মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস ২০২২ উপলক্ষে দেয়া বাণীতে চাঁপাইনবাবগঞ্জের জেলা প্রশাসক এ কে এম গালিভ খান ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত উন্নত দেশের প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছেন। শনিবার সকাল ৮টায় ডা.আ.আ.ম. মেসবাহুল হক (বাচ্চু ডাক্তার) স্টেডিয়ামে জেলা প্রশাসনের আয়োজনে জাতীয় পতাকা উত্তোলন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীদের সমাবেশ, জাতীয় সংগীত পরিবেশন, কুচকাওয়াজ ও ডিসপ্লে প্রদর্শকালে জেলা প্রশাসক এ কে এম গালিভ খান তাঁর বাণীটি পাঠ করেন।
সকলকে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়ে বাণীতে জেলা প্রশাসক বলেন-“আজ ২৬ মার্চ, মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস। ঐতিহাসিক এই দিনে আমি পরম শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির উপর অতর্কিত আক্রমণ চালালে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন; যে ঘোষণাটি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ষষ্ঠ তফসিলে সন্নিবেশিত হয়েছে।
এরপর দীর্ঘ নয় মাস সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা অর্জন করি স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ।
মহান মুক্তিযুদ্ধে আমি সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করছি মহান মুক্তিযুদ্ধে আত্মোৎসর্গকারী বীর শহিদদের, যাঁদের সর্বোচ্চ ত্যাগের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি স্বাধীনতা। আমি কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করি জাতীয় চার নেতা, বীর মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও সমর্থক, বিদেশি বন্ধু এবং সকল স্তরের জনগণকে, যাঁরা আমাদের অধিকার আদায় ও মুক্তিসংগ্রামে বিভিন্নভাবে অবদান রেখেছেন।
জেলা প্রশাসক তাঁর বাণীতে আরো বলেন-“অনেক ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের মহান স্বাধীনতা। বঙ্গবন্ধু সবসময় রাজনৈতিক স্বাধীনতার পাশাপাশি একটি সুখী-সমৃদ্ধ দেশ গড়ার স্বপ্ন দেখতেন। তাঁর সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে বর্তমান সরকার নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের মহাসড়কে অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে চলেছে। দারিদ্র্য বিমোচন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, মানবসম্পদ উন্নয়ন, নারীর ক্ষমতায়ণ, শিশু ও মাতৃমৃত্যু হার হ্রাস, লিঙ্গ বৈষম্য দূরীকরণ, গড় আয়ু বৃদ্ধিসহ আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেছে। দারিদ্র্যের হার কমছে। এক দশকে মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পেয়েছে তিনগুণ। নিজস্ব অর্থায়নে নিমার্ণাধীন পদ্মাসেতু এখন এক বাস্তবতা। মেট্রোরেল, পায়রা গভীর সমুদ্র বন্দর, বঙ্গবন্ধু টানেল, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল ও রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাজও নিরবচ্ছিন্নভাবে এগিয়ে চলেছে। অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশ শুধু দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশি দেশগুলোই নয়, অনেক উন্নত দেশকেও ছাড়িয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে।”
জেলা প্রশাসক বলেন-“মহামারী করোনার প্রভাবে গোটা বিশ্বের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়লেও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সময়োচিত ও সাহসী পদক্ষেপের ফলে সরকার করোনার প্রভাব মোকাবিলা করে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে। এসময় প্রবাসী বাংলাদেশিদের প্রেরিত বিপুল পরিমাণ রেমিটেন্স অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। অর্থনীতির ইতিবাচক প্রবাহ বজায় রাখতে সরকার ১ লাখ ২৪ হাজার কোটি টাকার ২৩টি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। বিনামূল্যে কোভিড-১৯ এর ভ্যাকসিন প্রদানেরও ব্যবস্থা করা হয়েছে। করোনা মহামারীর সফল মোকাবিলা, অর্থনীতির পুনরুজ্জীবন ও জীবনমান সচল রাখার ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদ সংস্থা ব্লুমবার্গ প্রণীত ‘কোভিড-১৯ সহনশীল র্যাংকিং’- এ বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় শীর্ষ এবং বিশ্বে ২০তম স্থান অর্জন করেছে। এর মাধ্যমে বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি আরও উজ্জ্বল হয়েছে।”
