বৃহস্পতিবার, ১২ জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ২৯ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ১৫ জিলহজ, ১৪৪৬ হিজরি

Last Updated on এপ্রিল ১৬, ২০২৫ by

বাঙালির চেতনায় পহেলা বৈশাখ
মোস্তাক হোসেন

বাঙালি জাতি হিসেবে স্বীকৃত বাংলা ভাষাভাষি জনগোষ্ঠীর বসবাস এশিয়া মহাদেশের দক্ষিণে অর্থাৎ ভারত উপমহাদেশে। এই বাঙালি জাতির রয়েছে সৃষ্টির হাজার হাজার বছরের ইতিহাস এবং অবস্থানগত ঐতিহ্যপূর্ণ সংস্কৃতি। তেমনি এক ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি পহেলা বৈশাখ। সেই সংস্কৃতির ঐতিহ্য বাঙালি মনে চেতনার উদ্রেক ঘটায়। যা বাঙালির হৃদয়ে কালক্রমে ধীরে ধীরে এক জাতীয় ঐতিহ্যের রূপ নিয়েছে।
বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের প্রতিটি অঞ্চলে বসবাসরত জাতিগোষ্ঠীর জীবন-যাপনে সেখানকার আবহমান কৃষ্টি-কালচার পরিলক্ষিত হয়। সেই জাতিগোষ্ঠীর সৃষ্টিগত ও প্রবাহমান জীবনযাত্রার ইতিহাস জানার একমাত্র মাধ্যমই হচ্ছে জাতিগত সংস্কৃতি। চলমান সংস্কৃতিই পৃথিবীতে তাদের অঞ্চলগত অবস্থানের জানান দেয়। আবার বিদ্যমান সাংস্কৃতিক কর্মকা- ধীরে ধীরে ঐতিহ্যতে রূপ নেয়। যদিও আবহমান সংস্কৃতি আধুনিকতার মোড়কে বেষ্টিত থাকায় উজ্জ্বলতা কিছুটা হ্রাস পায় কিংবা তেমনভাবে ফুটিয়ে উঠানো হয়নি বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার কারণে। সেই প্রতিবন্ধকতাকে দূর করতে না পারায় তা দিন দিন হয়ে উঠেছে এক অবহেলা ও অবজ্ঞার অবস্থানে।
আমরা লক্ষ্য করে থাকি যে, নদীর নাব্যতা কমে যাবার মূলে রয়েছে তার বুকে ধীরে ধীরে জেগে উঠতে থাকা চর। তা দূরীকরণের জন্য খনন প্রক্রিয়া খুবই জরুরি। নদীর বুকে জেগে উঠা চরগুলোকে কেটে না ফেলা হলে নদী তার পূর্বেকার রূপ ফিরে পাবে না। নদীকে তার পূর্বের আকার না দিতে পারলে বর্ষা মৌসুমে বন্যা বা নদীভাঙন হওয়াই স্বাভাবিক। এই দুর্যোগ হতে রক্ষা পেতে নদী গবেষণা কর্তৃপক্ষ নদী খননসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নিচ্ছে। নদী যেমন নাব্যতার কারণে প্রকৃত রূপ হারাচ্ছে, তেমনি বাঙালির বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি দিনকে দিন হারিয়ে যেতে বসেছে।
কিন্তু আমরা বাঙালি হিসেবে কেন হারিয়ে যেতে দিব আমাদের সংস্কৃতির ঐতিহ্যবাহিকতা? ফিরিয়ে আনতে হবে এবং সেই ঐতিহ্যকে চলমান রাখতে হলে তার দিকে সুনজর দেয়া আবশ্যক। শুধু ফিরিয়ে আনা নয়, এর সর্বজনীন রূপ দিতে হবে। এর জন্য বাংলার সর্বস্তরের লোকজনের মনের মধ্যে বাঙালিয়ানা চেতনাবোধ ফিরিয়ে আনতে হবে। এই কর্মযজ্ঞে অগ্রগামীদের কাতারে সর্বাগ্রে সংস্কৃতিকর্মী ও সংস্কৃতিবান বুদ্ধিবৃত্তিক মহলকে বিশেষ ভূমিকা নেয়া প্রয়োজন। তাঁদের বলিষ্ঠ পদক্ষেপই পারবে বাঙালিয়ানার ঐতিহ্যবাহিকতাকে সর্বজানীনতায় রূপ দিতে। তাঁদের উদ্যোগ বিগত দিনে বিফলে যায়নি, এটুকু বলা যায়।
উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায়, ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান এবং ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের চারুকলা ইস্টিটিউটের পহেলা বৈশাখকে ঘিরে শোভাযাত্রা। এই দুটিই ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টিকারী কার্যক্রম, যা আজ অবধি ঐতিহ্যের সহিত চলমান রয়েছে। আবার বিশ্ব ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখতে পাই, বহু জাতি রাষ্ট্রের সফলতার পাশাপাশি তাদের ঐতিহ্যকে বিশ্বায়নে রূপ দিয়েছে। এর দৃষ্টান্ত হিসেবে চীনের ঐতিহ্যের বিশ্বায়নকে দেখা যেতে পারে।
আমরা যদি চীনের দিকে তাকাই, তাহলে দেখতে পাবো তার ঐশ্বর্য, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত এবং ভূরাজনীতিসহ বিশ্বরাজনীনিতে চীনের আধিপত্য। খুব বেশি দিনের কথা নয় তাদের এই পরিবর্তনের। আজ থেকে প্রায় ষাট বছরের পূর্বের ইতিহাস। ১৯৫৯ সাল, চীনে দেখা দিয়েছিল দুর্ভিক্ষ। সেই দুর্ভিক্ষে প্রায় ৩ কোটি চীনা নাগরিক মারা যান। তখন গোটা চীনজুড়ে দেখা দিয়েছিল চরম খাদ্যাভাব। রাষ্ট্রযন্ত্র বেশ বেকায়দায়, কীভাবে এই সংকট হতে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে তা নিয়ে। দেশের রাষ্ট্রীয় কর্তাবর্গেরও চিন্তার অবকাশ নেই। তাদের কাছে বিশাল চ্যালেঞ্জ, কেমন করে এর সুরাহা করা যায়। যেভাবেই হউক, এই সংকট কাটিয়ে উঠতেই হবে। বিশাল জনসংখ্যার রাষ্ট্র, আবার বিশ্ব রাজনীতি দুটি মেরুতে দ্বিখ-িত। একদিকে গণতন্ত্রপন্থী মার্কিন ব্লক, অপরদিকে সমাজতন্ত্রপন্থী। এই পরিস্থিতিতে সর্বস্তরের জনগণসহ রাষ্ট্রীয় কর্তাবর্গের ক্লান্তিহীন কর্মপরিকল্পনায় সফল হতেই হবে দুর্যোগের ভয়াবহ ছোবলের হাত থেকে। সেই ভয়াবহতাকে শক্ত হাতে দমন করতে তারা ছিল বদ্ধপরিকর। চাইনিজদের কঠোর পরিশ্রম ও ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় প্রায় ষাট বছরের ব্যবধানে আজ তারা সফল (সূত্র : উইকিপিডিয়া, ইন্টারনেট)।
রাষ্ট্রীয় সকল সেক্টরে তারা বিশ্বের প্রতিনিধিত্বকারী। চীনের প্রযুক্তিগত বিপ্লবের কারণে স্বল্পমূল্যের মুঠোফোন আবিষ্কার হওয়ায় স্বপ্নিল পৃথিবী এখন প্রত্যেকের দোরগোড়ায়। এতে বিশ্ববাসী পৃথিবীকে পেয়েছে হাতের মুঠোয় এবং চীনও অর্থনৈতিকভাবে হয়েছে সমৃদ্ধ। আর এই অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পেছনে রয়েছে অভ্যন্তরীন চাহিদা পূরণের ফল। চাইনিজরা শুধু ঐশ্বর্য, সাংস্কৃতিক, অর্থনীতি বা প্রযুক্তিগতভাবে নয়, বিশ্ব রাজনীতিতে আধিপত্যদানকারী রাষ্ট্র। বিশ্ব অর্থনীতিতে চীনের প্রভাবের ব্যাপকতা লক্ষণীয়। বিশ্ববাজারে