Last Updated on ফেব্রুয়ারি ১, ২০২৫ by
গৌড় বাংলার এগিয়ে চলার দশ বছর
আজিজুর রহমান শিশির
দিন যায়, মাস আসে। এমনি করে দেখতে দেখতে দৈনিক গৌড় বাংলার দশ বছর পার হয়ে গেল। এই দশটি বছরে আরো অনেক কিছু করার ছিল, কিন্তু পারিনি। তবে আমরা কি করেছি আর কি করতে পারিনি তা অবশ্যই আমাদের ভাবনার মধ্যে ছিল এবং রয়েছে।
আম, কাঁসা, লাক্ষা, রেশম শিল্পের ধারক ও বাহক চাঁপাইনবাবগঞ্জ। এ জেলার ইতিহাস-ঐতিহ্য বহু পুরাতন। এ জেলারই গৌড়ে ছিল বাংলার রাজধানী। পদ্মা, মহানন্দা, পাগলা আর পুনর্ভবা নদী বিধৌত জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জ। সমস্যা যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে বিপুল সম্ভাবনাও। আমরা সেই সমস্যা ও সম্ভাবনাকে আপনাদের সামনে তুলে ধরার কথা বলে যাত্রা শুরু করেছিলাম। আর তাই, এ ক্ষেত্রগুলোতে আমরা কাজ করেছি। কাজ করেছি শিল্প, সংস্কৃতি, সাহিত্য ক্ষেত্রেও। এই দশটি বছরে উন্নয়নমূলক খবরাখবরের পাশাপাশি আমরা স্বাস্থ্য, যোগাযোগ, নদী রক্ষা, পরিবেশ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজ করেছি।
পত্রিকার যাত্রার শুরুতেই আমরা চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর হাসপাতালের সমস্যার কথা তুলে ধরেছিলাম। তুলে ধরেছিলাম নদীগুলো শুকিয়ে যাওয়ার কথা। তুলে ধরা হয়েছিল বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সমস্যার কথাও। সেই ধারা আমরা আজও অব্যাহত রেখেছি। হয়তো সবটা একেবারে পাঠকের চাহিদামতো পারিনি। না পারার বেদনা আমাদের মধ্যেও আছে। তবে এ কথা বলতেই হবে যে, গত এক দশকে গৌড় বাংলা যতটুকু এগিয়েছে তার সবটুকুই এর পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং শুভাকাক্সক্ষীদের জন্যই। এছাড়া যাঁরা বিভিন্ন বিষয়ে লেখা দিয়ে গৌড় বাংলার পাতাকে সমৃদ্ধ করেছেন, শুরু থেকেই যাঁরা সংবাদকর্মী হিসেবে আমাদের সাপোর্ট দিয়ে যাচ্ছেনÑ দশক পূর্তির এই দিনে তাঁদের সবাইকে অভিনন্দন। অভিনন্দন যাঁরা সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে বিজ্ঞাপন দিয়ে আমাদের আর্থিকভাবে সহযোগিতা করেছেন। আমরা জানি, একটি পত্রিকা চালাতে হলে বিজ্ঞাপন কতটা প্রয়োজন। প্রত্যাশা, তাঁরা ভবিষ্যতেও আমাদের এইভাবে সহযোগিতা করবেন।
গৌড় বাংলার জন্ম ইতিহাস বলতে গেলে একটু পেছনে যেতে হয়। আমি তখন সাপ্তাহিক গৌড় সংবাদে ব্যবস্থাপনা ইনচার্জ হিসেবে কাজ করি। কিন্তু অফিস, বিজ্ঞাপন, সংবাদ সবটাই আমাকে দেখতে হতো। সে সময় দেখতাম, আজকের দৈনিক গৌড় বাংলার সম্পাদক ও প্রকাশক হাসিব হোসেন প্রয়াস মানবিক উন্নয়ন সোসাইটির নির্বাহী পরিচালকের দায়িত্বে থেকে সংস্থাটিকে তিলতিল করে এগিয়ে নিচ্ছেন। সেই সুবাদেই তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয়। সেই সময় তিনি সংবাদ ও বিজ্ঞাপন দিয়ে যথেষ্ট সহযোগিতা করেন। শুধু তাই নয়, সহকর্মীদের অনেককেই গৌড় সংবাদের গ্রাহক করে দেন। তো তখন থেকেই তিনি আমাকে বলতেন, “শিশির ভাই, আমার একটি দৈনিক পত্রিকা করার ইচ্ছা রয়েছে, সুযোগ পেলে করব।”
কিন্তু পত্রিকার আগেই তিনি কমিউনিটি রেডিও ‘রেডিও মহানন্দা’র অনুমোদন নিয়ে সম্প্রচারে নিয়ে আসেন। যা আজ পিছিয়ে পড়া মানুষের কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছে। পরে তিনি সত্যিই সুযোগ করে নিয়েছেন এবং পত্রিকার ডিক্লারেশন নিয়ে বাজারে এনেছেন। বলার অপেক্ষা রাখে না, হাসিব হোসেন একজন অসম্ভব মেধাবী মানুষ। তাঁর হাত ধরে প্রয়াস মানবিক উন্নয়ন সোসাইটি আজ বিশাল এক প্রতিষ্ঠান। যাঁর অধীনে রয়েছে কৃষি খাতসহ অন্যান্য খাত। যে প্রতিষ্ঠানে বহু মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। আছে রেডিও মহানন্দা, প্রয়াস ফোক থিয়েটার ইনস্টিটিউট, প্রয়াস হসপিটাল ও গৌড় বাংলা।
