পরিবেশ দূষণ ও সংরক্ষণে করণীয়

10

আসমা উষা

সেই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াকালীন থকেই পাঠ্যবইয়ের মাধ্যমে জেনে আসছি যে, পরিবেশের মূল উপাদান হলো তিনটিÑ মাটি, পানি ও বায়ু। যেগুলোর মাধ্যমেই একটি প্রাণীর অস্তিত্ব পরিবেশে বেঁচে থাকে। পাঠ্যবইয়ে এটাও জেনেছি যে, আমাদের চারপাশে যা কিছু আছে তা নিয়েই আমাদের পরিবেশ। গাছপালা, পাহাড়, জঙ্গল, পানি, বাতাস সবকিছুই প্রকৃতির দান। মানুষের বেঁচে থাকার জন্য এসব অতীব প্রয়োজন।
পরিবেশ বা প্রকৃতি সৃষ্টিকর্তার এক অপরূপ সৃষ্টি। তাঁর সৃষ্টির সেরা মানুষসহ অন্যান্য সকল জীবজন্তুর বেঁচে থাকার জন্য উপযোগী করে গড়ে তুলেছেন এই প্রকৃতি। প্রকৃতি সকল প্রাণীর জীবনধারণের জন্য কতটা জরুরি তা অনুধাবন করেও আমরা প্রতিনিয়ত পরিবেশ দূষণ করে চলেছি।
বাংলাদেশ একটি জনবহুল দেশ। একসময় আমাদের এই বাংলাদেশ সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলায় সুশোভিত ছিল। বাংলাদেশে ছিল বিশাল বনভূমি, যেদিকেই তাকানো যেত, সবুজের সমারোহ চোখে পড়ত। গাছে গাছে পাখির ডাকে মুখরিত থাকত চরপাশ, নদীগুলো তার প্রবাহ নিয়ে বয়ে চলত আপন মহিমায়। এদেশটি ছিল নাতিশীতোষ্ণ অর্থাৎ না শীত, না গরম। বাংলাদেশে যে ছয়টি ঋতুÑ গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্ত; সেগুলো একেক ঋতুতে একেক বৈচিত্র্য বিরাজ করত। প্রকৃতির রূপে দেখা যেত ছন্দময় বা বিচরণ। কিন্তু বর্তমানে প্রকৃতিতে ঋতুর বৈচিত্র্যে ভিন্ন রূপ দেখা দিয়েছে। প্রকৃতি এখন বিরূপ আচরণ করছে। আর এই বিরূপ আচরণের জন্য মূলত আমরাই দায়ী।
প্রথমত আমরা গাছ কেটে বনভূমি ধ্বংস করছি; যেখানে আমরা বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় অক্সিজেন গাছ থেকে পাই। অথচ উন্নয়নমূলক কাজের জন্য নির্বিচারে প্রতিনিয়ত বৃক্ষনিধন করে প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য বিঘিœত করছি। নির্বিচারে গাছ কাটার ফলে পাখিসহ বিভিন্ন উদ্ভিদনির্ভর প্রাণীদের আশ্রয়স্থল হারাচ্ছে। ধ্বংস হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের জীববৈচিত্র্য। ব্যাপক হারে নগরায়ন ও শিল্পায়নের ফলে কলকারখানা, গৃহস্থালির বর্জ্য নির্দিষ্ট স্থানে না ফেলা, যানবাহনের ধোঁয়া, কলকারখানার রাসায়নিক বর্জ্য নদীর পানিতে ফেলা, বিশাল জনগোষ্ঠীর খাদ্য চাহিদা মেটাতে জমিতে অধিক পরিমাণে কীটনাশক ব্যবহার, নদীভরাট কাজের জন্য মানুষ শহরমুখী হওয়া ইত্যাদি বিভিন্ন কর্মকা-ে প্রাকৃতিক পরিবেশকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। অধিক হারে বনভূমি ধ্বংস হওয়ার ফলে পৃথিবীতে কার্বন-ডাই-অক্সাইড বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধি হওয়ার কারণে হিমালয়ের বরফ গলতে শুরু করছে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর সে কারণেই তলিয়ে যাচ্ছে উপকূলীয় অঞ্চল। আর