মোস্তাক হোসেন
বাংলার ইতিহাস ও বাঙালির ইতিহাসের প্রভেদ নেই বলে মনে করেন নীহাররঞ্জন রায়। তাঁর বাঙালীর ইতিহাস আদি পর্বে অক্ষয় কুমার মৈত্রের উদ্ধৃতি উল্লেখ করে বলেছেন, ‘বাঙালির ইতিহাসের প্রধান কথা-বাঙালি জনসাধারণের কথা’। বাংলার প্রকৃতি, জনসাধারণের জীবনযাপন বাংলার সংস্কৃতির ধারক-বাহক। এই বাংলার সংস্কৃতি অন্তরে লালন করে থাকি সর্বক্ষেত্রে।
বাংলাদেশের সকল অঞ্চলের খাদ্যাভ্যাস, সাংস্কৃতিক কর্মকা- ও সংস্কৃতির অমিল রয়েছে; যা কিনা ঐতিহ্যবাহী এবং ঐতিহ্যের পরম্পরা। এই ঐতিহ্যগত বাঙালির উৎসব বাংলাবর্ষ আরম্ভে বর্ষবরণের মাধ্যমে বাংলা ভাষা-ভাষী প্রত্যকেই তৃপ্ত ও আনন্দবোধ করে থাকি বা থাকা উচিৎ বৈকি।
বাংলাদেশের খাদ্যাভ্যাসে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগলেও পরম্পরার পরিবর্তন হয়নি। এখনো বাংলার অধিবাসীকে বলা হয় ‘মাছে-ভাতে বাঙালি’। এটা বলার কারণও রয়েছে। প্রতিটি দেশ বা অঞ্চলের খাদ্যাভ্যাসের ধরন গড়ে ওঠে সেখানকার উৎপাদিত খাদ্যসামগ্রীর প্রতুলতার ওপর। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম নয়। ভৌগোলিক দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশের অবস্থান হিমালয়ের দক্ষিণে অবস্থিত। হিমালয়ের হিমবাহ হতে সৃষ্ট নদী প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নদী-নালা, খাল-বিল সৃষ্টির মধ্য দিয়ে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে। এইসব জলাশয়ের কারণে বাংলায় বিভিন্ন প্রকার প্রচুর মাছ পাওয়া যায় এবং মাছ সংগ্রহ, চাষ ও বিকিকিনির জন্য এক পেশাজীবী শ্রেণি কর্মব্যস্ত। অপরদিকে বঙ্গোপসাগরে প্রচুর পরিমাণে ইলিশসহ অন্যান্য মাছ পাওয়া যায়, এই মৎস্য সম্পদের ক্ষেত্রে ইলিশ বাংলার ঐতিহ্যের স্মারক। বঙ্গোপসাগরের ইলিশ মাছ বাংলাদেশের বাইরে অন্যান্য দেশে ব্যাপক সমাদৃত এবং দেশের অভ্যন্তরেও এর চাহিদা অনেক। এই মৎস্য সমৃদ্ধির ফলে এই অঞ্চলের জনগণের মধ্যে খাদ্যাভ্যাসে মাছের উপস্থিতি বিরাজমান।
আবার বাংলাদেশের যেসব খাদ্য শস্য উৎপাদন হয় সেগুলো হচ্ছেÑ ধান, গম, ভুট্টা। তার মধ্যে প্রধান খাদ্যশস্য হিসেবে ধান সর্বাধিক উৎপাদিত শস্য। অধিক উৎপাদিত শস্য ধান হওয়ায় বাঙালির প্রধান খাদ্য ভাত। বর্তমানে বেশির ভাগ মানুষের মধ্যে বিভিন্ন খাদ্যসামগ্রী ফ্রিজে সংরক্ষণ করতে দেখা যায়। কিন্তু অতীতে এই অঞ্চলের মানুষ রাতে ভাত রান্না করার পর খেয়েদেয়ে অতিরিক্ত ভাত সংরক্ষণের জন্য পানি দিয়ে রেখে দিত। সেই পানি দিয়ে রেখে দেয়া ভাতই হচ্ছে পান্তাভাত, যা কিনা সকালের নাশতা হিসেবে বাংলার মানুষ খেত।
