ও বাইরে থেকে। অভিযোগের মধ্যে রয়েছে- দোকান ভাড়ার টাকা, সেশন চার্জ ও ছাত্র বেতনের টাকা, বিদ্যালয়ের আমবাগান ও ধান বিক্রির টাকা, দোকান বিক্রি হতে প্রাপ্ত কমিশনের টাকা এবং প্রভিডেন্ড ফান্ডের টাকা বিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টে জমা না দিয়ে নিজের কাছে রেখে আত্মসাৎ করা। বিভিন্ন সময় বিদ্যালয়ের গাছ কেটে বিক্রি করা ছাড়াও মার্কেট নির্মাণ ও দোকান ঘর বরাদ্দে বেশি টাকা নিলেও তা কম দেখিয়ে আত্মসাত এবং সহকর্মীদের সঙ্গে অসদাচরণ ও মানসিক নির্যাতনের অভিযোগও উঠেছে তার বিরুদ্ধে।
এসব অনিয়ম-দুর্নীতি উল্লেখপূর্বক প্রধান শিক্ষক সাবিরুদ্দিনের বিরুদ্ধে গত ২৮ মে রাজশাহী শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যান বরাবর অভিযোগ দায়ের করেন বিদ্যালয়ের ১৬ জন শিক্ষক। এছাড়াও গত ৯ জুলাই এই ১৬ জন শিক্ষক মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবর একই অভিযোগ দায়ের করেন। আবেদনটি গত ১১ জুলাই রিসিভড হয়। অভিযোগের অনুলিপি আরো কয়েকটি জায়গায় দেয়া হয়।
উল্লেখ্য, রাজশাহী শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যান বরাবর অভিযোগপত্রে ১৬ জন শিক্ষকের নাম থাকলেও তাতে ১০ জন এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবর অভিযোগপত্রে ১৩ জন শিক্ষক স্বাক্ষর করেছেন।
অন্যদিকে চাঁদশিকারী গ্রামের আতাউর রহমান বিদ্যালয়ের দোকান ঘর বরাদ্দে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ এনে গত ৪ জুলাই রাজশাহী শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যান এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সমন্বিত রাজশাহী জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক বরাবর আবেদন করেন। আতাউর রহমানের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করে এর সত্যতা নিশ্চিত হওয়া গেছে। তিনি বলেন, প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলতে গেলে মুখের ভাষা খারাপ করেন। তার কাছ থেকে প্রতিকার না পেয়ে বাধ্য হয়ে অভিযোগ করেছি।
এদিকে প্রধান শিক্ষক সাবিরুদ্দিনের বিরুদ্ধে কয়েকটি গণমাধ্যমে গত জুলাইয়ে সংবাদ প্রকাশ হলে তা আমলে নেন শিবগঞ্জ আমলী আদালত এবং ৩ সেপ্টেম্বরের মধ্যে এ বিষয়ে তদন্ত করে প্রতিবেদন দেয়ার জন্য শিবগঞ্জ উপজেলা সমাজসেবা অফিসার কাঞ্চন কুমার দাসকে নির্দেশ প্রদান করেন।
২৯ জুলাই সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. হুমায়ূন কবীর স্বাক্ষরিত আমলী আদালতের আদেশের অনুলিপিতে বলা হয়, “… সংবাদটি অত্র আমলী আদালতের গোচরীভূত হয়েছে। সংবাদটি ব্যাপকভাবে বিশ্লেষণ করে অত্র আদালতের কাছে প্রতীয়মান হয় যে, কর্মকর্তা ও কর্মচারী প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন যাতে বিদ্যালয়ের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। বিদ্যালয়ের স্বাভাবিক কার্যক্রম সচল রাখা প্রতিটি সুনাগরিকের দায়িত্ব। বর্তমানে বিদ্যালয়ের পাঠদান ও স্বাভাবিক কাজকর্ম হুমকির মুখে। … উক্ত অপরাধটি কার দ্বারা সংঘটিত হয়েছে, কিভাবে সংঘটিত হয়েছে, কেন সংঘটিত হয়েছে বিস্তারিত নাম ঠিকানা, কারণ পত্রিকার প্রতিবেদনে সুস্পষ্ট নয়। সাক্ষীদের নাম ঠিকানাও প্রতিবেদনে নেই। সুতরাং অপরাধটি প্রাথমিক তদন্তের মাধ্যমে নিরুপন সহ অভিযুক্তদের সনাক্ত করা প্রয়োজন।”