আজ আমার বেশ মনে পড়ছে শুরুর আগের এবং পরের সেই দিনগুলোর কথা। ২০১৪ সালের ১১ নভেম্বর তৎকালীন জেলা প্রশাসক জনাব মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর কবির মহোদয় প্রাণের পত্রিকা দৈনিক গৌড় বাংলার ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করেন। অর্থাৎ পত্রিকাটি ছাপানোর অনুমতি পাওয়া যায়। পত্রিকা প্রকাশের অনুমতি পাবার বেশ আগে থেকেই গৌড় বাংলার সম্পাদক ও প্রকাশক জনাব হাসিব হোসেন আমার সাথে এবং এটিএন বাংলার চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রতিনিধি নাসিম মাহমুদের সাথে একাধিক বৈঠক করেছেন। হয়তো আমাদের পাশাপাশি তিনি আরো অনেকের সাথেই আলাপ-আলোচনা করেছেনÑ এর আঙ্গিক কেমন হবে, কীভাবে করা যাবে ইত্যাদি নিয়ে।
একপর্যায়ে আমি এবং নাসিম মাহমুদ গৌড় বাংলায় যোগদান করি। নাসিম মাহমুদ দায়িত্ব পালন করেন নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে (শুরুর কয়েক বছর যুক্ত ছিলেন) এবং আমি ব্যবস্থাপনা সম্পাদকের। আমি আজও সে দায়িত্ব পালন করছি। এছাড়া শুরু থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক হিসেবে ছিলেন তরুণ সাংবাদিক আব্দুর রব নাহিদ। আর আমাদেরকে সহযোগিতার জন্য ছিলেন তারুণ্যে ভরপুর ডি এম কপোত নবী। অন্যদিকে আল আমিনের নেতৃত্বে এবং শামীম রেজার সহায়তায় সেই প্রথম থেকে তাঁদের নিপুণ হাতের ছোঁয়ায় কোয়ার্কএক্সপ্রেস সফটওয়্যারে প্রতিদিন পত্রিকাটি সেজে-গুজে বের হতে থাকে। অদ্যবধি গৌড় বাংলার অর্থকড়ি ও হিসাব-নিকাশ প্রতিনিয়ত সামলাচ্ছেন শফিকুল ইসলাম। বর্তমানে রিপোর্টিংসহ সাজানো গোছানো অর্থাৎ গ্রাফিকসের কাজটি করছেন শাহরিয়ার হোসেন শিমুল।
পত্রিকার প্রাণ হচ্ছে সংবাদ আর এই সংবাদে সার্বক্ষণিক সহযোগিতা করে চলেছেন আমাদের প্রাণের জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ থেকে এ কে এস রোকন (শুরুতে ছিলেন আতিক ইসলাম সিকো), শুরু থেকেই গোমস্তাপুর উপজেলা প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করছেন আল মামুন বিশ্বাস, নাচোল থেকে মতিউর রহমান, ভোলাহাট থেকে প্রথমে রবিউল ইসলাম এবং পরে যোগ দেন গোলাম কবির। এছাড়াও গোদাগাড়ী থেকে শহিদুল ইসলাম, তানোর থেকে টিপু সুলতান, নিয়ামতপুর থেকে সিরাজুল ইসলাম, নওগাঁ থেকে রায়হান আলম, সাপাহার থেকে তসলিম উদ্দিন এবং রাজশাহী থেকে নূরে ইসলাম মিলন বেশ কয়েক বছর কাজ করেছেন। তবে সিরাজুল ইসলাম এখনো কাজ করছেন। প্রতিদিনের খেলাধুলার সংবাদ দিয়ে সহযোগিতা করেছেন শহিদুল হক সুয়েল। প্রত্যেককে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।
অভিনন্দন জেলার সাংবাদিক বন্ধুদেরও। যাঁরা এই পত্রিকাটিকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করেছেন এবং করে যাচ্ছেন। এছাড়া প্রয়াস মানবিক উন্নয়ন সোসাইটির কর্মকর্তা-কর্মী ও রেডিও মহানন্দার কর্মকর্তা এবং এর কলাকুশলীরা যথাসাধ্য সহযোগিতা করে চলেছেন, তাদেরকেও অভিনন্দন। অভিনন্দন রেডিও মহানন্দার নারী সংবাদকর্মীদের, যাঁদের তৈরি করা ফিচারে গৌড় বাংলা সমৃদ্ধ হয়েছে।