মুঘল শাসনামলে সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের সদস্যরা মুক্ত অনুষ্ঠানের আয়োজন করলে সেই অনুষ্ঠানের আগত দর্শক-শ্রোতাদের ঐতিহ্যবাহী পান্তাভাত খাওয়াত। বিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে শহুরে বাঙালি নববর্ষ উদ্্যাপন শুরু করলে বাঙালিয়ানার প্রতীক হিসেবে ইলিশ মাছের সাথে পান্তাভাত খাওয়ার রেওয়াজ চালু হয়। একুশ শতাব্দীর প্রথমে দশকে সকালে ইলিশ মাছের সাথে পান্তাভাত খাওয়া বাঙালি সংস্কৃতির সাথে যুক্ত হয়ে যায় (সূত্র- ইন্টারনেট)।
বাংলার সংস্কৃতিতে হালখাতার আয়োজন এক প্রাচীন ঐতিহ্য। হালখাতা অনুষ্ঠানে পুরাতন বকেয়া পরিশোধ করার মাধ্যমে ক্রেতা-বিক্রেতা, দেনাদার-পাওনাদারের আন্তরিক সম্পর্ক সৃষ্টি হয়। প্রাচীনকালে বাংলার প্রধান অর্থনৈতিক কর্মকা-ই কৃষি। এ অঞ্চলে বেশির ভাগ মানুষ কৃষিনির্ভর। সারাবছর চাষাবাদ করে কর্মব্যস্ত জীবন অতিবাহিত করে। বছর শেষে ফসল ফলানোর পর সেই ফসল মাঠ থেকে গোলায় ওঠা পর্যন্ত থাকে অনেক আশা-আকাক্সক্ষা ও দায়-দায়িত্ব। সেই আঙ্গিকে কৃষিজীবীরা পরিবারের জন্য নতুন কিছু বা নিত্যপ্রয়োজনীয় কেনা, বছরান্তে পাওনাদারের পাওনা পরিশোধসহ অন্যান্য কর্ম ছাড়াও রাজকর পরিশোধ করে থাকে অন্তরিকভাবে। কৃষিনির্ভর বাংলার রাজকর ওঠানোর উদ্দেশ্যে স¤্রাট আকবর তাঁর শাসনামলে কৃষিজীবীদের কাছ থেকে খাজনা আদায়ের লক্ষে বাংলা সন প্রবর্তন করেন। সেই সময় কৃষকরা তার ভূস্বামীদের বছর শেষে খাজনা পরিশোধ করত। খাজনা পরিশোধ করার পর ভূস্বামীরা তার প্রজাদের জন্য চিত্ত-বিনোদনের ব্যবস্থা করত। সেই অনুষ্ঠানে প্রজারা নতুন পোশাক পরিধান করে উপস্থিত হতো এবং ভূস্বামীরা তার প্রজাদের মিষ্টান্ন খাবার পরিবেশন বা মিষ্টিমুখ করানোর পর সাংস্কৃতিক আয়োজনে সবাই যোগ দিয়ে নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর মাধ্যমে শেষ হতো বর্ষবরণ অনুষ্ঠান। তারই ধারাবহিকতায় বাংলাদেশসহ বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলে চলমান রয়েছে হালখাতা ও বর্ষবরণের আয়োজন।
পহেলা বৈশাখ উদ্্যাপন শুধু ঐতিহ্যের বাহনই নয় বরং বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসেরও স্মারক। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী যখন রবীন্দ্রসংগীত তথা বাঙালি সংস্কৃতি চর্চার বিরোধিতা করেছিল; তখন তার প্রতিবাদে রমনার বটমূলে ছায়ানট ১৯৬৫ সালে রবীন্দ্রনাথের আগমনী গান ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো’ দিয়ে প্রথম বর্ষবরণের আয়োজন করে। সেই নববর্ষের অনুষ্ঠান বিপুল জনসমর্থন লাভ করে এবং স্বাধীকার আন্দোলনের চেতনা উদ্বুদ্ধ হয়। এই আয়োজনের মাধ্যমে বাংলার জনগণ বাঙালি সংস্কৃতি পুনরুদ্ধার ও চর্চার মধ্য দিয়ে বাঙালি আদর্শের লালনে বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখা দেয়। স্বাধীনতা উত্তরকালে বাংলার সংস্কৃতিতে পহেলা বৈশাখ উদ্্যাপন এক বিশেষ গুরুত্ব বহন করে।
