বঙ্গবন্ধু হবার গল্প

169

এ কে এম তাজকির-উজ-জামান

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন আদর্শ, কর্ম আর কার্যকাল নিয়ে বিস্তর লেখালেখি হয়েছে। হয়েছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। নানান দিক থেকে আলোচনা আর তার মূল্যায়ন সেসব লেখাকে করেছে আকর্ষণীয়। ব্যক্তি হিসেবে, একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে বঙ্গবন্ধু ছিলেন আপন মর্জির মালিক। নিজের অন্তর আত্মার কাছে তাঁর দায়বদ্ধতার একমাত্র প্রকাশ ছিল জনগণের মঙ্গল কামনা। মানুষকে ভালোবেসে তিনি অমরত্ব পেয়েছেন ঠিকই; কিন্তু বারবার বিশ্বাসভঙ্গের বেদনায় সিক্তও হয়েছেন। একজন সংগঠক, রাজনৈতিক কর্মী আর খাঁটি দেশপ্রেমিক হিসেবে স্বাধীনতার জন্য তিনি নিবিড়ভাবে কাজ করে গেছেন।
ব্রিটিশ গোলামিকে খেদিয়ে স্বপ্নের পাকিস্তান দেখা দেয় দুঃস্বপ্ন হিসেবে। আর তা এতটাই ভয়াবহ যে, পাকিস্তানি ২৪ বছরের শাসনামল ব্রিটিশদের ২০০ বছরের বঞ্চনাকেও হার মানায়। আজ সে সময় মোহভঙ্গের বেদনা আর আগুনে পুড়ে খাঁটি সোনার মতই বাংলার রাজনৈতিক আকাশে শেখ মুজিবুর রহমান নামে এক নক্ষত্রের উদয় হলো। এক বজ্রকণ্ঠ নিয়ে, নিজেই নিজেকে ছাড়িয়ে উপস্থাপন করেছিলেন স্বাধীনতার ভিত্তিপ্রস্তর ‘ছয় দফা’। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় এই ছয় দফাই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সবচেয়ে সুচিন্তিত রাজনৈতিক দলিল। এর প্রতিটি দফা ছিল বাঙালির প্রাণের কথা। দেশ বিভাগের জন্য ১৯৪০-এ শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের তুমুল জনপ্রিয় আর নন্দিত লাহোর প্রস্তাবের পূর্ণ সুবিধা নিয়ে জিন্নাহ গড়ে তোলেন পাকিস্তান। রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানের জন্ম ইতিহাস ছলচাতুরিতে ভরা। তাই বিস্তর ভৌগোলিক ও সামাজিক দূরত্ব ক্রমান্বয়ে বেড়েই গেছে- কমেনি এতটুকুও। প্রথম আঘাত আসে ভাষার প্রশ্নে। উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ষড়যন্ত্রে ব্যর্থ পাকিস্তানি শাসকদের অভিমত ছিল- বাংলা হিন্দুদের ভাষা। ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি, শিক্ষা, প্রতিরক্ষার মতো বিষয়গুলোতে পূর্ব-পাকিস্তান উপেক্ষিত হতে থাকল প্রবলভাবে। এ-দেশের সম্পদ ও-দেশে নিয়ে গিয়ে প্রভুত্ব আর দাসত্বের নতুন ইতিহাস রচিত হতে থাকে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর বছর না যেতেই রাজস্ব করের ভাগাভাগি, ভাষার দাবি, কেন্দ্রীয় সরকারের অবহেলা এবং পশ্চিম পাকিস্তানিদের কথাবার্তা ও আচরণে এক অসহ্য শ্রেয়মন্যতা লক্ষ করে পূর্ববঙ্গের মানুষ তিক্ত হয়ে ওঠে এবং স্বকীয়তা-স্বাতন্ত্র্যে সোচ্চার হয়।
