শাহ নেয়ামতুল্লাহ কলেজ-২
চাঁপাইনবাবগঞ্জের বৃহৎ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শাহ নেয়ামতুল্লাহ কলেজে ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষ হতে পর্যায়ক্রমে অনার্স বিভাগ চালু হয়। যেসব বিষয়ে অনার্স চালু রয়েছে, সেগুলো হলো- বাংলা, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, সমাজকর্ম, ব্যবস্থাপনা ও মার্কেটিং। বর্তমানে এই ৬টি অনার্স কোর্সে মোট শিক্ষার্থী রয়েছেন প্রায় দেড় হাজার।
তথ্যানুসন্ধানে দেখা গেছে, ৬টি অনার্স কোর্সের আয়ের বড় অংশই গেছে বেতন-ভাতাদি পরিশোধে। এর মধ্যে অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষ ও বিভাগীয় প্রধানসহ এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরাও নিয়েছেন আয়ের বড় অংশ। ব্যয়ের খাতের মধ্যে উল্লেখযোগ্য আসবাব ও বই ক্রয়। এছাড়া সাধারণ তহবিলে টাকা জমা দেয়ার পাশাপাশি বড় অঙ্কের এফডিআর রয়েছে। উল্লেখ্য, অনার্স কোর্সের আয়ের বড় অংশই আসে শিক্ষার্থীদের টিউশনসহ অন্যান্য ফি থেকে।
মনোবিজ্ঞান বিভাগের ২০১৩ সালের জুলাই থেকে ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত প্রাপ্ত আয়-ব্যয়ের বিবরণীতে দেখা গেছে, এই বিভাগে আয় হয়েছে ৭১ লাখ ২৪ হাজার ১১৫ টাকা। মোট ব্যয় দেখানো হয়েছে ৬৫ লাখ ১ হাজার ৭৫৮ টাকা। এর মধ্যে এই সময়কালে অনার্স শিক্ষকদের বেতন দেয়া হয়েছে ১৪ লাখ ৬১ হাজার ৫৩৩ টাকা। আর এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা এই সময়ে ‘সম্মানি’ ভাতা নিয়েছেন ১৯ লাখ ৮৯ হাজার ৫০৩ টাকা। বই ক্রয় বাবদ ১ লাখ ৬০ হাজার ১৯৬ টাকা এবং আসবাব ক্রয় দেখানো হয়েছে ১ লাখ ৯০ হাজার ৪৬২ টাকার।
মনোবিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান শাহীন কাউসার বলেন, এই বিভাগে দুই দফায় চারজন অনার্সের শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। অনার্সের আয় থেকে এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের সম্মানি ভাতা নেয়ার নিয়ম না থাকায় ২০১৯ সালে গভর্নিং বডির তৎকালীন সভাপতি জেলা প্রশাসক বন্ধ করে দেন। ২০১৩ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত এই বিভাগের জন্য ৭০০ বই কেনা হয়েছে বলে তিনি জানান।
সমাজকর্ম বিভাগে ২০১৪ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত আসবাব কিনতে খরচ দেখানো হয়েছে ২ লাখ ১৭ হাজার ৮৭ টাকা। বই কেনার জন্য ব্যয় দেখানো হয়েছে ১ লাখ ৯৮ হাজার ৪৮১ টাকা। এই বিভাগের অনার্স শিক্ষকদের বেতন-ভাতা দেয়া হয়েছে ১৯ লাখ ২২ হাজার ৪৩৩ টাকা। আর ১৪ লাখ ৪১ হাজার ৬৬৯ টাকা উত্তোলন করা হয়েছে এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের ‘সম্মানি’ ভাতার নামে।
সমাজকর্ম বিভাগের জন্য ৮৪২টি বই কেনা হয়েছে বলে জানান বিভাগীয় প্রধান শাহজামাল। আর আসবাবের মধ্যে চেয়ার, টেবিল, ফাইল কেবিনেটসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় আসবাব কেনা হয়েছে বলে জানান তিনি।
