পাটের বহুমুখী ব্যবহার

69

সোনালি আঁশ পাটের বহুমুখী ব্যবহারের কথা প্রায়শই শোনা যায়। কিন্তু বাস্তবে সেই ব্যবহার দৃশ্যমান হয় না। অথচ পরিকল্পিতভাবে উদ্যোগ নেয়া হলে, ব্যবহারের ক্ষেত্র হতো প্রসারিত। বিপুল সম্ভাবনাময় পাট শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে স্বর্ণসূত্রের বৈচিত্র্যময় পণ্য উৎপাদনের বিকল্প নেই। স্থানীয় বাজারে ব্যবহারের বাইরে বিদেশী বাজারে পাটের চাহিদা বাড়ানোর কাজের গতি অত্যন্ত শ্লথ। অথচ এই পাটই একসময় ছিল দেশের প্রধান আয়ের উৎস। এ দেশের পাট বিদেশে বিক্রি করে পাকিস্তানী সরকার সে দেশের উন্নয়ন কাজে ব্যবহার করত। পূর্ববঙ্গ ছিল অবহেলিত। তারই উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্যও সে পেত না। এই বঞ্চনার বিষয়টি বাঙালীকে ক্ষুব্ধ করেছিল। তার সোনালি আঁশ তাই এখন যে গলার ফাঁসে পরিণত হয়েছে বিষয়টি বুঝতেও বেশ সময় লেগে যায়। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী বাংলার সব কলকারখানার যন্ত্রাংশ পাকিস্তানে পাচার করে, অনেক কারখানা ধ্বংস করে। স্বাধীনতার পর পরাজিত শক্তি, তাদের সহযোগী শক্তি, গণবাহিনী প্রভৃতি সশস্ত্র শক্তি পাটের গুদামে অগ্নিসংযোগ, কারখানা ধ্বংস করে পাট শিল্পের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করে। পঁচাত্তর পরবর্তী সামরিক জান্তা শাসকরা বেশির ভাগ পাটকল বিক্রি করে দেয় পানির দরে। আর জান্তার উত্তরসƒরিরা নব্বই দশকে এসে এশিয়ার বৃহত্তম পাটকল আদমজী জুট মিল বন্ধ করে দেয়। পাট কারখানাগুলো ধ্বংস পর্যায়ে থাকায় কৃষকরা পাট চাষ বন্ধ করে দেয়। পূর্ববঙ্গের প্রধান রফতানি আয়ের উৎস সোনালি আঁশকে বাংলাদেশে ধ্বংসের পর্যায়ে নিয়ে যায় সামরিক জান্তা ও তাদের উত্তরসƒরিরা। তারা পাটের বস্তা, ব্যাগের পরিবর্তে পরিবেশ দূষণকারী পলিথিনের উৎপাদন ও ব্যাপক ব্যবহারের পথ খুলে দেয়। ১৯৮২ সালে বাংলাদেশে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে পলিথিনের উৎপাদন শুরু হয়। পরে পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর আন্দোলনের মুখে ২০০২ সালে আইন করে নিষিদ্ধ করা হয়। পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ (সংশোধন ২০০২) এর অধীনে ২০০৭ সালে সরকার রেণু পোনা পরিবহন ও পণ্যের মোড়ক হিসেবে একটু মোটা ধরনের পুরুত্বের পলিথিন ব্যাগ উৎপাদনের অনুমতি দেয়। তবে শপিংব্যাগ হিসেবে পাতলা স্বচ্ছ পলিথিন ব্যবহারের অনুমতি নেই। কাগজের ঠোঙ্গা এখন অচল। কাপড়ের ব্যাগ মানুষ দাম দিয়ে নিতে চায় না বলে মার্কেটে পলিথিন বেশি পাওয়া যাচ্ছে। নিষিদ্ধ পলিথিনের উৎপাদন থেমে নেই। রাজধানীতেই সন্তর্পণে-সংগোপনে তৈরি হচ্ছে নিষিদ্ধ পলিব্যাগ। এই পলিব্যাগ পাট শিল্পকে ক্ষতিগ্রস্ত করায় যথেষ্ট অবদান রাখছে।শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতায় আসার পর পাট চাষ, পাট কারখানা ও বিপণনের ক্ষেত্রে গুরুত্বারোপ করে। পাটের জেনম আবিষ্কার করা হয়। সরকার পাট শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত সতেরো পণ্যের পাটের মোড়ক বাধ্যতামূলক ব্যবহার নিশ্চিত করেছে। তবে পলিথিন ও পলিব্যাগের মতো ক্ষতিকর পণ্যের ব্যবহার হ্রাস করে পরিবেশ রক্ষার কাজটি সুচারুরূপে করতে পারছে না। পরিবেশ অধিদফতরের অবহেলা, ঔদাসীন্য, দুর্নীতির বিস্তারের কারণে এই দশা হয়েছে। অথচ শেখ হাসিনার ঐকান্তিক ইচ্ছায় ও পাট মন্ত্রণালয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় ‘পণ্যে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন ২০১০’ এবং ‘পণ্যে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার বিধিমালা ২০১৩ প্রণীত হয়। যা সফলভাবে বাস্তবায়নে এগিয়ে যাচ্ছে। একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছয় মার্চকে ‘জাতীয় পাট দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করেছেন। সরকারের এসব সময়োচিত পদক্ষেপের ফলে কৃষক, শ্রমিক, ব্যবসায়ী, রফতানিকারক ও ভোক্তাসহ প্রায় চার কোটি মানুষের কর্মসংস্থানের বিপুল সম্ভাবনায় পাট খাতের জীবন ফিরে এসেছে। ধান, চাল, গম, ভুট্টা, সার ও চিনি সংরক্ষণ এবং পরিবহনে বাধ্যতামূলকভাবে পাটের ব্যাগ ব্যবহারের নির্দেশ দিয়ে ২০১৫ সালের ১৭ ডিসেম্বর আদেশ জারি করে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়। পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন পণ্যে পাটের মোড়ক ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়। ব্যবহার করা না হলে এক বছরের কারাদন্ড বা সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয়দন্ডের বিধান রয়েছে। একই অপরাধ দ্বিতীয়বার করলে সাজা হবে সর্বোচ্চ দন্ডের দ্বিগুণ। কিন্তু দেখা গেছে, আইন আইনের স্থানেই রয়েছে। বাস্তবে এই আদেশ নির্দেশ তেমন কার্যকর নয়। পলিব্যাগের চেয়ে পাটের ব্যাগের দাম বেশি থাকায় তা ব্যবহারে আগ্রহ কম। জাতীয় স্বার্থে পলিথিন ও পলিব্যাগের মতো ক্ষতিকারক পণ্যের হাত থেকে পরিবেশকে রক্ষা করা জরুরী।