সোনা, সব ধরনের ধাতব পণ্য, জ্বালানি তেলের দাম কমে যাবার কারণ হিসেবে চীনের বাজারে চাহিদা কম হওয়া। বিশ্ব অর্থনীতি ওঠা-নামার পেছনেও চীনের চাহিদা ও জোগানের ওপর নির্ভর করে। ভূরাজনীতির ক্ষেত্রে এশিয়ার মধ্যে চীন এক বড় ফ্যাক্টর। চাইনিজরা তাদের ছকে অন্যকে সহজেই প্রবেশের ছাড় দিতে নারাজ। ভূরাজনীতিতে এরূপ হবার কারণ, চীনের চারপাশে ১৫টি দেশের অবস্থান (বিশ্ব রাজনীতি অতীত ও বর্তমান : ড. সুলতান মাহমুদ)।
চীনের আরো একটি বিষয় লক্ষণীয়, তা হলো বিশ্ব দরবারে তাদের খাবারের প্রচলন সৃষ্টি করা। বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশেই রয়েছে চাইনিজ রেস্টুরেন্ট। সেই রেস্টুরেন্টগুলো যে চাইনিজরা খুলেছে তা কিন্তু নয়। যে দেশে রেস্টুরেন্টগুলো আছে, সেই দেশের ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করার উদ্দেশ্যে খুুলে থাকে। আমাদের দেশেও এর ব্যতিক্রম নয়, বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি জেলা শহরে ৫-১০টি করে চাইনিজ রেস্টুরেন্ট রয়েছে এবং উপজেলা শহরগুলোও পিছিয়ে নেই। রেস্টুরেন্টগুলোতে সানন্দে প্রবেশ করে খেয়ে থাকে চাইনিজ খাবার। চাইনিজ স্যুপ খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে আভিজাত্য প্রকাশ করে। কিন্তু চাইনিজদের স্যুপের ইতিহাস আভিজাত্যের নয়, দুর্ভিক্ষ ও তার পরবর্তী সময়ে খাদ্যাভাবে থাকা অবস্থায় দৈহিক পুষ্টি জোগান দেয়ার নিমিত্তে ব্যবহৃত স্যুপ যা কিনা সংকটাপন্ন পরিস্থিতির প্রতীক। তাদের স্যুপ ছিল মূলত রান্নার জন্য ব্যবহৃত শাকসবজি কাটার পর অতিরিক্ত অংশ ফেলে না দিয়ে সেগুলো ধুয়ে পরিষ্কার করে সিদ্ধ করার মাধ্যমে মূল খাবারের সাথে স্যুপ হিসেবে খেত। সেই স্যুপ আজ বিশ্ব দরবারে এক ফ্যাশনেবল খাবার। এই স্যুপ চীনা নাগরিকরা দারিদ্র্যের প্রতীক হিসেবে বিবেচনা না করে, তারা ঐতিহ্যের প্রতীক ভেবে থাকে।
আমাদেরও ঐতিহ্য রয়েছে। শুধু ঐতিহ্য বলব কেন, ঐতিহ্যভা-ার বলাই শ্রেয়। পরাধীনতা থেকে মুক্তির গৌরবময় ইতিহাস, প্রাকৃতিক সম্পদেও কম নয়। আবার শিল্প-সংস্কৃতির দিক বিবেচনায় বাংলা ঐতিহ্যম-িত এবং প্রাচীন ঐতিহ্য ও সর্বজনীনতার ছাপ রয়েছে। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর পরাধীনতা থেকে মুক্তি পাবার সংগ্রাম আামাদের অহংকার। প্রায় নয় মাস যুদ্ধ করে বাংলার সূর্যসন্তানরা ছিনিয়ে এনেছে স্বাধীনতা। বাংলাকে দিয়েছে পৃথিবীর বুকে নতুন গৌরবময় মানচিত্র। বাঙালি হয়েছে পরাধীনতার কবল থেকে মুক্ত। স্বাধীনতার অর্জন বাঙালির শুধু গর্বের বিষয়ই নয়, অত্যন্ত গৌরবের ও অহংকারের।