জেলা প্রশাসক তাঁর বাণীতে আরো উল্লেখ করেন “বাংলাদেশের উন্নয়নের ধারায় সাবেক গৌড়ের রাজধানী চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায়ও ব্যাপক উন্নয়ন কর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম স্থলবন্দর সোনামসজিদকে আধুনিকায়ন করার পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে। বিল ভাতিয়াকে ঘিরে গ্রহণ করা হয়েছে আধুনিক এগ্রোবেজড ইকোনমিক জোন প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ, যা এই অঞ্চলের কৃষি ও শিল্প বিপ্লব ঘটাতে সাহায্য করবে। আজাইপুর বিল সংস্কারের মাধ্যমে বিনোদন ও পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত করা হচ্ছে। মহানন্দা নদীর উপর নির্মাণ করা হয়েছে শেখ হাসিনা সেতু এবং নির্মিত হচ্ছে রাবার ড্যাম। আধুনিক সদর হাসপাতালটি ২৫০ শয্যায় উন্নীত হয়েছে। রেলপথে যোগাযোগের উন্নয়ন হিসেবে সারাদেশের সাথে আন্তঃনগর ট্রেন যোগাযোগ চালু হয়েছে। এ জেলায় নান্দনিক পাসপোর্ট ভবন, যুব উন্নয়ন ভবন, বাফার গুদাম ইত্যাদি নির্মাণ করা হয়েছে। ৬টি মডেল মসজিদের নির্মাণ কাজ সমাপ্তির পথে। নির্মাণ করা হয়েছে আধুনিক মানের ম্যাংগো মার্কেট। আমের রাজধানীতে উৎপাদিত ক্ষিরসাপাত দেশের তৃতীয় জিআই পণ্য হিসেবে আন্তর্জাতিক খ্যাতি লাভ করেছে। ১০০ বিঘার অধিক জবরদখলকৃত আমবাগান পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে গড়ে তোলা হয়েছে ‘বঙ্গবন্ধু লাইভ ম্যাংগো মিউজিয়াম’। পবিত্র রমজান উপলক্ষ্যে সমগ্র বাংলাদেশে তৃণমুল পর্যায়ে নিম্নআয়ের মানুষের প্রায় ০১ (এক) কোটি পরিবারের মধ্যে টিসিবি’র পণ্য সামগ্রী পৌঁছে দেয়ার অংশ হিসেবে এই জেলার ১,৩০,৩২০ জন উপকারভোগীর হাতে পৌঁছে দেয়া হচ্ছে ন্যায্যমূল্যে টিসিবির পণ্য। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার হারানো সংস্কৃতি, লোকগীতি, গম্ভীরা, আলকাপ, ঝান্ডি, খেলাধুলা ইত্যাদিকে জীবিত করার ব্যাপক কর্মপরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে”।
সম্প্রতি বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের জন্য জাতিসংঘ কর্তৃক চূড়ান্ত সুপারিশ লাভ করেছে। মুজিববর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর সন্ধিক্ষণে এটি জাতির জন্য একটি অনন্য উপহার। টেকসই উন্নয়নের এ অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকলে ২০৪১ সালের মধ্যেই বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে একটি উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে, ইনশাআল্লাহ”।
‘সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে বৈরিতা নয়’-বঙ্গবন্ধুর এই উদ্ধৃতি উল্লেখ করে জেলা প্রশাসক বলেন-“বঙ্গবন্ধুর এ আদর্শ অনুসরণে আমাদের পররাষ্ট্র নীতি পরিচালিত হচ্ছে। বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠাসহ আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও আমাদের অর্জন প্রশংসনীয়। বাংলাদেশ একটি ঘনবসতিপূর্ণ দেশ হওয়া সত্ত্বেও মিয়ানমার থেকে জোরপূর্বক বিতাড়িত ও নির্যাতিত এগার লক্ষাধিক রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ বিশ্ব দরবারে মানবতার এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের জন্য সকল ধরনের সুযোগ সুবিধাসহ উন্নত আবাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে”।
স্বাধীনতার কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জনে জনমুখী ও টেকসই উন্নয়ন, সুশাসন, সামাজিক ন্যায়বিচার, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে পরমত সহিষ্ণুতা, মানবাধিকার ও আইনের শাসন সুসংহত করতে বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতির চিরন্তন প্রেরণার উৎস। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী সাড়ম্বরে উদযাপনের লক্ষ্যে সরকার ‘মুজিববর্ষ’র সময়সীমা ৩১ মার্চ ২০২২ পর্যন্ত বৃদ্ধি করেছে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও মুজিববর্ষের এই সন্ধিক্ষণে সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত উন্নত দেশে পরিণত হোক- মহান স্বাধীনতা দিবসে এ আমার প্রত্যাশা।
এসময় পুলিশ সুপার এএইচএম আবদুর রকিব উপস্থিত ছিলেন।