জাহাঙ্গীর সেলিম
কালরাত্রি ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সালে কতিপয় বিপথগামী ও উচ্ছৃঙ্খল সামরিক কর্মকর্তা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে নবীন এই দেশের পথচলাকে উল্টোপথে চালিত করার প্রয়াস চালায়। মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধে আঘাত হানে এবং দীর্ঘ বছর দেশে সামরিক শাসন উক্ত কাজে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। এতদসত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ সাময়িকভাবে থমকে গেলেও দেশপ্রেমিক জনগণের মাঝে ফাটল ধরাতে সক্ষম হয়নি। কারণ বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অনুসারীর সংখ্যা হাজার হাজার নয় লক্ষ কোটি। তাদের দলে উচ্চ শিক্ষিত, পেশাজীবী থেকে বিভিন্ন স্তরের খেটেখাওয়া লোকজনের পাশাপাশি সংস্কৃতিকর্মীরাও প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত। ফলে কালরাত্রির নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর বঙ্গবন্ধুর অনেক অনুসারীর ওপর খড়গ বা বিভিন্ন অত্যাচার নির্যাতন চালানো হয়। সংস্কৃতিকর্মীরাও নির্যাতন থেকে রেহাই পায়নি। তারই একটা জলজ্যান্ত প্রমাণ মুদ্রিত এই চিঠিটি।
বঙ্গবন্ধু ছিলেন ভূমিজ সন্তান। মাটি ও মানুষের সাথে ছিল হার্দিক সম্পর্ক। মাটির গান ও গণমানুষের গানে ভরা বাংলার লোকসংগীতের বিপুল ভা-ার। দেশের লোকশিল্পীর অনেকের সাথে বঙ্গবন্ধুর প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ছিল এবং লোকসংগীত প্রসারে উৎসাহ প্রদান করতেন। প্রখ্যাত গম্ভীরা গায়ক রকিবউদ্দিন ও কুতুবুল আলমের সাথে বঙ্গবন্ধুর সাথে হার্দিক সম্পর্ক ছিল। যখন তখন এই শিল্পীদ্বয় বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করতে পারতেন এবং মনখুলে খোশ গল্পে মেতে উঠতেন। দু-এক মাস পর পর তাদেরকে বঙ্গভবনে ডেকে মন্ত্রিপরিষদ সদস্যদের উপস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু গম্ভীরা পরিবেশনা প্রত্যক্ষ করতেন। এই অতি হৃদ্যতা বা ঘনিষ্ঠতা ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর রকিব-কুতুবের জন্য কাল হয়ে দেখা দেয় এবং খড়গ নেমে আসে একটি সরকারি চিঠির নির্দেশনায়।
মুদ্রিত এই চিঠিটি রেডিও বাংলাদেশ, রাজশাহী থেকে ১৯ আগস্ট ১৯৭৫ তারিখে সে সময়ের চাঁপাইনবাবগঞ্জের সংসদ সদস্য ডা. মেসবাহুল হকের মাধ্যমে রকিবউদ্দিন-কুতুবুল আলম ও সঙ্গীদের উদ্দেশ্যে প্রেরণ করা হয়। উল্লেখ্য, ১৫ আগস্ট সেই ভোরবেলা সূর্য ওঠার আগে ‘বাংলাদেশ বেতার’ হয়ে যায় রেডিও বাংলাদেশ। পাকিস্তানের প্রেতাত্মা বেতারে নয় বাংলাদেশের ওপর চেপে বসে। ১৯ আগস্ট ১৯৭৫ সালে রকিব-কুতুবকে প্রেরিত চিঠিতে হঠাৎ গজিয়ে উঠা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান রেডিও বাংলাদেশ তাদের গম্ভীরা পরিবেশনা নিষিদ্ধ করে। অন্য গানের শিল্পীদের ক্ষেত্রে এ রকম নির্দেশ প্রদান করা হয়েছিল কিনা জানা নেই। তবে নির্দেশ প্রদান করা হলেও অবাক হবার কিছু দেখি না। কেননা বাংলাদেশের অগ্রগতি বা মূল্যবোধের চাকা বিপরীত দিকে ঘুরানো তখন দুর্বৃত্ত ও খুনীদের ছিল মূল উদ্দেশ্য।
