কনকরঞ্জন দাস
পঙ্কজ সাহা সত্তর দশকের অন্যতম প্রধান কবি। বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জে জন্ম। পড়ালেখা আর কর্মসূত্রে বিবিসি লন্ডনের প্রযোজক এবং রাঁচি, শান্তি নিকেতন ও কলকাতা দূরদর্শনের ডিরেক্টর (অব.)। বিনয়ী, সদালাপী, মিষ্টভাষী কবি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সাথেও যুক্ত ছিলেন। অতঃপর বাংলাদেশ সরকার তাঁকে ‘মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা’ দিয়ে সম্মানিত করেছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার সাতচল্লিশ বছরকে মনে রেখে কবি সাতচল্লিশটি কবিতা ‘পঙ্কজ সাহার শ্রেষ্ঠ কবিতা’ শিরোনামে প্রকাশ করেছে ঢাকার আগামী প্রকাশনী। কবি স্বাধীনতার সাতচল্লিশ বছরের প্রতিটি বছরের উদ্দেশ্যে একটি কবিতা উৎসর্গ করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সম্মান করেছেন। কবিতা কখনোই কোনো দেশের ভৌগোলিক সীমারেখার পাসপোর্ট-ভিসার বেড়াজালে বন্দী থাকে না। সমস্ত পৃথিবীটাই কবির দেশ। এমন সুন্দর, সত্য ও সাহসী উপলব্ধিতে কবি গর্ব অনুভব করেন বলেই চেতনা-প্রত্যুষ থেকে কবি বিশ্বের মধুর ও মরমী ভাষা বাংলায় সৃষ্টি করে চলেছেন সুন্দর বিন্যাসে সুশৃঙ্খলিত শব্দ দিয়ে সাজান কবিতাবলি।
কবির সৃষ্টিতে ধরা পড়েছে আধুনিক বাঙালির যাপিত জীবনের দৈনন্দিন দ্বন্দ্ব, বেদনা আর পাওয়া-না পাওয়ার দোলাচলে অন্ধকারের সংক্ষুব্ধ জীবন। ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণের শৃঙ্খল ভেঙে স্বাধীনতার আকাক্সক্ষায় প্রতিবাদী ও মুক্তিপাগল হয়ে ওঠে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় জীবন-মরণ সংগ্রামী মানুষ। মুক্তিপাগল সংগ্রামী মানুষের অপ্রতিরোধ্য সংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা লাভ করে ভারত (১৯৪৭), ব্রহ্মদেশ (১৯৪৮), শ্রীলঙ্কা (১৯৪৮), লাওস (১৯৪৯), কম্পুুচিয়া (১৯৫৩) ও বাংলাদেশ (১৯৭১)। এইসব বৈপ্লবিক পরিবর্তনের ধারা কবিকে খুব স্বাভাবিকভাবেই নাড়া দিয়েছে। তাই তো কবির জন্মের আগে, জন্মের পরে এবং কবির সাথে জন্ম নেয়া সব মানুষের স্বাধীনতার প্রতীক পতাকা। কবির কবিতা পতাকার ব্যঞ্জনায় উদ্দীপ্ত। কোনো দেশের সীমান্তরেখা কবির প্রত্যাশিত নয়। কবি তাই তো বলেন, “আমি একটা পতাকা নিয়ে / টিলার মাথায় উঠছি। / … তার হাওয়ায় আমার পতাকা উড়ছে, আরো, / পুড়ছে নানা রঙের শার্ট, / সীমান্ত রেখাগুলো মুছে যাচ্ছে দ্রুত। / … এই পতাকা হাওয়ায় / সীমান্ত পেরিয়ে পেরিয়ে / পতাকা উড়ে বেড়াবে / এক দেশ থেকে অন্য দেশে।’ (পতাকা উড়ে বেড়াবে)
জন্মভূমির মধুর স্মৃতি কবিকে বারবার টানে শিকড়ের মতো। স্বর্গের চেয়েও প্রিয় জন্মভূমির মায়া কবিকে কাতর করে, কবি ব্যথিত হয়। ইংল্যান্ড, কলকাতার যশ-খ্যাতি ছাড়িয়ে ছাপিয়ে কবির স্মৃতি ভারাক্রান্ত হয় জন্মভূমিতে বাবা-কাকা-মা-মাসিদের অপত্য ¯েœহে বেড়ে ওঠার নানারঙের দিনের ঘটনাপঞ্জিতে। কবি উচ্চারণ করেন, “আমার বাবা কাকা / মা মাসিদের দেওয়া উপহার / তাদেরই বাল্যস্মৃতি, / আমায় সমস্ত বাল্যকাল ধরে। / তারপর আমি সীমান্ত পেরিয়ে / দেখতে গেছি সারা পৃথিবী, / সব মহাদেশ ঘুরে / এই বর্ষণের ঋতুতে / দেশে ফিরে মনে হলো / আমার এখনও দেশ দেখা হয়নি।” (স্মৃতির দেশ)