১৯৬৫-এর পাক-ভারত যুদ্ধে পূর্ব-পাকিস্তানের জনগণ নতুনভাবে উপলব্ধি করে তাদের নিরাপত্তাহীনতা। অনেকটা ভারতের দয়াতেই সেই যুদ্ধে এই অঞ্চল থাকে সুরক্ষিত, কেননা তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য আক্রমণ সেই সময় পূর্ব-পাকিস্তানে হয়নি। লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পাকিস্তান সৃষ্টি হলেও পূর্ব পাকিস্তানকে স্বায়ত্তশাসনের অধিকার দেয়া হয়নি। পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা সমগ্র পাকিস্তানের জনসংখ্যার শকতরা ৫৬ ভাগ হওয়া সত্ত্বেও এ অঞ্চল থেকে জনসংখ্যা অনুপাতে আইন সভা ও শাসন ব্যবস্থার প্রতিনিধিত্বের অধিকার দেয়া হয়নি। ১৯৪৭-১৯৫৮ সাল পর্যন্ত ৪ জন রাষ্ট্রপ্রধানের মধ্যে মাত্র ১ জন ছিলেন পূর্ব-পাকিস্তানের এবং তিনিও ছিলেন উর্দুভাষী। ১৯৫৮ সালে যে শাসনতন্ত্র চালু হয়েছিল তা পশ্চিম পাকিস্তানিরা বাতিল করে সামরিক শাসন জারি করে। পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে অর্থনৈতিক ব্যবধান বাড়তে থাকে। শুধু অর্থনৈতিক নয়, রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, সামরিক ও সাংস্কৃতিক ব্যবধানও বাড়তে থাকে। প্রশাসনিক বৈষম্যও ছিল দুই প্রদেশের মধ্যে প্রবল। সামরিক ও বেসামরিক চাকরিতে নিয়োগের ব্যাপারে বৈষম্য ছিল তীব্রতর। পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি অর্থনৈতিক বৈষম্য ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। মুদ্রা ও অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে। সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, স্টেট ব্যাংক ও অন্যান্য ব্যাংকসমূহের হেড অফিস পশ্চিম পাকিস্তানে থাকায় অর্থ পাচার হতো অবাধ গতিতে। উদ্বৃত্ত আর্থিক সঞ্চয় পশ্চিম পাকিস্তানে জমা থাকত। যার কারণে পূর্ব পাকিস্তানে মূলধন গড়ে ওঠেনি। মোট রাজস্বের শতকরা ৯৪ ভাগ পশ্চিম পাকিস্তানে খরচ হতো। বিদেশী মিশনগুলো পশ্চিম পাকিস্তানে থাকায় ঐ অঞ্চলের আয় বেড়েই চলছিল। এছাড়া পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের মাথাপিছু আয় পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের চেয়ে দ্বিগুণ ছিল। এছাড়া পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষা, কৃষি ও বিদ্যুৎ ইত্যাদি বিষয়ে বরাবরই উদাসীন ছিল। ঠিক সেই সময়ে শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফা দাবি প্রণয়ন করেন। মূলত পশ্চিম পাকিস্তানের অধীনে এটি ছিল ফেডারেল ব্যবস্থার নতুন কাঠামো।
৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৬, লাহোরে শেখ মুজিব ছয় দফা দাবি উত্থাপন করেন। তাঁর নিজের নামে ‘আমাদের বাঁচার দাবি : ছয় দফা কর্মসূচি’ শীর্ষক পুস্তিকা তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে প্রচার করেন। সে সময় তাঁর প্রচারে পাশে পান দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার সম্পাদক তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়াকে। সারা পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিটি জায়গায় ছয় দফার কর্মসূচি, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য সম্পর্কে জনমত গড়ে তোলেন। ১১ ফেব্রুয়ারি তিনি ঢাকায় ফিরে আসেন। বিমানবন্দরেই তিনি সাংবাদিকদের সামনে ছয় দফা সংক্ষিপ্তাকারে তুলে ধরেন। ছয় দফার মূল কথাই ছিল- ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে ফেডারেল সরকার পদ্ধতি। কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে দেশরক্ষা ও বৈদেশিক নীতি সীমাবদ্ধ থাকবে এবং বাকি সব নীতি অঙ্গরাষ্ট্রগুলো প্রণয়ন ও পরিচালনা করবে। ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৬, সংবাদপত্রে এই শাসনতান্ত্রিক প্রস্তাব প্রকাশিত হয়। পূর্ব পাকিস্তানের আইন ও পার্লামেন্টারি দপ্তরের মন্ত্রী আবদুল হাই চৌধুরী ছয় দফাকে দেশদ্রোহের নামান্তর বলে অভিহিত করেন। প্রাদেশিক কাউন্সিলে মুসলিম লীগের জেনারেল সেক্রেটারি শফিকুল ইসলাম এবং এম এন এ খাজা খায়রুদ্দিন এক সংবাদ সম্মেলনে ছয় দফাকে বিপজ্জনক বলে বিশেষিত করেন। আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির পূর্বানুমোদন ছাড়াই শেখ মুজিব একটা অসম সাহসী কাজ করেন। দলের অভ্যন্তরে বিরোধিতা মোকাবেলা করার জন্য তিনি কর্মীদের দিয়ে ঢাকা শহরের দেয়ালে দেয়ালে পোস্টার সাঁটিয়ে দিলেন, ‘বাঙালির দাবি ছয় দফা’। পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন কেবল ছয় দফা দ্বারা নিশ্চিত হতে পারে। কার্যনির্বাহী কমিটির অধিবেশন ২১ ফেব্রুয়ারি নির্দিষ্ট হয়। ওই দিন শহীদ দিবসে আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক আবদুল মোমেন ছয় দফা সম্পর্কে একটি পুস্তিকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মধ্যে প্রচার করেন। সে অবস্থায় ছয় দফার দাবি অনুমোদন করা ছাড়া কারো কোনো গত্যন্তর ছিল না। আওয়ামী লীগের কার্যকরী কমিটিতে ছয় দফা দাবি পাস করা হয়। লাহোর থেকে ফেরার পর ১৯৬৬ সালের মার্চ মাসের তৃতীয় সপ্তাহে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন হয়। যেখানে শেখ মুজিবুর রহমান সভাপতি এবং তাজউদ্দীন আহমদ সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এই সম্মেলনে আনুষ্ঠানিকভাবে ছয় দফা গৃহীত হয়। পুস্তিকা, লিফলেট, পোস্টার ইত্যাদির মাধ্যমে ছয় দফা দাবিনামা জনগণের কাছে তুলে ধরা হয়। শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ছয় দফার পক্ষে দেশব্যাপী প্রচারাভিযান শুরু করে আওয়ামী লীগ। বাংলার মানুষ ব্যাপকভাবে ছয় দফার প্রতি সমর্থন জানান।
১০ মার্চ ১৯৬৬, প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান হুমকি দিয়ে বলেন, ছয় দফার ব্যাপারে আওয়ামী লীগ চাপাচাপি করলে অস্ত্রের ভাষায় জবাব দেয়া হবে এবং দেশে গৃহযুদ্ধ হয়ে যাবে। সরকার সর্বতোভাবে ছয় দফার বিরোধিতা করে। পশ্চিম পাকিস্তানি পত্রপত্রিকায় ছয় দফার বিবরণ ছাপিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানকে বিচ্ছিন্নতাবাদীরূপে চিত্রিত করা হয়। পশ্চিম পাকিস্তানের সংবাদপত্রের শিরোনাম ‘নয় ছয়’ দফা। ছয় দফা দাবি ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। জুলফিকার আলী ভুট্টো প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের অনুগ্রহ পুনরুদ্ধারের জন্য ছয় দফার ওপর প্রকাশ্য এক বিতর্কে শেখ মুজিবকে চ্যালেঞ্জ করেন। বিতর্কের দিন ভুট্টো ব্যস্ততার কারণ দেখিয়ে উপস্থিত না থাকায় আওয়ামী লীগের নৈতিক জয় হয়। ১৯৬৬ সালের এপ্রিল, মে ও জুনে ছয় দফার দাবিকে কেন্দ্র করে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে দুর্বার আন্দোলন গড়ে ওঠে পূর্ব পাকিস্তানে। জনগণের কাছে বিপুল সমাদৃত ছয় দফা দাবি ছিল নি¤œরূপ :
১. লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে সংবিধান রচনা করে পাকিস্তানকে একটি ফেডারেশনে পরিণত করতে হবে, যেখানে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার থাকবে এবং প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকদের ভোটে নির্বাচিত সংসদ ও রাজ্য পরিষদসমূহ সার্বভৌম হবে;
২. ফেডারেল সরকারের হাতে থাকবে শুধু দুটি বিষয় প্রতিরক্ষা ও বৈদেশিক সম্পর্ক;
৩. পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য দুটি পৃথক অথচ সহজে বিনিময়যোগ্য মুদ্রা চালু করতে হবে। মুদ্রাব্যবস্থা আঞ্চলিক সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকবে এবং দুই অঞ্চলের জন্য দুটি আলাদা স্টেট ব্যাংক থাকবে অথবা সমগ্র পাকিস্তানের জন্য ফেডারেল সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন একটি মুদ্রাব্যবস্থা থাকবে, একটি ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক ও দুটি আঞ্চলিক রিজার্ভ ব্যাংক থাকবে। তবে এ ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তান থেকে পুঁজি যাতে পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার হতে না পারে, তার ব্যবস্থাসংবলিত সুনির্দিষ্ট বিধি সংবিধানে সন্নিবিষ্ট করতে হবে;
৪. সব ধরনের কর ও শুল্ক ধার্য ও আদায় করার ক্ষমতা থাকবে আঞ্চলিক সরকারের হাতে। তবে রাজ্যের আদায়কৃত অর্থে কেন্দ্রের নির্দিষ্ট অংশ থাকবে এবং আদায়ের সঙ্গে সঙ্গেই সে অংশ ফেডারেল তহবিলে জমা হবে। এ অর্থেই ফেডারেল সরকার চলবে;
৫. দুই অঞ্চলের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পৃথক হিসাব থাকবে এবং অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা রাজ্যের হাতে থাকবে। তবে ফেডারেল সরকারের জন্য প্রয়োজনীয় মুদ্রা দুই অঞ্চল থেকে সমানভাবে কিংবা উভয়ের স্বীকৃত অন্য কোনো হারে আদায় করা হবে;
৬. প্রতিরক্ষায় পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাবলম্বী করার লক্ষ্যে আধা সামরিক রক্ষী বাহিনী গঠন, পূর্ব পাকিস্তানে অস্ত্র কারখানা স্থাপন এবং কেন্দ্রীয় নৌবাহিনীর সদর দপ্তর পূর্ব পাকিস্তানে স্থাপন করতে হবে।