নববর্ষ উদ্্যাপনকে কেন্দ্র করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের উদ্যোগে ১৯৮৯ সালে এক আনন্দ মিছিলের আয়োজন করা হয়। ছায়ানটের আয়োজনে নববর্ষ ছিল বাঙালির স্বাধীকার আন্দোলনে সাংস্কৃতিক কর্মীদের পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। তেমনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের উদ্যোগে নববর্ষের আনন্দ মিছিলও ১৯৮০’র দশকে স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষকে ঐক্যবদ্ধ ও অপশক্তির অবসান কামনায় ছিল মূল উদ্দেশ্য। প্রতিবছর পহেলা বৈশাখে এই আনন্দ মিছিল বের হয় এবং এতে ব্যাপক সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ দেখা দেয়। ধীরে ধীরে এই আনন্দ মিছিল পরিণত হয় ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’য়। এখন মঙ্গল শোভাযাত্রা বাঙালি সংস্কৃতির নতুন সংযুক্ত সর্বজনীন সংস্কৃতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করায় দেশের প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় দেশবাসীর মঙ্গল কামনায় পহেলা বৈশাখে বের করা হয় ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’। পহেলা বৈশাখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউট কর্তৃক আয়োজিত মঙ্গল শোভাযাত্রাটিকে ইউনেস্কো ২০১৬ সালে ‘মানবতার অমূল্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য’ হিসেবে ঘোষণা দেয়।
পহেলা বৈশাখকে ঘিরে বাংলাদেশের প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় বিভিন্ন ধরনের আয়োজন করা হয়ে থাকে। শহর ও গ্রামে স্থানীয়ভাবে বৈশাখী মেলার আয়োজন করা হয়। মেলায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পালন করা হয়। সেই সাংস্কৃতিক উপস্থাপনায় স্থান পায় লোকসংগীত, লোকজ সংস্কৃতি, যাত্রাপালা, গম্ভীরা গান ইত্যাদি, যা কিনা গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্যকে বহন করে। আবার মেলায় বিকিকিনির সামগ্রী প্রধানত দেখতে পাওয়া যায়Ñ লোকজ হস্তশিল্প, খেলনা, গ্রামীণ ঐতিহ্যবাহী খাবার ও বিভিন্ন প্রকার মিষ্টান্ন।
বর্ষবরণ বাংলার জনগণকে এক নতুন উদ্যোমে প্রবাহিত করে। সেইদিন বাঙালির মনে ও বাংলার প্রকৃতিতে নতুন রূপের সঞ্চার ঘেেট। বাংলা ভাষাভাষী মানুষ তাদের বাঙালির সংস্কৃতি পালনের মাধ্যমে বাংলার ঐতিহ্যকে স্মরণ করতে বিভিন্ন আয়োজন করে থাকে। পহেলা বৈশাখে এই বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলের ঐতিহ্যগত বর্ষবরণ হয়ে ওঠে বাঙালির প্রাণের উৎসব। পহেলা বৈশাখ উদ্্যাপনের মধ্য দিয়ে আমাদের জীবনে আসুক অনাবিল সুখ ও সমৃদ্ধি। শুভ নববর্ষ ১৪২৯।
মোহা. মোস্তাক হোসেন : কলাম লেখক ও শিক্ষক, আলীনগর উচ্চ বিদ্যালয়, চাঁপাইনবাবগঞ্জ