পৃথিবীর কোনো জাতি তাদের স্বাধীকার আন্দোলনে উজ্জীবিত হয়ে এত কম সময়ের মধ্যে পরাধীনতার কবল থেকে মুক্ত হতে পারেনি। এই বিশাল অর্জনে বাংলাদেশকে পেতে হয়েছে অনেক বড় কষ্ট। কষ্টার্জিত স্বাধীনতা আনতে বাংলাদেশকে স্মরণীয় আত্মত্যাগ করতে হয়েছে। পরাধীনতার শিকল হতে মুক্তি পাবার জন্য হারাতে হয়েছে ত্রিশ লাখ সন্তান, দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম, অসংখ্য বুদ্ধিজীবীকে। এত কিছু বিসর্জন দিতে হয়েছিল বাংলাদেশকে। কারণ, পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর সহযোগী হিসেবে কাজ করেছিল এই দেশেরই একশ্রেণী সুবিধাবাদী জনগণ। তথাপিও বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, ফিরেছে মাতৃভাষা ও মাতৃভূমি এবং রক্ষা পেয়েছে বাংলার শিল্প-সংস্কৃতি-ঐতিহ্য।
বাংলা ভাষার ব্যবহার সর্বজনীন হওয়ায় এদেশের শিল্প-সংস্কৃতি সম্ভ্রান্ত হয়েছে। সাংস্কৃতিক অঙ্গনে মাটির গান, আঞ্চলিক সংস্কৃতি পরিবেশনার মাধ্যমে দেশের সকল স্তরের দর্শকশ্রোতাদের মন ছুঁয়ে যায়। আব্দুল কুদ্দুস বয়াতীর মতো স্বনামধন্য শিল্পীরা বাংলার লোকগানকে বিশ্ব সাংস্কৃতিক অঙ্গনে তুলে ধরেছেন। তেমনিভাবে বাংলার চিত্রকলাকেও বিশ্ব দরবারে তুলে ধরতে যাঁরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে গেছেন তাঁদের মধ্যে অগ্রজরা হলেন- জয়নুল আবেদীন, এসএম সুলতান, রফিকুন নবী, গোলাম মুর্তজা প্রমুখ।
এছাড়াও গ্রামবাংলার সংস্কৃতিও কম সমৃদ্ধি নয়। সেই গ্রামীণ সংস্কৃতির এক বড় অংশজুড়ে রয়েছে গ্রামীণ মেলা। মেলাগুলোয় দেশীয় চিত্রকর্ম প্রদর্শন, ঐতিহ্যবাহী খাবার বিকিকিনিসহ গ্রামীণ সাংস্কৃতিক আয়োজন পরিবেশন হয়ে থাকে, যার মাধ্যমে গ্রামীণ জনগণের মাঝে আনন্দময় মিলন ঘটে।
প্রাচীনকাল হতে গ্রামবাংলায় বিভিন্ন উৎসবকে কেন্দ্র করে মেলা বসে থাকে, যার মাধ্যমে সেই অঞ্চল চিত্তবিনোদনসহ স্থানীয় ব্যবসা-বাণিজ্য হয়। এইগুলো গ্রামীণ ঐতিহ্যকে বহন করে থাকে। বাংলার বিভিন্ন উৎসব উদ্যাপনে ফিরে পায় প্রাচীন ঐতিহ্যবাহিকতা। বর্তমানে বর্ষবরণ উৎসব একটি সর্বজনীন বাংলার উৎসব।
বর্ষবরণ উৎসবের মূল আকর্ষণ ঐতিহ্যবাহী পান্তা-ইলিশ। এই উৎসবে আয়োজনকৃত পান্তা-ইলিশ সকলে সানন্দে খেয়ে থাকে। বাঙালির বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে কেনইবা আয়োজন করা হবে না পান্তা-ইলিশ, না হলে যে উৎসবটিতে পানসেভাব বিরাজ করবে। বাংলার বর্ষবরণে পান্তা-ইলিশ দৃশ্যত হবার কারণ আমরা বাঙালি। যদিও ইলিশ এখন অনেকের কাছে ‘সোনার হরিণ’।
আর বাঙালিকে বলা হয় ‘মাছে-ভাতে বাঙালি’। মাছে-ভাতে বাঙালি বলার যথার্থতা রয়েছে এজন্য যে, বাঙালির খাদ্যাভ্যাসে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগলেও পরম্পরার পরিবর্তন হয়নি। প্রতিটি দেশ বা অঞ্চলের খাদ্যাভ্যাসের ধরন গড়ে ওঠে সেখানকার উৎপাদিত খাদ্যসামগ্রীর প্রতুলতার ওপর। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম নয়। প্রতুলতার বিবেচনায় এদেশে প্রচুর মাছ ও প্রধান শস্য হিসেবে ধান উৎপাদন হয়। তা হবার কারণও রয়েছে।