বিগত শতাব্দীর সত্তর দশকেও ইলেক্ট্রনিক গণমাধ্যম বেতার (রেডিও)-এর যথেষ্ট গুরুত্ব ছিল (এখনো নেই এমন কথা বলছি না)। যদিও একমাত্র রাষ্ট্র পরিচালিত গণমাধ্যম বেতারের ওপর নির্ভরশীল ছিল আপামর জনসাধারণ। অন্য ইলেক্ট্রনিক গণমাধ্যম বাংলাদেশ টেলিভিশনের প্রসার বা একই সঙ্গে সম্প্রসারণ সে সময়ে দেশব্যাপী বিস্তৃতি লাভ করেনি (নব্বই দশকের মাঝামাঝি থেকে আকাশ সংস্কৃতি দেশে খুব দ্রুত বিকাশ লাভ করে)। বঙ্গবন্ধুকে দুর্বৃত্তরা হত্যা করেই শাহবাগস্থ বেতার ভবনে সশস্ত্র অবস্থান ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের ঘোষণা প্রচার করতে থাকে।
রকিব-কুতুবদের বাংলাদেশ বেতারে গণসচেতনা ও শিক্ষাসমূলক গম্ভীরা অনুষ্ঠান পরিবেশন করে আহামরি আর্থিক সুবিধা তেমন ছিল না। তবে কুতুবুল আলম ছাড়া রকিবসহ অন্যান্য সহযোগীদের যৎসামান্য আর্থিক সুবিধা পাওয়া রহিত হয়ে যায়। কুতুবুল আলম সরকারি চাকরি করতেন, রকিবউদ্দিনের নিয়মিত আয়ের কোনো পথ ছিল না। মুক্তিযুদ্ধের আগে শহরে রকিবের একটি মনোহারি দোকান ছিল। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন দোকানটি লুটপাটের শিকার হয়। স্বাধীনতার পর দোকানটি পুনরায় চালু করতে পারেননি। দলের অন্যান্য যন্ত্রীদের সকলেই দিন এনে দিন খাওয়া এবং দৈনিক ভিত্তিতে বিভিন্ন কাজকর্ম করে দিনাতিপাত করতে হতো। রেডিওতে (?) কতদিন বা কত বছর গম্ভীরা পরিবেশনা বন্ধ ছিল তা জানা নেই, তবে পরবর্তী সময়ে সরব উপস্থিতি দেখা যায়। উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধু রকিব-কুতুবের আর্থিক সুবিধার জন্য কিছু একটা করে দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তারা উভয়ে বিনয়ের সঙ্গে এড়িয়ে যান। শেষে বঙ্গবন্ধু রকিব-কুতুবের জন্য মাসিক লিটারারি পেনশন সুবিধা প্রদানের ব্যবস্থা করেন।
বাঙালি সংস্কৃতি রোধ করার সূচনা দেশভাগের অব্যাহত পর থেকেই পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী শুরু করে এবং বিভিন্নভাবে আগ্রাসন চলতে থাকে। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন তার একটি বলিষ্ঠ উদাহরণ। এভাবে ২৩ বছর বিভিন্ন চড়াই-উতরাইয়ের সংগ্রাম এবং রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে দেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়। কিন্তু এক ক্ষুদ্র অংশ দেশের বিরোধিতা করে এবং পাকিস্তান ভেঙে যাওয়ায় মনঃকষ্টে ভুগতে থাকে। ’৭৫ সালে নির্মম হত্যাকা-ের পটপরিবর্তনে ঐ পরাজিত শক্তি সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং প্রথম সুযোগেই সংস্কৃতির ওপর আঘাত হানে রেডিও বাংলাদেশ নামকরণের মধ্য দিয়ে।
জাহাঙ্গীর সেলিম : লেখক ও গবেষক