এ বিষয়ে শিবগঞ্জ উপজেলা সমাজসেবা অফিসার কাঞ্চন কুমার দাস বলেন, আদালতের আদেশ পেয়েছি। এ বিষয়ে কাজ শুরুও করেছি। তদন্ত শেষ হলেই প্রতিবেদন জমা দেয়া হবে।
জানা গেছে, ১৯৫৫ সালে প্রতিষ্ঠিত বিনোদপুর উচ্চ বিদ্যালয়টি ৩৯ বিঘা জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত। বিদ্যালয়ের নিজস্ব সম্পদ বলতে বরেন্দ্র অঞ্চলে প্রায় ২৪ বিঘা ধানি জমি, ৩টি আমবাগান এবং বিদ্যালয়ের জমির ওপর নির্মিত পাকা দোকান ঘর ১২০টি, কাঠের ৫০টি দোকান ঘর রয়েছে। যেগুলো থেকে বছরে আয় হয় কয়েক লাখ টাকা।
বিদ্যালয়টি এর আগে সুষ্ঠু ও শৃঙ্খলভাবে পরিচালিত হলেও বর্তমান প্রধান শিক্ষক সাবিরুদ্দিন যোগ দেয়ার পর থেকে শুরু হয় আর্থিক অনিয়ম, বলছেন অভিযোগকারীরা। জানা গেছে, ২০১০ সালে সাবিরুদ্দিনকে বিদ্যালয়ের তৎকালীন অ্যাডহক কমিটি প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেন। তিনি তার আগে বিনোদপুর মাদ্রাসার শিক্ষক ছিলেন। বিনোদপুর বিদ্যালয়টিতে বর্তমানে ১৯ জন শিক্ষক ও ৩ জন কর্মচারী নিয়োজিত আছেন। এছাড়া বিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় দেড় হাজার।
অভিযোগকারী শিক্ষকদের মধ্যে সহকারী শিক্ষক আবুল কালাম আজাদ ও তরিকুল ইসলাম জানান, প্রধান শিক্ষক অন্য শিক্ষকদের প্রতি চরম অসদাচরণ করেন। তুচ্ছ বিষয়েও শিক্ষকদের গালিগালাজ করেন। তিনি বলেন, স্কুলের সম্পদের আয়-ব্যয়ের সঠিক কোনো হিসাব তিনি কখনো দেননি। তার এহেন আচরণ ও অনিয়মের প্রতিকার চেয়ে আমরা কয়েকজন শিক্ষক শিক্ষা বোর্ডসহ বিভিন্ন জায়গায় অভিযোগ জমা দিয়েছি। তদন্ত হলেই প্রধান শিক্ষকের সমস্ত দুর্নীতি ও অনিয়ম বেরিয়ে আসবে।
বিনোদপুর ইউনিয়ন পরিষদের ৫নং ওয়ার্ডের সাবেক সদস্য জামিল উদ্দিন বলেন, সাবিরুদ্দিন প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদানের পর থেকে নিজের খেয়াল-খুশিমতো স্কুল পরিচালনা করেন। স্কুলের সম্পদ থেকে আয়ের টাকা ব্যাংকে জমা না দিয়ে নিজের কাছেই রেখে দেন। প্রকৃত আয় থেকে কম টাকা ব্যাংকে জমা দেন। আর দোকান ঘর বরাদ্দ নিয়ে তো অনিয়মের শেষ নেই।
তবে প্রধান শিক্ষক তার মতের বিপক্ষে গেলে যে কারো সঙ্গেই গালিগালাজ করেন বলে বেশ কয়েকজন জানিয়েছেন।
এদিকে প্রধান শিক্ষক সাবিরুদ্দিনের বিরুদ্ধে তহবিল তছরুপ, আর্থিক দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ তদন্তে চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে রাজশাহী মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড। গত ২৭ আগস্ট রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর কামরুল ইসলাম এ কমিটি গঠন করেন। রাজশাহী জেলা শিক্ষা কর্মকর্তাকে প্রধান করে গঠিত কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- নওগাঁ জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা, শিক্ষা বোর্ডের উপ-বিদ্যালয় পরিদর্শক এবং শিবগঞ্জ উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা। আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে কমিটিকে সরেজমিন ও প্রামাণিক তদন্ত শেষে প্রতিবেদন জমার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।