ভৌগোলিক দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশের অবস্থান হিমালয়ের দক্ষিণে। হিমালয়ের হিমবাহ হতে সৃষ্ট নদী প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নদী-নালা, খাল-বিল সৃষ্টির মধ্য দিয়ে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে। এইসব জলাশয়ের কারণে বাংলায় বিভিন্ন প্রকার প্রচুর মাছ পাওয়া যায় এবং মাছ সংগ্রহ, চাষ ও বিকিকিনির জন্য এক পেশাজীবী শ্রেণী কর্মব্যস্ত। অপরদিকে বঙ্গোপসাগরে প্রচুর পরিমাণে ইলিশ মাছসহ অন্যান্য মাছ পাওয়া যায়, এই মৎস্য সম্পদের ক্ষেত্রে ইলিশ বাংলার ঐতিহ্যের স্মারক। বঙ্গোপসাগরের ইলিশ মাছ বাংলাদেশের বাইরের অন্যান্য দেশে ব্যাপক সমাদৃত এবং দেশের অভ্যন্তরেও এর চাহিদা অনেক। এই মৎস্য সমৃদ্ধির ফলে এই অঞ্চলের জনগণের মধ্যে খাদ্যাভ্যাসে মাছের উপস্থিতি বিরাজমান।
অপরদিকে হিমালয় হতে সৃষ্ট নদীর দ্বারা পলি প্রবাহিত হওয়ায় এদেশে জমি ধান চাষের জন্য উর্বর ক্ষেত্র। তাই প্রচীনকাল হতে বাংলাদেশে প্রচুর পরিমানে ধান উৎপাদন হয়। অধিক উৎপাদিত শস্য ধান হওয়ায় বাঙালির প্রধান খাদ্য ভাত। ফলে এই অঞ্চলের মানুষ ভাত রান্না করার পর খেয়ে-দেয়ে অতিরিক্ত ভাত থাকলে তা সংরক্ষণের জন্য ভাতের সাথে পানি দিয়ে রেখে দিত। সেই পানি দিয়ে রেখে দেয়া ভাতই হচ্ছে পান্তাভাত, যা কিনা সকালের নাস্তা হিসেবে বাংলার মানুষ খেয়ে থাকত বা এখনো কেউ কেউ খেয়ে থাকেন।
বর্তমানে এর কিছু পরিবর্তন ঘটেছে। বাঙালিদের মাঝে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগায় অনেকে নিজেদের ‘ঐতিহ্যবাহী পান্তাভাত’কে দরিদ্রতার প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করতে দ্বিধাবোধ করে না। অথচ চাইনিজরা স্যুপকে এক বিশেষ অবস্থানে নিয়ে গেছে। কিন্তু, কেন যে ‘পান্তাভাতা’কে সেইরূপ অবস্থানে নিয়ে যেতে পারছি না, সেটাই একটা বড় প্রশ্ন? একটু ভেবে দেখা যায়, পান্তাভাতকে চাইনিজ স্যুপের ন্যায় সকলের মাঝে দ্রুত ছড়িয়ে দেবার মতো হোটেল-রেস্টুরেন্টের প্রতুলতা রয়েছে। পান্তাভাত এখন শুধু একটি দিননির্ভর উৎসবের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে।
অপরদিকে লক্ষ্য করলে দেখতে পাওয়া যায়, মোড়ের প্রতিটি দেশীয় রেস্টুরেন্টগুলোয় হরহামেশাই সকালের নাস্তা হিসেবে পরোটা, খিচুড়ি, রুটি, লুচি ইত্যাদি প্রচুর পরিমাণে বেচাকেনা হচ্ছে। এইসব খাবার গ্রহণের পর অনেকের মনে আভিজাত্যের দোলা লাগে। আবার পান্তা খাবার কথা বললে গ্রহণে অনীহা প্রকাশ পায় বা তা দরিদ্রতার প্রতীক বিবেচনা করে থাকে। আমাদের নাস্তায় পান্তাভাত খেতে অনাগ্রহতা দেখে আজ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচিত ‘কেরোসিন-শিখা বলে মাটির প্রদীপে- / ভাই ব’লে ডাক যদি দেব গলা টিপে। / হেনকালে গগনেতে উঠিলেন চাঁদা; / কেরোসিন বলি উঠে, এসো মোর দাদা।।- পংক্তিটি বারবার মনে পড়ছে।
