চাঁপাইনবাবগঞ্জের পুনর্ভবা নদীতে হাঁটুপানিও নেই, বিলুপ্তির পথে জীববৈচিত্র্য

51

আল-মামুন বিশ্বাস : ভরাট হতে বসেছে পুনর্ভবা নদী। নাব্যতা হারিয়ে পানি প্রবাহ প্রায় বন্ধের পথে। কোথাও কোথাও হাঁটু পর্যন্ত পানি নেই। ছোট ছোট নৌকাও চলাচল করতে পারে না। নদীটি শুকিয়ে যাবার কারণে জীববৈচিত্র্য প্রায় বিলুপ্তির পথে। নদীর বুকে চাষাবাদ হচ্ছে ধানসহ চৈতালী ফসল। দীর্ঘদিন ধরে নদী খনন না করা এবং ভারতের ফারাক্কা বাঁধের কারণে নদীর দৃশ্যমান এ অবস্থা।
জানা গেছে, পুনর্ভবা নদীর প্রাচীন উৎস ব্রাহ্মণপুর বরেন্দ্র ভূমি। এটির বর্তমান উৎপত্তিস্থল হচ্ছে দিনাজপুর জেলার বীরগঞ্জ উপজেলার শিবরামপুর ইউনিয়নের বিলাঞ্চল। পতিত হয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলার রহনপুরের মকরমপুরে মহানন্দা নদীতে।
বর্তমানে নদীটি মরা খালে পরিণত হয়েছে। গ্রীষ্মের প্রখরতায় শুকিয়ে যাচ্ছে নদ-নদী, পুকুর ও খাল-বিল। ভারত নদীর পানি প্রবাহ নিয়ন্ত্রণের কারণে পুনর্ভবাসহ এ অঞ্চলের নদী পানিশূন্য হয়ে পড়েছে। কৃষি, মৎস্য, যোগাযোগ, জীববৈচিত্র্য মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। নৌপথ বন্ধ হওয়ায় মাঝিমাল্লারা কাজ হারিয়েছে। অর্ধশত প্রজাতির মাছ বিলুপ্তির পথে। পেশা বদল করেছে জেলেরা। শুকিয়ে যাওয়া এই নদীই আবার বর্ষাকালে ফুলে ফেঁপে এ অঞ্চলের মানুষের ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
নওগাঁর সাপাহার ও পোরশা উপজেলার নিতপুর সীমান্ত দিয়ে গোমস্তাপুর উপজেলার রহনপুর ও চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে এ নদীপথে ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্রগুলোতে ক্রয়-বিক্রয়ের জন্য আসা যাওয়া করত লোকজন। অসংখ্য মানুষ ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে জীবন-জীবিকার শক্ত ভিত গড়ে তুলেছিলেন এই নদীপথ ব্যবহার করে। নদীটিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল অনেক জনপদ।
বর্তমানে নদীর আশপাশে বিপুল পরিমাণ চাষযোগ্য জমি পানির অভাবে পতিত হয়ে যাচ্ছে। নদীর প্রবাহ থমকে যাওয়ায় নিভে গেছে বিপুল সম্ভাবনা। পুনর্ভবা নদীতে পানির অভাবে গোমস্তাপুর উপজেলার প্রায় হাজার হাজার বিঘা জমির ফসল প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মার খাচ্ছে। নদী শুকিয়ে যাবার কারণে সেচ পাম্পগুলো অকেজো হয়ে পড়েছে।
নদীতে মাছ ধরা জেলে তিনকড়ি জানান, পুনর্ভবা নদী তার জৌলুস হারিয়ে ফেলেছে। একসময় সারা বছর পানিতে ভরপুর থাকত। পালতৌলা নৌকা, লঞ্চ, পাটলি নদীর চারদিকে ভরপুর থাকত। জেলেরা নদীর চারপাশে মাছ ধরা নিয়ে ব্যস্ত থাকত। দূরদূরান্ত থেকে আসা ও স্থানীয় লোকজন নদীর কিণারায় বসে নানা ধরনের মাছ ধরা ছিপ নিয়ে বসে থাকত। বর্ষা মৌসুমে পাকা ধানের শীষভর্তি পালতৌলা নৌকা বহমান ছিল। তিনি বলেন, এখন নদীর অবস্থা শুকনো। কোথায় হাঁটুপানি। নদীর এপার থেকে ওপার হেঁটে পার হওয়া যায়। গরু-ছাগলের চারণভূমিতে পরিণত হয়েছে। অনেকে বাধ্য হয়ে জেলে থেকে অন্য পেশায় চলে গেছে।
পুনর্ভবা নদী-সংলগ্ন নাদেরাবাদ গ্রামের বাসিন্দা শরিফুল ইসলাম বলেন, একসময় নদীটিতে কাণায় কাণায় পানিভর্তি ছিল। এখন গোসল করার মতো পানি নেই। নদীর দুই কূলজুড়ে এখন শুধুই চারণভূমি।
রামদাস বিল এলাকার কৃষক সাইফুল ইসলাম বলেন, শেষ মুহূর্তে পাকা ধানের ক্ষেতে প্রচুর পানির দরকার হয়। অথচ নদীতে পানি না থাকায় ক্ষেত শুকিয়ে যাচ্ছে। দুই দশক আগে পানির জন্য চাষাবাদে সেচের ব্যঘাত ঘটত না। বর্তমানে নদীতে যেটুকু পানি চলমান আছে সেটুকু শ্যালোমেশিন দিয়ে উঠাতে কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ছে। ঠিকমত জমিতে সেচ দিতে না পারায় ফসলের উৎপাদন কম হয়। জরুরি ভিত্তিতে সারা বছর পানি থাকে তার ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট দপ্তর ও সরকারকে এগিয়ে আসার অনুরোধ জানান তিনি ।
কাজিগ্রাম সোনার বাংলা পানি ব্যবস্থাপনা সমবায় সমিতি লিমিটেডের সভাপতি প্রভাষক বাবুল হাসান জানান, রহনপুর থেকে কাজিগ্রাম পর্যন্ত প্রায় শতাধিকের ওপর সেচ পাম্প রয়েছে। ইরি/বোরো মৌসুমে এ সেচ পাম্পগুলো দিয়ে হাজার হাজার একর জমি চাষাবাদ হয়ে থাকে। কিন্তু নদীতে পানি না থাকায় কৃষকের জমিতে সেচ দিতে বিঘ্ন ঘটছে। ব্যক্তি উদ্যোগে গত বছর রহনপুর বাজার মহন্ত ঘাটের নিচে পানি প্রবাহের জন্য ড্রেজিং করা হয়েছে। নদীটি খনন বা রক্ষণাবেক্ষণের কোনো উদ্যোগ কেউ নেয়নি। তিনি সংশ্লিষ্ট দপ্তরের মাধ্যমে নদীটি দ্রুত খননের জোর দাবি জানান।
এ বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ড চাঁপাইনবাবগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলী মোখলেছুর রহমান বলেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলায় মহানন্দা নদীতে রাবারড্যাম নির্মাণ কাজ চলছে। এ প্রকল্পের কাজ শেষ হলে শুষ্ক মৌসুমেও পুনর্ভবা নদীতে পানি থাকবে। কৃষি ও মৎস্য খাতে ব্যাপক পরিবর্তন আসবে। তবে নদী খননে এখন কোনো পরিকল্পনা নেই বলে তিনি জানান।