এভাবে চলতে থাকলে একসময় বাংলাদেশের একাংশ অঞ্চল পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বিপুলসংখ্যক জনসংখ্যার বিভিন্ন চাহিদা পূরণের জন্য তাদের বাড়িঘর, আসবাবপত্র, জ্বালানি ইত্যাদির জন্য গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে। অথচ একটি গাছ কাটলে দুটি গাছ রোপণের আইন থাকলেও তা কেউ পালন করছে না। অন্যদিকে যেমন নদী ভরাট করা হচ্ছে, তেমনি অবৈধভাবে নদী খনন করে পরিবেশের বিপর্যয় ডেকে আনা হচ্ছে। কলকারখানার বর্জ্যগুলো নদী বা সমুদ্রে মিশে যাওয়ার ফলে বিভিন্ন জলজপ্রাণীর মৃত্যু ঘটছে। বিভিন্ন প্রজাতির মাছও আজ বিলুপ্তির পথে।
নদীর সেই দূষিত পানি দিয়ে যখন ফসল ফলানো হচ্ছে, তখন সেসব বিষাক্ত দ্রব্যাদি ফসলের মাধ্যমে মানুষ খেয়ে নানা ধরনের জটিল রোগ; যেমনÑ পেটের বিভিন্ন রোগ, চর্মরোগ, ক্যান্সারের মতো মরণব্যাধি রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। কলকারখানার বর্জ্য দ্বারা সমুদ্র বা নদী দূষিত হওয়া ছাড়াও আরো একটি কারণে দূষিত হচ্ছে। তা হলো প্লাস্টিকদ্রব্য সমুদ্র বা নদীর তলানিতে গিয়ে পড়ছে এবং নদী তার নাব্যতা হারাচ্ছে। গবেষণা বলছে, বিশ্বে প্রতি মিনিটে ১০ লাখেরও বেশি এবং বছরে প্রায় ৫ লাখ কোটি পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করা হয়। এর মাত্র ১ শতাংশ পুনঃব্যবহারের জন্য প্রক্রিয়াজাত করা হয় এবং সমুদ্রে ফেলা হয় ১০ শতাংশ। এসব পলিথিন একশ বছরেও পচে না এমনকি মাটির সাথে মিশে না। পলিথিন এমন একটি উপাদানে তৈরি যা পরিবেশ সুরক্ষার জন্য মোটেও উপযোগী নয়।
গবেষণায় আরো দেখা গেছে, এক টন পলিথিন ব্যাগ পোড়ালে বাতাসে ৬৩ গিগা জুল তাপ এবং ১৩৪০ টন কার্বন-ডাই-অক্সাইড বাতাসে ছড়ায়। ঢাকা ওয়াসার মতে শুধুমাত্র ঢাকায় ১০০ কোটি পলিথিন ব্যাগ ভূপৃষ্ঠের নিচে পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। একই সঙ্গে রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে ভূপৃষ্ঠকে ক্রমাগত উত্তপ্ত করে তোলার নেপথ্যে রয়েছে পলিথিনের অবদান।
এক পরিসংখ্যানে জানা যায় যে, সমুদ্রের পানিতে পাঁচ ট্রিলিয়নের বেশি প্লাস্টিক ভেসে থাকে। আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতে যে পরিমাণ তারা আছে তার চেয়েও বেশি। প্রতিবছর ১৪ মিলিয়ন টনেরও বেশি প্লাস্টিক সমুদ্রে জমা হচ্ছে। প্লাস্টিক দূষণ সামুদ্রিক প্রাণীর জন্য একক সর্বাধিক হুমকির মতো। সমুদ্রের কচ্ছপের পাকস্থলিতে বিজ্ঞানীরা প্রচুর পরিমাণ প্লাস্টিক বর্জ্য পেয়েছেন। সামুদ্রিক কচ্ছপের মৃত্যু প্লাস্টিক দূষণের কারণে ঘটছে। এছাড়াও ভূমিকম্প, বজ্রপাত, আল্ট্রাভায়োলেট রেডিয়েশনের মতো ঘটনা ঘটছে। এসব ক্ষতির বিবেচনা করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা খাদ্যশস্য ও চিনি মোড়কীকরণ করার জন্য পরিবেশবান্ধব পাটের বস্তা বা থলে ব্যবহারের সুপারিশ করছে। তাই বোঝা যাচ্ছে, প্রাকৃতিক পরিবেশ ধ্বংসের নেপথ্যে মূলত পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে দায়ী মানুষ। অথচ মানুষ যদি এতটুকু সচেতন হয়, তাহলে তার আগামী দিনের প্রজন্মকে একটি সুন্দর পরিবেশ উপহার দিতে পারবে।
