চাঁপাইনবাবগঞ্জে বন্ধ ২ বছর ধরে : করোনা স্বাভাবিক হয়ে এলেও সহসা চালু হচ্ছে না লোকাল ও শাটল ট্রেন

72

সাজিদ তৌহিদ ও আল-মামুন বিশ্বাস

করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসছে। অথচ চাঁপাইনবাবগঞ্জে ২ বছর ধরে বন্ধ রয়েছে লোকাল ও শাটল ট্রেন।
৫৬৩ লোকাল ট্রেন ঈশ্বরদী থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের রহনপুরের উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসত ভোর ৪টায়। পৌঁছত সকাল সাড়ে ৮টায়। এরপর এই ট্রেনটি ৫৮২ হয়ে রহনপুর থেকে ছেড়ে আসত সকাল ৮টা ৫০ মিনিটে। চাঁপাইনবাবগঞ্জে পৌঁছত সকাল ৯টা ৫০ মিনিটে। একই ট্রেন ৫৬৬ হয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে রাজশাহীর উদ্দেশ্যে ছেড়ে যেত সকাল ১০টা ১০ মিনিটে। রাজশাহী থেকে ৫৬৫ হয়ে বেলা ১টায় ছেড়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জে পৌঁছত বেলা ৩টার দিকে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে ৫৮১ হয়ে বিকাল সোয়া ৫টায় ছেড়ে যেত রহনপুরের উদ্দেশ্যে। রহনপুর পৌঁছত সন্ধ্যা ৬টা ৩৫ মিনিটে। এরপর ট্রেনটি ৫৬৪ হয়ে রহনপুর স্টেশন ত্যাগ করত সন্ধ্যা সোয়া ৭টায়। ঈশ্বরদী পৌঁছত রাত ১১টা ২০ মিনিটে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের একমাত্র এই লোকাল ট্রেনটি দেশে করোনার আঘাত হানার আগ পর্যন্ত প্রতিদিন একই সূচিতে সময় মেনেই চলাচল করত। ফলশ্রুতিতে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর, নাচোল উপজেলা ও গোমস্তাপুর উপজেলার রহনপুরে প্রতিদিন যাতায়াতকারীদের কাছে ট্রেনটি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। ভাড়াও ছিল বাসের তুলনায় অল্প।
জানা গেছে, ব্রিটিশ আমল থেকে চলে আসা এই লোকাল ট্রেনটিতে গাদাগাদি করেই মানুষ চলাচল করত। সরকারের রাজস্ব আয়ও ভালোই হতো, লোকাল ট্রেন হিসেবে। কিন্তু জনপ্রিয় এই লোকাল ট্রেনটির বন্ধ হওয়া ২ বছর পার হয়ে গেছে। এই সময়ে করোনা মহামারির ধকল কাটিয়ে দেশে ধীরে ধীরে স্বাভাবিকতা ফিরে এলেও অত্যন্ত চালু এই লোকাল ট্রেনটি এখনো চলাচল শুরু করেনি। কবে নাগাদ তা আবার চালু হতে পারে, তা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারেননি। লোকাল এই ট্রেনটি চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার মধ্যে আপ এবং ডাউনে ৬টি নাম্বার নিয়ে চলাচল করত।
২০২০ সালের ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা শনাক্ত হওয়ার পর তা বেড়ে চললে ওই বছরের ২৬ মার্চ থেকে সারা দেশে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়। ফলে সারা দেশে ট্রেন যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীতে পর্যায়ক্রমে অন্যান্য ট্রেন চালু করা হলেও চাঁপাইনবাবগঞ্জের জনপ্রিয় এই লোকাল ট্রেনটি বন্ধই রয়ে গেছে। পাশাপাশি চাঁপাইনবাবগঞ্জ রেলস্টেশন থেকে আর দুটি শাটল ট্রেনেরও একই অবস্থা। রাজশাহী থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাওয়া পদ্মা ও ধূমকেতু এক্সপ্রেস ট্রেনগুলোর চাঁপাইনবাবগঞ্জের যাত্রী আনা-নেয়ার জন্য এই শাটল ট্রেন দুটি চালু হয়েছিল।
শাটল-১ নামের ট্রেনটি রাজশাহী থেকে ভোর ৫টা ৫০ মিনিটে ছেড়ে এসে চাঁপাইনবাবগঞ্জে পৌঁছত সকাল সোয়া ৭টায়। শাটল-২ রাজশাহীর উদ্দেশ্যে চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে ছেড়ে যেত দুপুর ২টা ২০ মিনিটে এবং পৌঁছত বিকেল ৩টা ৪০ মিনিটে। শাটল-৩ রাজশাহী থেকে ছেড়ে আসত বিকেল সোয়া ৫টায়। চাঁপাইনবাবগঞ্জে সন্ধ্যা ৬টা ৪০ মিনিটে পৌঁছে শাটল-৪ হয়ে আবার রাজশাহীর উদ্দেশ্যে ছেড়ে যেত রাত ৯টা ৪৫ মিনিটে।
উল্লেখ্য, বর্তমানে চাঁপাইনবাবগঞ্জ রেলস্টেশন থেকে বনলতা এক্সপ্রেস ট্রেনটি চালু রয়েছে। রহনপুর থেকে রাজশাহী পর্যন্ত দিনে দুইবার কমিউটার ট্রেন চলাচল করছে। এছাড়া প্রাইভেট ট্রেন মহানন্দা এক্সপ্রেস চাঁপাইনবাবগঞ্জ-রহনপুর হয়ে খুলনা যাতায়াত করছে।