বরং পান্তাভাতের বিশেষ মর্যাদাদানের লক্ষে বা দেশীয় ঐতিহ্যতাকে সম্মান দেওয়ার উদ্দেশ্যে অনেকদিন আগে থেকে এর প্রচলন শুরু হয়েছে। মোঘল শাসনামলে সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের সদস্যরা মুক্ত অনুষ্ঠানের আয়োজন করলে সেই অনুষ্ঠানে আগত দর্শক-শ্রোতাদের ঐতিহ্যবাহী পান্তাভাত খাওয়ানো হতো। বিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে শহুরের বাঙালি নববর্ষ উদ্যাপন শুরু করলে বাঙালিয়ানার প্রতীক হিসেবে ইলিশ মাছের সাথে পান্তাভাত খাওয়ার রেওয়াজ চালু হয়। এরই ধারাবাহিকতায় একুশ শতাব্দীর প্রথম দশকে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে সকালে ইলিশ মাছের সাথে পান্তাভাত খাওয়া বাঙালি সংস্কৃতির সাথে যুক্ত হয়ে যায়।
যদি আমরা এই সংস্কৃতি দেশের সর্বস্তরে সানন্দে গ্রহণ করি, তবে এই বাঙালিয়ানা ঐতিহ্য পান্তাভাত, খুব দ্রুতই বিশ্বদরবারে ছড়িয়ে দেয়া সম্ভব। তার কারণে হিসেবে ২০২১ সালের ১৩ জুলাই প্রকাশিত বিবিসি বাংলার অনলাইন ভার্সনের নিউজটি উল্লেখ করা যায়। নিউজে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের গ্রামবাংলার মানুষের আবহমানকালের খাবার পান্তা-ভাত আর আলুভর্তা পরিবেশন করে রান্না বিষয়ক একটি জনপ্রিয় রিয়েলিটি শো মাস্টারশেফ অস্ট্রেলিয়ায় তৃতীয় স্থান অধিকার করেছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কিশোয়ার চৌধুরী। এই প্রতিযোগিতায় ফাইনাল ডিশ রান্না নিয়ে কিশোয়ার চৌধুরী বিচারকদের বলেন যে, প্রতিযোগিতায় এমন রান্না সত্যিই চ্যালেঞ্জের। সাধারণ রেস্টুরেন্টে এমন রান্না হয় না। কিন্তু বাঙালির কাছে এটা পরিচিত রান্না। এরপর বিচারকেরা এই রান্না দেখে ও খেয়ে রীতিমতো অভিভূত হয়ে পড়েন।’
এ ঘটনা থেকে উপলব্ধি করা যায় যে, বিশ্বায়নের ভিড়ে বাঙালিয়ানার ঐতিহ্যকে খুব সহজেই বিশ্বদরবারে পৌঁছানো যাবে।
প্রাচীন ঐতিহ্য পান্তাভাত খাবার প্রচলন আধুনিকতার ভিড়ে হারিয়ে যাচ্ছে। এখন কেবল বর্ষবরণের আয়োজনে উপস্থিত থাকে। এই প্রাচীন দেশীয় ঐতিহ্যকে পুনরুদ্ধার বা সর্বজনীন রূপ দিতে হলে সাংস্কৃতিক কর্মী ও সাংস্কৃতিক পৃষ্ঠপোষক সংস্থা এবং সর্বোপরি সংস্কৃতিবান বৃদ্ধিবৃত্তিক মহলের আন্তরিক প্রচেষ্টা জরুরি। কারণ তাঁদের প্রেরণায় বাঙালির চেতনায় জাগ্রত হয়েছে বিগত ঐতিহ্যবাহিকতা এবং পুনরায় সকালের নাস্তায় পান্তাভাতের ঐতিহ্যতা সর্বজনীনতায় রূপ নিবে- এটাই আমার বিশ্বাস।

মোস্তাক হোসেন : লেখক ও সহকারী প্রধান শিক্ষক, পলশা উচ্চ বিদ্যালয়

About The Author

শেয়ার করুন