পরিবেশের আরেকটি অন্য দূষণের নাম পানিদূষণ। যা বর্তমানে প্রকট আকার ধারণ করেছে। পানির অপর নাম জীবন জানা সত্ত্বেও আমরা প্রতিনিয়ত পানি দূষণ করে চলেছি। বর্তমানে যেভাবে পানি দূষিত হচ্ছে, পরবর্তীতে একসময় স্বাদু পানি সংকট দেখা দিতে পারে। কেননা পৃথিবীর জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে সাথে আবহাওয়া পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব পড়ছে। কোথাও অতিবৃষ্টি, কোথাও অনাবৃষ্টি, খরা ইত্যাদি। কোথাও অতিবৃষ্টির কারণে বন্যায় নি¤œাঞ্চল ডুবে ফসলি জমিসহ মানুষের ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
আবার কোথাও অনাবৃষ্টি বা খরার কারণে পুড়ছে ফসলের মাঠ। বর্ষাকাল হওয়া সত্ত্বেও কৃষকেরা জমিতে ফসল ফলাতে পারছে না। অন্যদিকে স্বাদু পানির অভাবে বছরে অনেক মানুষ পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে। পৃথিবীতে এখন প্রায় ৭৮ কোটি মানুষ বিশুদ্ধ পানি পান করতে পারে না। বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের মতো একটি ছোট দেশের মধ্যে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় সাতশো নদী রয়েছে। মানুষের জীবন জীবিকাতেও নদীর ওপর নির্ভরশীল।
বিশাল জনগোষ্ঠীর খাদ্য চাহিদা পূরণের জন্য খাদ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে কৃষিকাজ নদীর ওপর নির্ভরশীল। আবার এই ফসল বিভিন্ন স্থানে পৌঁছানোও হয় নদীপথে। জলবায়ুর ক্ষতির প্রভাব আমরা লক্ষ করেছি। জলবায়ুর প্রভাব পানির ওপরে এবং পানির সঙ্গে আমাদের কৃষি ও পরিবেশসহ অন্যান্য ক্ষেত্রেও পড়ছে। নদীগুলো ক্রমাগত শুকিয়ে যাচ্ছে। অনাবৃষ্টির কারণে দিন দিন পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। যেখানে বর্ষাকালে নদী, পুকুর, খাল ও বিল পানিতে থৈ থৈ করত সেখানে আজ নদী-পুকুরগুলো জরাজীর্ণ। সুতরাং এ থেকে বোঝা যায় জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ দূষণের ক্ষেত্রে আমরা মূলত দায়ী। পৃথিবীর তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে একটি দেশে বিশাল বনভূমি প্রয়োজন। প্রতিটি দেশেই ২৫ ভাগ বনভূমি থাকা প্রয়োজন হলেও বাংলাদেশে রয়েছে মাত্র ১৬ ভাগ। যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল। পরিবেশ আমাদের ছাড়া বাঁচতে পারবে, কিন্তু আমরা পরিবেশ ছাড়া বাঁচতে পারব না। কারণ পরিবেশ আমাদের থেকে কিছু না নিয়েও তাদের সবটা দিয়ে আমাদের বাঁচিয়ে রাখে। আর এই পরিবেশ যদি ভালো থাকে তাহলে আমরা ভালো থাকতে পারব। আমাদের ভবিষৎ প্রজন্মও ভালো থাকবে।