শেখ মুজিব ছয় দফার পক্ষে জনমত সৃষ্টির উদ্দেশ্যে সারা বাংলায় জনসংযোগ শুরু করেন। এ সময় তাঁকে খুলনা, যশোর, সিলেট, ময়মনসিংহ ও ঢাকায় বার বার গ্রেপ্তার করা হয়। বছরের প্রথম তিন মাসে তিনি আটবার গ্রেপ্তার হন। ৮ মে ১৯৬৬, নারায়ণগঞ্জ পাটকল শ্রমিকদের এক বিশাল সমাবেশে শেখ মুজিব তাঁর ভাষণে সরকারের দমননীতির কঠোর সমালোচনা করেন। ওই দিনই দেশরক্ষা আইনে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। ৭ জুন শেখ মুজিব ও আটক নেতৃবৃন্দের মুক্তির দাবিতে সারা দেশে ধর্মঘট পালিত হয়। ধর্মঘটের সময় ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও টঙ্গিতে পুলিশের গুলিতে শ্রমিক নেতা মনু মিয়াসহ বেশ কয়েকজন নিহত হন এবং বহু নেতাকর্মী আহত হন। পুলিশ দেড় হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করে। দুপুরে আদমজি, সিদ্ধিরগঞ্জ ও ডেমরা এলাকার শ্রমিকরা ১৪৪ ধারা লঙ্ঘন করে শোভাযাত্রা সহকারে ঢাকা অভিমুখে অগ্রসর হতে থাকে। ইপিআর বাহিনী একটি শোভাযাত্রায় গুলিবর্ষণ করে। বেলা ১১টায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। হরতালের পরের দিন গুলিতে আহত একজনের মৃত্যু হয়। সরকারি ভাষ্য অনুসারে, ১১ জনের মৃত্যু স্বীকার করে; কিন্তু নিহতের সংখ্যা বেশি ছিল। ঐ দিন সন্ধ্যার পর সরকার কারফিউ জারি করে। তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়াকে আইয়ুব-মোনেম চক্রের নির্দেশে পুলিশ ১৬ জুন ধানমন্ডিস্থ বাসভবন থেকে গ্রেপ্তার করে। একই দিনে দৈনিক ইত্তেফাকের প্রেস ১নং রামকৃষ্ণ মিশন রোডস্থ ‘নিউনেশন প্রিন্টিং প্রেস’ বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করে। সরকার শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে একের পর এক হীন ষড়যন্ত্র করতে থাকে। ২০ মাস জেলে আটক রাখার পর ৩ জানুয়ারি ১৯৬৮ তাঁকে এক নম্বর আসামি করে সশস্ত্র বাহিনীর ৩৫ জন বাঙালি সদস্য ও সিএসপি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার অভিযোগে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা দায়ের করে।
সেই ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ ইতিহাসের আরেক অধ্যায়। বঙ্গবন্ধু ও অন্য অভিযুক্তদের সাধারণ কারাগারে থেকে ঢাকা সেনানিবাসে নিয়ে আটক করা হয়। ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব’ শিরোনামে সেই মামলায় বিচারের বিবরণ পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকলে শেখ মুজিবের প্রতি সব শ্রেণি-পেশার মানুষের গভীর সহানুভূতি সৃষ্টি হয় এবং গড়ে ওঠে তাঁর এক মহানায়কের ভাবমূর্তি। আগরতলা মামলা প্রত্যাহার ও আইয়ুব সরকারের পতনের লক্ষে নভেম্বর-ডিসেম্বর থেকে ছাত্র-যুব-শ্রমিক- পেশাজীবীদের দুর্বার আন্দোলন শুরু হয়। ওই মামলা থেকে তিনি আদালতের রায়ে মুক্তি পাননি, বাংলার মানুষ তাদের প্রিয় বন্ধুকে শত্রুর থাবা থেকে ছিনিয়ে আনে গণঅভ্যুত্থান ঘটিয়ে। ২২ ফেব্রুয়ারি তিনি মুক্তি পান। ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯, সরকার আগরতলা মামলা প্রত্যাহার করে। পরের দিন কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি প্রদান করে। লক্ষণীয় যে, গঙ্গা-যমুনা-মেঘনার দেশের নেতাকে সেই দেশের ভাষায় সম্মাননায় ভূষিত করা হলো। যা তাঁকে বিভাময় করে তোলে। ৭ জুন ১৯৭০, শেখ মুজিব ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে এক বিশাল জনসভায় ঘোষণা দেন, ‘আসন্ন সাধারণ নির্বাচনে হবে ছয় দফার প্রশ্নে এক গণভোট’। সেই জনসভায় প্রথমবারের মতো শেখ মুজিব ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি উচ্চারণ করলেন। ১৯৭০ সালে ছাত্রদের যে স্লোগান ছিল “হয় ছয় দফা, নয় এক দফা”, কয়েক সপ্তাহ পরেই তা পরিবর্তিত হলো “ছয় দফা নয়, এক দফা এক দফা”য়। ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিরাট বিজয় হয়। নির্বাচনের ফলাফলের পরিপ্রেক্ষিতে আমূল পরিবর্তনবাদী বাংলার তরুণেরা যে রণধ্বনি তুলেছিল, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’, সে এক অভিনব ব্যাপার। নির্বাচনে মেনিফেস্টো ছিল ছয় দফার প্রতিবিম্ব। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে ১৭ বছরের বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক চিন্তাধারার সারাৎসার অংশ তাঁর আমাদের বাঁচার দাবি ৬ দফা কর্মসূচি লেখাটি। প্রথম মুদ্রণের পর স্বাধীনতার আগেও এটি অনেকবার মুদ্রিত হয়েছে। ছয় দফার সংক্ষিপ্ত আকারের পুস্তিকাও প্রকাশ করা হয়। তবে প্রথম প্রকাশিত পুস্তিকাটির বক্তব্য মূল্যবান নানা কারণে। সাধারণ মানুষের বোধগম্য ভাষায় ‘আপনাদের ¯েœহধন্য খাদেম শেখ মুজিবুর রহমান’ লিখেছিলেন : “… আপনারা দেখিতেছেন যে, আমার ৬ দফা দাবীতে একটিও অন্যায়, অসংগত, পশ্চিম পাকিস্তানবিরোধী বা পাকিস্তান ধ্বংসকারী প্রস্তাব করি নাই। বরঞ্চ আমি যুক্তিতর্কসহকারে দেখাইলাম, আমার সুপারিশ গ্রহণ করিলে পাকিস্তান আরো অনেক বেশি শক্তিশালী হইবে। তথাপি কায়েমি স্বার্থের মুখপাত্ররা আমার বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার এলজাম লাগাইতেছে। … আমার দেশের প্রিয় ভাইবোনেরা, আল্লাহর দরগায় শুধু এই দোয়া করিবেন বাকী জীবনটা আমি যেন তাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তি সাধনায় নিয়োজিত করিতে পারি।”
শেখ মুজিবুর রহমান থেকে ‘বঙ্গবন্ধু’ শেখ মুজিবুর রহমান হবার এই অধ্যায় এর হাত ধরে এসেছে পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ। রচিত হয়েছে নতুন ইতিহাস, শোষণ বঞ্চনাকে পেছনে ফেলে স্বপ্ন দেখার সাহসে উজ্জীবিত বাঙালি খুঁজে পেয়েছে তার আত্মপরিচয়। ১৫ আগস্ট পাঠক যখন এই লেখা পড়ছেন তখন তাঁর দেখানো স্বপ্নে বিভোর এই বাঙালি লিখছেন স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনের গৌরবময় এক ইতিহাস। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টে এই দিনে তিনি ও তাঁর পরিবারবর্গের যে নৃশংস হত্যাকা- সংঘটিত হয়েছিল তার ঘৃণা জানানোর ভাষা নেই। তাঁর হত্যাকা-ে থমকে গিয়েছিল দেশ আর দেশের উন্নয়ন। কিন্তু ঘাতকদের স্বপ্ন পুরণ হয়নি। স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়েছে জাতির পিতার। দেশ আজ তার দেখানো পথে উন্নয়নের মহাসড়কে।
শোকের এই দিনে জাতির পিতার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।

এ কে এম তাজকির-উজ-জামান : অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক), চাঁপাইনবাবগঞ্জ