অনার্স কোর্সের শিক্ষকদের বকেয়া বেতন প্রসঙ্গে এই দুই বিভাগীয় প্রধান জানান, করোনাকালে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে টিউশন ফি নিতে না পারায় বকেয়া হয়েছে। ঈদুল ফিতরের আগে আংশিক বকেয়া বেতন পরিশোধ করা হয়েছে। বিভাগের কেনাকাটা সম্পর্কে বলেন, ভাউচারের মাধ্যমে সবকিছু কেনা হয়েছে। ‘সম্মানি’ ভাতা প্রসঙ্গে বলেন, আগে যারা অধ্যক্ষের দায়িত্বে ছিলেন তারা যেভাবে বলেছেন সেভাবে করা হয়েছে। নিয়ম ছিল কিনা তা যাচাই করে দেখা হয়নি।
কলেজের অনার্স কোর্সের অন্য চারটি বিভাগেরও একই অবস্থা বলে জানা যায়।
এদিকে বর্তমান গভর্নিং বডি কলেজের অনিয়ম-বিশৃঙ্খলা রুখতে তৎপর হলেও এখন পর্যন্ত তারা অধ্যক্ষ নিয়োগ দিতে পারেননি। যে কারণে সংকট আরো ঘনীভূত হয়েছে বলে মনে করেন কেউ কেউ।
গভর্নিং বডির সদস্য ডা. দুররুল হোদা এ বিষয়ে জানান, দক্ষ একজন অধ্যক্ষ দরকার। অধ্যক্ষ না থাকলে একজন ইনচার্জ সবকিছু সামলাতে পারে না। ইনচার্জও একাডেমিক্যালি অধ্যক্ষ বটে। তবে পিছুটান থাকায় কাজ করতে সমস্যা হয়। একজন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষকে যখন কোনো কাজের ব্যাপারে বলা হয়, তখন স্বাভাবিকভাবেই অনভিজ্ঞতার কারণে তিনি নিজেও সেটি ঠিকভাবে করতে পারেন না এবং অন্যরাও তাকে সহযোগিতা করতে পারেন না। তাই একজন দক্ষ অধ্যক্ষ আনতে হবে। অনেক সময় চলে যাচ্ছে। এখানে তাড়াহুড়োর কোনো বিষয় নেই। সময়ের সাথে নিয়ম অনুযায়ী আমাদেরকে এগিয়ে যেতে হবে।
শাহ নেয়ামতুল্লাহ কলেজ মার্কেট প্রসঙ্গে ডা. দুররুল বলেন, এত বড় একটা মার্কেট থেকে যেখানে বেনিফিটেড হওয়ার কথা, সেখানে অনেক অনিয়ম এবং অনেকদিন ভাড়া আদায়ও হয় না। মনিটরিংও ঠিকভাবে করা হয়নি। নিয়মিত মনিটরিং হবে না, ভাড়া আদায় হবে না এটা খুবই দুঃখজনক। ভাড়া দিব, তার জন্য কমিটিতে এটার সিদ্ধান্ত হবে, রেজ্যুলেশন হবে এবং একটা ডকুমেন্ট থাকবে যে কিভাবে ভাড়াটা হবে। তিনি বলেন, ভাড়া পাঁচ বছর পরপর রিভিউ করার কথা, সেগুলোও হয়নি। এটি নিয়মিত করার চেষ্টা করে যাচ্ছি।
ডা. দুররুল বর্তমান গভর্নিং বডি প্রসঙ্গে বলেন, বর্তমান কমিটি চাহিদাপত্র অনুযায়ী কাজ করে থাকে। কলেজের যে নীতিমালা সে অনুযায়ী আমরা আগের দূরত্বগুলো দূর করতে অনকটাই ভূমিকা রাখতে পেরেছি। এর জন্য অনেক বাধা এসেছে। এই কলেজে এসে গভর্নিং বডির যে কাজগুলো করতে পারার কথা, সে অনুযায়ী আমরা পারিনি। অনেক সমস্যা, যেমনÑ প্রিন্সিপাল নেই, ভাইস প্রিন্সিপাল তেমন অভিজ্ঞতাসম্পন্ন নয়, সঠিকভাবে অফিস কো-অপারেট করে না, বিভিন্ন সময়ে আমরা যেভাবে তথ্য জানতে চাই, সেভাবে পাই না এরকম অনেক সমস্যা। এসব নিয়ে অনেক ইন্টারনাল বাধা বা কনফ্লিক্ট আছে। অভ্যন্তরীণ কিছু মানুষও আছে, যারা তাদেরকে সহযোগিতা করছে। তিনি আরো বলেন, আমাদের টিম (গভর্নিং বডি) কতটা সফল হয়েছে, এই বিষয়ে বলব যেÑ অনেক সমস্যা, বাধা-বিপত্তি পার করে আমরা অনেকগুলো কাজ করেছি। শতভাগ সফল না হলেও উদ্যোগ নেয়া কাজগুলো করতে পেরেছি। এখানে শতভাগ সফল হতে গেলে একজন দক্ষ অধ্যক্ষের প্রয়োজন। তিনি বলেন, যারা বাধা দিচ্ছে তাদের তো একটা স্বার্থ আছেই, তা না হলে তারা কেন বাধা দিবে। হয়তো অনেকেই বেনিফিটেড হয়েছে। আর এসব জায়গায় লাভবান যারা হয় তাদের সমাজে একটা শক্তি তৈরি হয়।
