Last Updated on মার্চ ২৭, ২০২৫ by
চীনে বোয়াও ফোরাম ফর এশিয়া সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টা
জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধারে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার কার্যক্রম শুরু করেছে বাংলাদেশ
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধারে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার কার্যক্রম শুরু করেছে।
তিনি বলেন, ‘আমাদের তরুণ প্রজন্ম ও দেশবাসী বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করতে অসাধারণ সংকল্প ও শক্তি প্রদর্শন করেছে। জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধারে আমরা গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার কার্যক্রম হাতে নিয়েছি।’
প্রধান উপদেষ্টা বৃহস্পতিবার চীনের হাইনানে বোয়াও ফোরাম ফর এশিয়া (বিএফএ) সম্মেলনের উদ্বোধনী অধিবেশনে ভাষণ দেওয়ার সময় এ কথা বলেন।
চলমান সংস্কার কর্মসূচির প্রসঙ্গ উল্লেখ করে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘স্বাধীন কমিশন গঠন করা হয়েছে যাতে নির্বাচনী ব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, বেসামরিক প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে সংস্কার আনা যায়।’
এই সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়িত হলে আমাদের জাতির একটি মৌলিক রূপান্তর সাধিত হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আমরা যখন একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ে তুলতে যাচ্ছি, তখন এশিয়ার অন্যান্য দেশের মতো আমরাও একাধিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছি।’
বিশ্বব্যাপী আর্থিক বাজারের অস্থিরতা, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, কূটনৈতিক উত্তেজনা এবং বাণিজ্য বিঘœতা বিশ্ব অর্থনীতিতে অস্থিরতা তৈরি করছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘সুদের হার বৃদ্ধি ও ঋণ পরিষেবা ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় এশিয়ার ঋণ সংকট আরো গভীর হচ্ছে।’
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে ধীরগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে উল্লেখ করে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘বিশ্বব্যাপী ২০৩০ এজেন্ডার প্রতি প্রতিশ্রুতি থাকা সত্ত্বেও অগ্রগতি খুব ধীর গতিতে হচ্ছে। এখন পর্যন্ত মাত্র ২৪ শতাংশ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জিত হয়েছে।’
তিনি বলেন, উন্নয়নশীল এশীয় দেশগুলো প্রতি বছর ২.৫ থেকে ৪ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার এসডিজি অর্থায়নের ঘাটতির সম্মুখীন হচ্ছে।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এসডিজি অর্থায়নের বাইরেও এশিয়াকে ব্যাপক পরিমাণে অবকাঠামো বিনিয়োগ ও দায়িত্বশীল অর্থায়নের মাধ্যমে অর্থনৈতিক বৈচিত্র্য আনতে হবে।
দুর্নীতি ও আর্থিক অপচয় রোধের আহ্বান জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে দুর্নীতি ও অবৈধ অর্থপ্রবাহের শিকার।
তিনি উল্লেখ করেন, এই ধরনের দুর্নীতি ও আর্থিক অনিয়মের কারণে উন্নয়নশীল দেশগুলো প্রতি বছর প্রায় ১ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার ক্ষতির সম্মুখীন হয়, যা তারা আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহায়তা হিসেবে যে অর্থ পায় তার চেয়ে বহুগুণ বেশি।
তিনি বলেন, ‘এশিয়াকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সম্পদ পুনরুদ্ধার ও পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার জন্য একটি বহুপাক্ষিক মধ্যস্থতা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।’
প্রধান উপদেষ্টা আরো বলেন, ‘খাদ্য নিরাপত্তা ক্রমবর্ধমান চাপে রয়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বাড়ার কারণে নিম্নআয়ের পরিবারগুলো কঠিন সময় পার করছে।’
তিনি আরো বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ এই সংকটকে আরো গভীরতর করছে। ‘খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থা শক্তিশালী করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ,’ তিনি উল্লেখ করেন।
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘জ্বালানি নিরাপত্তা গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষত জ্বালানি আমদানিকারক উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য। জ্বালানি সরবরাহ ব্যাহত হলে মূল্যস্ফীতি, অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং ঋণ সংকট বৃদ্ধি পায়।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের অবশ্যই টেকসই জ্বালানি সমাধান খুঁজে বের করতে হবে। নবায়নযোগ্য শক্তিতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।’
প্রধান উপদেষ্টা মানবসম্পদ উন্নয়নে স্বাস্থ্য ও শিক্ষায় বিনিয়োগের ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
তিনি বলেন, ‘যেসব দেশ সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবায় বিনিয়োগ করে, তারা অর্থনৈতিক উৎপাদনশীলতার দিক থেকে ভালো ফল পায়।’
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘আমাদের তরুণ প্রজন্মকে ভবিষ্যতের চাকরির বাজারের জন্য প্রস্তুত করতে ডিজিটাল শিক্ষা ও বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের প্রসার ঘটাতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা বৃদ্ধি পাচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তন তীব্রতর হচ্ছে, ঋণের বোঝা অসহনীয় হয়ে উঠছে এবং মানবিক সংকট বাড়ছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘উন্নয়ন সহযোগিতার জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা দুর্বল হয়ে পড়ছে, এবং বিশ্ব এখন সম্মিলিত পদক্ষেপের অভাবের কারণে একটি বিপজ্জনক পরিস্থিতির সম্মুখীন।’
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘বিশ্বের ৬০ শতাংশ জনসংখ্যা এবং ৫৫ শতাংশ বিশ্ব জিডিপি ধারণকারী এশিয়া এই পরিবর্তনগুলোর কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে।’
‘নতুন নিয়ম, বিধিনিষেধ এবং প্রযুক্তি সরকার পরিচালনা ও অর্থনৈতিক নীতিকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করছে,’ বলেন তিনি।
তিনি আরো বলেন, ‘এক দশক আগে যে নীতিগুলো কার্যকর ছিল, সেগুলো আর প্রাসঙ্গিক নয়। আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তা এখন আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি প্রয়োজন।’
সম্মেলনে বোয়াও ফোরাম ফর এশিয়ার মহাসচিব ঝাং জুন, জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব ও বোয়াও ফোরামের চেয়ারম্যান বান কি-মুন এবং চীনের স্টেট কাউন্সিলের নির্বাহী উপ-প্রধানমন্ত্রী ডিং জুয়েশিয়াং বক্তব্য দেন।