সুতরাং পরিবেশের প্রত্যেকটি উপাদান অতীব গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা একান্তই জরুরি। অন্যদিকে পরিবেশের যে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বায়ু; সেই উপাদান দৈনন্দিন মানুষের উন্নত জীবন ও বিভিন্ন যানবাহনের ধোঁয়া এবং মানুষের নানাবিধ কর্মকাণ্ডের কারণে দূষিত হচ্ছে। ইন্টারন্যাশনাল গ্লোবাল বার্ডেন ডিজিজ প্রজেক্টের প্রতিবেদনে জানা যায়, বিশ্বের মানুষের মৃত্যুর ক্ষেত্রে বায়ুদূষণকে ৪ নম্বর দেখানো হয়েছে। গবেষণায় আরো জানা যায়, প্রতিবছর বিশ্বে ৫৫ লাখ মানুষের মৃত্যু হয় বায়ুদূষণের কারণে।
এ অবস্থায় বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাকে বসবাসের অযোগ্য বলে চিহ্নিত করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখনই কার্যকর পদক্ষেপ এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে না পারলে ভবিষ্যতে ভয়াবহ বায়ুদূষণে পড়বে বাংলাদেশ। বায়ুদূষণের কারণে শিশু থেকে শুরু করে বয়স্করাও শ্রবণশক্তিজনিত সমস্যা, মাথাব্যথা, মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হচ্ছে। যানবাহনের ধোঁয়ায় থাকে কার্বন মনো-অক্সাইড, যা বাতাসে মিশে বাতাসকে বিষাক্ত করছে ও রোগ ছড়াচ্ছে।
প্রতিবছরই পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য বিভিন্ন দিনে ও নামে পরিবেশ দিবস পালন করা হয়। শুধুমাত্র দিবস পালনের মধ্য দিয়েই দায়িত্ব শেষ করলে চলবে না। সরকার ছাড়াও ব্যক্তিগত উদ্যোগে সকলকে নিজেদের মঙ্গলার্থে পরিবেশ সংরক্ষণের দায়িত্ব নিতে হবে। এক্ষেত্রে প্রত্যেকে যদি গাছ লাগাই তাহলে পর্যাপ্ত অক্সিজেন পাবো, ভূমিক্ষয় রোধ হবে, উদ্ভিদনির্ভর পশুপাখির আশ্রয় নিশ্চিত হবে। বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন বন্যা, খরা, জলোচ্ছ্বাস, দাবানল, ঘূর্ণিঝড়, ভূমিক্ষয়সহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের হার কমবে। অন্যদিকে পানি ও বায়ুদূষণের ক্ষেত্রে কলকারখানার বা গৃহস্থালির বর্জ্য নির্ধারিত স্থানে ফেলতে হবে, অযথা হর্ন বাজানো এবং ইঞ্জিন বন্ধ রাখতে হবে। পলিথিন বা প্লাস্টিক বর্জ্য সঠিকভাবে অপসারণ এবং এগুলোকে রিসাইকেল করে পুনঃব্যবহারের জন্য উপযুক্ত হিসেবে তৈরি করতে হবে। তবে প্লাস্টিক ব্যবহার কমিয়ে আনতে পারলে এক্ষেত্রে অধিক সুফল মিলবে। যত্রতত্রভাবে পলিথিন ব্যবহার না করে এর বিকল্প হিসেবে পাটজাত পণ্য, যেমনÑ পাটের তৈরি বিভিন্ন ব্যাগ, বস্তা ও চট ব্যবহার করে পলিথিনের ব্যবহার কমিয়ে আনা সম্ভব। দেশের সাধারণ মানুষকে পরিবেশ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে এর কুফল সম্পর্কে অবহিত করতে হবে। সাধারণের মাঝে সচেতনতার মনোভাব গড়ে তুলতে হবে। তাহলেই প্রকৃতি হবে শ্যামল ও নির্মল।

আসমা উষা : লেখক ও সমাজকর্মী, আলীনগর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