সীমান্তের বেড়া কবিকে দুঃখী করেছে বারবার। কবির আন্তর্জাতিকবোধ পাঠককে সমৃদ্ধ ও মুগ্ধ করবে। উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় আজ মানুষ বিশ্বনাগরিক। সীমান্ত পেরোনোর ভাবনায় কবি লিখছেন, “প্রথম আণবিক বিস্ফোরণের স্মৃতিতে / হেনরি মুরের ভাস্কর্যের কথা মনে পড়ছে / আমি বিজ্ঞানী আইনস্টাইনকে দেখেছি / … আমার কেনো সিরিয়ার কথা / মনে আসছে, ইরাকের! / আমার কেনো ইউক্রেনের কথা / মনে পড়ছে / ভারত, বাংলাদেশের! / … একটা মেঘ / এখনি সীমান্ত পেরিয়ে গেলো, / আমার কেনো পুতিনের কথা মনে আসছে? / গান্ধীর! / ওবামা কি এখন তাঁর / শান্তির নোবেল পুরস্কারের দিকে / তাকিয়ে আছেন!’ (রবীন্দ্রনাথের কিছু বলার আছে) সচেতন মননশীল পাঠকদের সহমর্মিতায় কবিও জিজ্ঞাসা করেন, “সীমান্তা-পেরনো সেই কালো মেঘ / কতো দূরে যাবে, / ইতিহাসের কোন আকাশ তার লক্ষ্য? / কবরের গভীরে হেনরি মুরের / হাত কি নিসপিস করছে? / ভিয়েতনাম, আফগানিস্তান, ইরাক, ভারত, বাংলাদেশ, / নিউইয়র্কের টুইন টাওয়ার, / মুম্বাইয়ের তাজ হোটেল, / ছড়ানো শান্ত জনপদ, সবুজ শস্যক্ষেত / তরঙ্গিত নদী, / তোমরা কি সন্ত্রস্ত সতর্ক! / … আমাকে একটু সময় দিন, / রবীন্দ্রনাথ ডাকছেন, / তাঁর কিছু বলার আছে।” (রবীন্দ্রনাথের কিছু বলার আছে)
সন্ত্রাসবাদ খুব স্বাভাবিকভাবেই কবিকে ব্যথিত করে। কবি তখন আশ্রয় খোঁজেন উপনিষদের শান্তির প্রত্যাশী বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের কাছে। বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য খোঁজেন।
কবির এক অসাধারণ শক্তিশালী ও আত্মপ্রত্যয়ী উচ্চারণ যা চিরন্তন শান্তির বাণীতে আমাদের মুগ্ধ করে। আমরা আশ্বস্ত হই। মনুষ্যত্ববোধে উদ্দীপ্ত হই। বিদ্যাপতির বাণী ‘শুনহ মানুষ ভাই, সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’ আমাদের কানের ভিতর দিয়ে মরমে ভালোবাসার চিরন্তন গানে আবিষ্ট করে রাখে। গভীর নিদ্রামগ্ন কবি জেগে উঠেন। ওঠার পরে একজনকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘আমাকে সে কি চেনে? / জানালো আমি তার পরিচিত, / আমার নাম সে জানে, মানুষ’ (অরাজনৈতিক্য)। কবি হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞাসা করেন, ‘এ কার বাড়ি? / উত্তর এলো মানুষের বাড়ি / … সামনে একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের খোলা দ্বার, / লেখা মানবতা বিশ্ববিদ্যালয়। / ছেলেমেয়েরা ঢুকছে বেরোচ্ছে, / আমি তাদের কয়েকজনের নাম / জিজ্ঞেস করলাম, / তারা সবাই বললো, / তাদের নাম ভালবাসা।” রাজনীতির বিভেদ ও কূটচাল কবির বড়ই অচেনা। এমন বিভেদকামী রাজনীতির বিভ্রান্তিতে উদ্বিগ্ন কবি, “আমি প্রহরীবিহীন উপাচার্যের ঘরে ঢুকে / তাঁকে একটি প্রশ্নই জিজ্ঞেস করলাম, / কেমন করে এমন হল? / উত্তর এল / কারণ একটাই, / পৃথিবী থেকে এখন রাজনীতি উঠে গেছে।”
অসাধারণ শক্তিশালী উচ্চারণ, নেতিবাচক রাজনীতির বিরুদ্ধে। কবি সত্যের প্রতি দায়বদ্ধ। কবিতা নিয়ে কবি ভাঁড়ামি করেননি। বিশ্বনাগরিকের চেতনায় উদ্দীপ্ত কবির একটাই পরিচয় তিনি ‘মানুষ’। ভালোবাসার মানুষ, মানবিক চেতনায় উদ্দীপ্ত একজন প্রকৃত মানুষ।
সত্তর দশকের অন্যতম এই প্রধান কবির প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা সতেরো। ইংরেজি, ফরাসি, হিন্দি, তামিল ও ওড়িয়া ভাষায় অনূদিত হয়েছে তাঁর কবিতা। অ্যান্ড্রু ওয়ারহ্যাম ইংল্যান্ডে ইংরেজি ভাষায় তাঁর কবিতা অনুবাদ করেছেন। ইতোমধ্যে কবি মাইকেল মধুসূদন পুরস্কার, সাহিত্য সেতু পুরস্কার, অলইন্ডিয়া রাইটার্স কনফারেন্স পুরস্কার, উৎসব সাহিত্য পুরস্কার (যুক্তরাষ্ট্র), উৎসব সাহিত্য স্বর্ণপদক, নিখিল ভারত বঙ্গ-সাহিত্য সম্মেলন পুরস্কার, কবি সুভাষ স্মারক পুরস্কার, সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর পুরস্কার ও দিশারী পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। এছাড়াও কবিকে পশ্চিমবঙ্গ সরকার দিয়েছে লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড।
আগামী প্রকাশনী, ঢাকা’কে আন্তরিক ধন্যবাদ। ‘পঙ্কজ সাহার শ্রেষ্ঠ কবিতা’ প্রকাশ করে সারাবিশ্বের বাঙালিকে একই মিলন সুতায় বাঁধার জন্য। কবির এমন উদার মানবিক ভালোবাসার মূল্যবোধে উদ্দীপ্ত সৃজনশীল কর্মের জন্য অপেক্ষায় থাকব- যেখানে সারা পৃথিবীর মানুষ খুঁজে পাবে মানুষের ভালোবাসার সঠিক নিরাপদ আশ্রয়।