যে কথা বলছিলাম, ২০১৪ সালের নভেম্বরের গোড়ার দিকে দৈনিক গৌড় বাংলার প্রকাশনার অনুমতি পাওয়া যায়। বিধি মোতাবেক ৩ মাসের মধ্যে পত্রিকা প্রকাশ করতে হবে। তবে ৩ মাস পূর্ণ হবার আগেই দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অসহিষ্ণু হয়ে পড়ে। বাঁধাধরা নিয়মের কারণে ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারির শুরুতেই পত্রিকা প্রকাশনা শুরু করতেই হয়। ভাষার মাস ফেব্রুয়ারির প্রথম দিনটাকেই বেছে নেয়া হয়। প্রথম সংখ্যাটি কেমন হবে তা নিয়ে আমাদেরকে যে কি বেগ পোহাতে হয়েছে তা আমরাই অনুভব করতে পারি। তবে অনেকের মধ্যে একজনের নাম না বললে নয়, তিনি হলেন সাজিদ তৌহিদ। সাজিদ তৌহিদ ঢাকার পত্রিকাগুলোয় কাজ করার সুবাদে আমাদের গোটা টিমের মধ্যে একমাত্র তিনিই জানাশোনা মানুষ। তিনি সুদূর নাচোল থেকে বহু কষ্ট স্বীকার করে প্রতিদিন মোটরসাইকেলে চেপে এসে গৌড় বাংলার প্রথম সংখ্যার মূল সংস্করণের পাশাপাশি ক্রোড়পত্রটি সাজিয়ে-গুছিয়ে দিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, পত্রিকার সাজগোজ কেমন হবে, কী করলে পত্রিকাটি পাঠকের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাবে, সে ব্যাপারেও সাজিদ তৌহিদ আমাদের পরামর্শ দিয়েছিলেন। তাঁকেও জানাই আন্তুরিক অভিনন্দন। বলে রাখি, সাজিদ তৌহিদ ২০১৯ সালের ৯ মার্চ থেকে গৌড় বাংলার বার্তা সম্পাদক হিসেবে যোগদান করে দায়িত্ব পালন করছেন।
ফেব্রুয়ারির ১ তারিখ। প্রথম সংখ্যার কাজ শেষ হতে রাত ১২টা পার হয়ে গিয়েছিল। সবার চোখেমুখে ক্লান্তির ছাপ। মনে ভয়ও ছিল, হয়তো কোথাও ভুল থাকল কিনা, সেই ভেবে। ছিলও হয়তো। কিন্তু তবু এত ক্লান্তির পরও বেশ আনন্দ বা সুখ অনুভূত হচ্ছিল এই ভেবে যে, শেষ পর্যন্ত গৌড় বাংলা আলোর মুখ দেখল। যতটুকু মনে পড়ছে, পত্রিকার কাজ শেষ করে প্রেসে পাঠিয়ে দিয়ে সম্পাদক মহোদয়ের আমন্ত্রণে জেলাশহরের বিশ^রোড় মোড়ে আমরা সবাই কলাই রুটি খেয়েছিলাম।
আগেই উল্লেখ করেছি, সময়টা তখন রাজনৈতিকভাবে খুবই অস্থিতিশীল ছিল। আল আমিনের বাসা দূরে হওয়ায় পুলিশের সহযোগিতায় তাকে বাড়ি পাঠানো হয়।
এরপর শুধুই এগিয়ে যাওয়ার পালা। পেছনে ফেরার সময় নেই। বলতেই হয়, পেশাদার সাংবাদিক না হয়েও সংবাদ সম্পর্কে সম্পাদক হাসিব হোসেনের ভালো ধারণা আছে। তিনি মনে করেন, জেলার সমস্যা ও সম্ভাবনার জায়গাগুলোতে কাজ করতে হবে, নারীর ক্ষমতায়ন, উন্নয়ন ইত্যাদি ক্ষেত্রেও কাজ করতে হবে। সেইভাবেই আমরা কাজ করে যাচ্ছি। আগেই বলেছি, কতটা পেরেছি তা পাঠকই ভালো বলতে পারবেন।
উল্লেখ্য, প্রকাশনার পরের বছর গৌড় বাংলা চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের (ডিএফপি) মিডিয়াভুক্তি লাভ করে।
সাংবাদিকতা জীবন অনেক আগে থেকে হলেও নিজেরা দেখে শুনে পত্রিকা বের করা ছিল একেবারেই নতুন। আর তাই পত্রিকা নিয়ে প্রতিনিয়তই ভাবতে হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। এ এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা। কোনটি প্রধান সংবাদ হবে, কোন সংবাদটি কোনখানে বসবে তা নিয়ে সম্পাদকের পাশাপাশি ভাবেন বার্তা সম্পাদক সাজিদ তৌহিদ।
পরিশেষে সব মিলিয়ে বলতে চাই, শেখার কোনো শেষ নেই। আর তাই আমরা প্রতিনিয়তই শেখার চেষ্টা করছি। দশ বছরে কি পেরেছি আর কি পারিনি, কি ভুল থেকেছেÑ তার সবকিছুই মূল্যায়ন করে এবং আমাদের প্রতিশ্রুতির কথা বিবেচনায় রেখে আগামী দিনে কাজ করার প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে।
আজিজুর রহমান শিশির : ব্যবস্থাপনা সম্পদাক, দৈনিক গৌড় বাংলা