উল্লেখ্য, শাহ নেয়ামতুল্লাহ কলেজের অধ্যক্ষ আনোয়ারুল ইসলাম ২০২০ সালের ৭ জুন ইন্তেকাল করেন। এরপর থেকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন কলেজের উপাধ্যক্ষ শরিফুল ইসলাম। তিনি অধ্যক্ষ প্রার্থী হওয়ায় চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে হাকিকুল ইসলামের কাছে দায়িত্বভার হস্তান্তর করেন।
সার্বিক বিষয়ে বর্তমান সভাপতি সাইদুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রথমেই অধ্যক্ষ নিয়োগের প্রসঙ্গটি তুলে ধরেন। তিনি বলেন, সুষ্ঠুভাবে কলেজ পরিচালনার ক্ষেত্রে একজন দক্ষ অধ্যক্ষের কোনো বিকল্প নেই। দক্ষ অধ্যক্ষের অভাবের কারণে অনেকাংশেই কলেজের বর্তমান সংকট। তিনি বলেন, আমি সভাপতি হবার পর অধ্যক্ষ নিয়োগের জন্য উদ্যোগী হই। কিন্তু কলেজের ভেতর ও বাইরের কিছুসংখ্যক ব্যক্তি, যাদের অসৎ উদ্দেশ্য বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, তারা বিধিবহির্ভূতভাবে প্রায় একই বিষয়ে মামলা-মোকদ্দমাসহ নিয়োগ প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার পাশাপাশি আমার ভাবমূর্তি নষ্ট করার জন্য একই রেকর্ড বারবার বাজিয়ে যাচ্ছে। তারপরও এসব প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করে বর্তমান গভর্নিং বডি নিয়মমাফিক অধ্যক্ষ নিয়োগের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তিনি আরো বলেন, প্রতিষ্ঠানের সার্বিক উন্নয়নের জন্য চাহিদা বিবেচনা করে গভর্নিং বডি নীতি-নির্ধারণী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, সঠিক সিদ্ধান্ত হওয়া সত্ত্বেও তা নানাবিধ কারণে বাস্তবায়ন হচ্ছে না।
সাইদুর রহমান বলেন, আগে অনার্সের ৬টি বিভাগ মাত্র একটি কক্ষেই ৬টি টেবিলে বসে কার্যক্রম পরিচালনা করত। বর্তমান গভর্নিং বডি এ দৃশ্য দেখে দ্রুতই ৬টি বিভাগকে পৃথক কক্ষে স্থানান্তর, সুসজ্জিতকরণ, কম্পিউটারসহ অন্যান্য চাহিদা পূরণ করেছে।
‘অনার্স কোর্সের টাকা ‘সম্মানি ভাতা’র নামে উত্তোলন করা হয়েছে, এর দায় আগে যারা দায়িত্বে ছিল, তারা কি এড়াতে পারবেন?’Ñ প্রশ্নের জবাবে সাইদুর রহমান বলেন, প্রকারান্তরে তারা হয়তো দায়ী; কিন্তু তাদেরও কিছু করার ছিল না। কারণ কলেজ চালায় মূলত অধ্যক্ষ। তাই কোনটা নিয়ম, কোনটা বিধিবহির্ভূত তা অধ্যক্ষকেই গভর্নিং বডির কাছে উপস্থাপন করতে হয়। দেখা গেল, আগের অধ্যক্ষ হয়তো এসব বিষয় উপস্থাপনই করেননি। গভর্নিং বডিও অধ্যক্ষের প্রস্তাব নিয়ম মনে করে সম্মতি দিয়েছে। তিনি আরো বলেন, আমি নিজেই যেহেতু কলেজ শিক্ষক ছিলাম, শিক্ষকদের প্রতিনিধিত্বও করেছি এবং অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। তাই কোনটা নিয়ম, কোনটা অনিয়ম তা সহজেই বুঝতে পারি। আর দীর্ঘদিনের অনিয়মগুলো বন্ধ করতে গেলে তো একটি গোষ্ঠী স্বাভাবিকভাবেই গভর্নিং বডির ওপর বিরক্ত হবেই।
[পরবর্তী পর্ব আগামীতে]