ট্রেনগুলো চালুর বিষয়ে একাধিকবার আবেদন-নিবেদন করেও এখন পর্যন্ত চালু করা যায়নি। মানববন্ধনও হয়েছে বেশ কয়েকবার চাঁপাইনবাবগঞ্জ রেলস্টেশনসহ নাচোল ও রহনপুরে। ‘হবে’, ‘হচ্ছে’ করে চালু হয়নি। রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন গতবছরের ১২ মার্চ রহনপুর রেলস্টেশনে পরিদর্শনে এলে সে সময় তিনি চাঁপাইনবাবগঞ্জের রহনপুর থেকে করোনাকালীন বন্ধ হওয়া লোকাল ট্রেনটি চালু করা হবে বলে আশ্বাস দেন। তার সে আশ্বাসও আজ পর্যন্ত বাস্তবায়ন হয়নি। লোকাল ও শাটল ট্রেন দুটি চালু না হওয়ায় ভোগান্তিতে পড়েছেন এলাকার মানুষ। বিশেষ করে স্বল্পআয়ের লোকজন। তাদের দাবি, দ্রুতই ট্রেনগুলো চালু করা হোক।
এদিকে ট্রেনগুলো কবে নাগাদ চালু হতে পারে এ বিষয়ে রহনপুর রেলস্টেশনের কর্মকর্তা মামুনুর রশিদ জানান, করোনাকালীন থেকে লোকাল ট্রেনটি বন্ধ রয়েছে। অনেক যাত্রী স্টেশনে এসে খোঁজ নেন। ট্রেনটি চালুর বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলতে পারবেন বলে তিনি জানান।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের সহকারী রেলস্টেশন মাস্টার ওবায়দুল্লাহ জানান, কবে নাগাদ চালু হতে পারে তা আমাদের জানা নেই। তবে অনেক আগে সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে জানতে পেরেছিলাম, এলএম সংকট থাকার কারণে ট্রেনগুলো চালু করা যাচ্ছে না।
রহনপুরের বাসিন্দা ও রেলবন্দর বাস্তবায়ন পরিষদের মুখপাত্র পারভেজ শেখ বলেন, লোকাল এই ট্রেনটি সব শ্রেণির কাছে জনপ্রিয় ছিল। ভোলাহাট, নাচোল, নওগাঁর নিয়ামতপুরের পোরশা ও সাপাহার এলাকার লোকজন যাতায়াত করত এই ট্রেনে। তিনি ট্রেনটি পুনরায় চালুর দাবি জানান।
রহনপুর পৌর এলাকার বাসিন্দা কাউসার জামান জানান, ট্রেনটি চলাচলে গরিব, চাকরিজীবী, শিক্ষার্থীসহ সব শ্রেণির যাত্রীদের কাছে চলাচলের জন্য প্রিয় ছিল। অনেকে আসবাবপত্র ও পণ্য নিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ, কাঁকনহাট, রাজশাহী, আড়ানী ও ঈশ্বরদীতে কম খরচে নিয়ে যেতে পারত; আবার নিয়েও আসত। অনেক যাত্রীকে ঢাকার ট্রেনসহ অন্য ট্রেনে উঠার জন্য সংযোগ করে দিত এটি। তবে ট্রেনটি চালু না হওয়ায় তিনিসহ অনেক যাত্রী দুর্ভোগে রয়েছেন।
নাচোল উপজেলার যাত্রী রফিকুল ইসলাম জানান, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক রহনপুর শাখায় চাকরির কারণে কয়েকজন কর্মকর্তা প্রতিদিন সকালে নাচোল স্টেশনে চড়ে রহনপুরে কর্মস্থলে যেতাম। অফিস শেষ করে আবার সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরতে পারতাম এই ট্রেনে চড়ে। বন্ধ থাকায় আর যেতে পারছি না।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা জাসদের সাধারণ সম্পাদক ও নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব মনিরুজ্জামান মনির বলেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে রাতে ও সকালে যে লিংকআপ ট্রেনগুলো (শাটল) ছিল, সবই বন্ধ হয়ে গেছে। ট্রেনগুলো চালুর বিষয়ে রেলের জিএম (পশ্চিমাঞ্চল) সাহেবের কাছে জোর দাবি জানিয়ে আসছি। এছাড়া ট্রেন চালুর দাবিতে আমরা ১০ হাজার স্বাক্ষরসহ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদনও জমা দিয়েছি। ঈদুল ফিতর শেষ হলো, আগামীতে কি করা যায় সেটা নিয়ে পরে বলা যাবে।
নাগরিক কমিটির এই নেতা আরো বলেন, ট্রেনগুলো চালুর পাশাপাশি চাঁপাইনবাবগঞ্জে অতিদ্রুত বনলতা এক্সপ্রেসের সিটা বাড়ানো দরকার। যা দেয়া হচ্ছে তা চাহিদার তুলনায় খুবই অপ্রতুল। তিনি বলেন, আমাদের ৫০ শতাংশ সিট দরকার। অল্প সময়ের মধ্যে এ দাবি তুলে ধরা হবে বলে জানান তিনি।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মু. জিয়াউর রহমান বলেন, দীর্ঘদিন থেকে দাবি জানিয়ে আসছি অথচ দুঃখজনক হলেও সত্য এখন পর্যন্ত ট্রেনটি পাইনি। যদিও মাননীয় রেলমন্ত্রী আমাদের এ ব্যাপারে আশ্বস্ত করেছিলেন। অবিলম্বে ট্রেনটি চালুর দাবি জানান প্রবীণ এ আওয়ামী লীগ নেতা।
এ বিষয়ে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) অসীম কুমার তালুকদার বলেন, কোচ সংকটের কারণে ট্রেনগুলো চালু করা যাচ্ছে না। তবে এ মুহূর্তে ট্রেনগুলো চালুর পরিকল্পনা নেই বলে জানান তিনি।