আল-মামুন বিশ্বাস
পবিত্র ঈদুল আজহা আগামী বৃহস্পতিবার। অর্থাৎ আজ রাত পোহালেই কোরবানি ঈদ। ঈদ মানেই আনন্দ। আর এই ঈদে যে যার সাধ্যের মধ্যে কোরবানি দেবেন গরু বা ছাগলসহ অন্যান্য প্রাণী। আর প্রাণী জবাই থেকে শুরু করে কাটাকাটি করতে প্রয়োজন ধারালো বস্তু ছোরা, চাকু, দা এমনকি কুড়াল। আর তাই ঈদকে সামনে রেখে পুরাতন এইসব জিনিস মেরামত বা শান এবং নতুন তৈরিতে ব্যস্ত দিন পার করছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার পেশাদার কামাররা।
শেষ মুহূর্তে প্রয়োজনীয় এইসব জিনিসপত্র শান দিতে মানুষ ভিড় জমাচ্ছেন কামারদের দোকানে। হাপরের ফোঁস ফোঁস হাওয়া আর হাতুড়ির টুংটাং শব্দে মুখরিত থাকছে সব কামারপাড়া। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত দোকানগুলোতে হাতুড়ির টুংটাং শব্দ শোনা যাচ্ছে। নতুন ও পুরোনো চাকু, ছুরি, দা, চাপাতি, বটি, হাঁসুয়া ইত্যাদি তৈরি ও শান দিচ্ছেন তারা। প্রতিটি কামারশালায় ব্যস্ততা লক্ষ্য করা গেছে। এদিকে অনেক কামার জানিয়েছেন গত বছরের তুলনায় এবার শান দেওয়া ও কোরবানির কাজের তৈরি করা সরঞ্জামগুলোর বিক্রি কম।
রহনপুর পৌর এলাকার কামারশালাগুলো ঘুরে দেখা গেছে, কেউ নিজে বা অন্যজনকে দিয়ে হাপর টানাসহ হাওয়ার ফুলকিতে কয়লা (আগুন) দিচ্ছেন, কেউ লোহা গরম করে পেটাচ্ছেন ও আর পানি দিচ্ছেন। কাজের চাপে কারো সঙ্গেই কথা বলার সময়টুকু পাচ্ছেন না তারা। কোরবানির কাজে ব্যবহৃত সরঞ্জামগুলো কামারেরা প্রকারভেদে ৪০ টাকা থেকে ১৩০ টাকা পর্যন্ত শান দিচ্ছেন।
এদিকে উপজেলার সদর রহনপুরসহ বিভিন্ন বাজারে কোরবানির পশু জবাই করা ছুরি, চামড়া ছড়ানো ও গোস্ত কাটা চাকু, বঁটি, হাঁসুয়া, চাপাতিসহ গোস্ত কাটার কাঠ বিক্রি করতে দেখা গেছে। তারা দোকানের সামনে সাজিয়ে এসব কাঠ বিক্রি করছেন।
কামারের তৈরি ছোট ছুরি ৫০ টাকা থেকে ১০০ টাকা, মাঝারি থেকে বড় ১০০ টাকা থেকে ৩৫০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। বঁটি ৮০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা, হাঁসুয়া ৯০ টাকা থেকে ৩২০ টাকা, চাপাতি ৩০০ টাকা থেকে ৬০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করছেন কামাররা।
অন্যদিকে আধুনিক প্রযুক্তির এসব জিনিসও বাজারে বিক্রি হচ্ছে। অনেককে দোকানে সেগুলো কিনতে দেখা গেছে। তবে দেশীয় প্রযুক্তির তৈরি বাড়িতে থাকা হাঁসুয়া, বঁটি, দা, চাকু, ছুরি, চাপাতি পুড়িয়ে শান দিতে বেশি দেখা গেছে।
রহনপুর পৌর এলাকার বিভিন্ন স্থানে ৮টি মতো শানের দোকান আছে বলে কামাররা জানিয়েছেন। খোয়াড় মোড়ের বিফল কর্মকার জানান, কোরবানি ঈদের কারণে সকাল থেকে রাতে ২টা পর্যন্ত শানের কাজ করতে হচ্ছে। পূর্বের বছরগুলোতে ঈদের দুই সপ্তাহ আগে থেকে কাজের চাপ হতো। কিন্তু এ বছর শানের কাজ কম হয়েছে।
ছেলেকে নিয়ে শেষ মুহূর্তে কাজ করছেন তিনি। অনেকে ন্যায্য মজুরি দিচ্ছেন না। কম টাকা দিয়ে চলে যাচ্ছেন। তার বাড়ি দোকান থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে আলিনগর এলাকায়। প্রতিদিন সকালে সাইকেল করে ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে দোকানে আসেন। রাত পর্যন্ত কাজ করে বাড়ি ফিরেন।
এ সময় বাড়িতে থাকা ভাঙ্গা ও মরিচাধরা, হাঁসুয়া, বঁটি, ছুরি, চাকু, চাপাতি বেশি কাজ হচ্ছে। এই কয়েক দিন নতুন জিনিস তৈরি করতে পারছেন না। প্রতিদিন ২ হাজার থেকে ৩ হাজার টাকা আয় করছেন বলে তিনি জানান।
সঞ্জয় কর্মকার নামে আরেকজন কামার বলেন, তিনিও ছেলেকে নিয়ে এই কাজ করছেন। বাপ-দাদার কাছ থেকে এ কাজ শিখেছি। তাই অন্য কাজ করতে যাই না। সারাবছর টুকটাক করে কাজ করে কোনোমতে সংসার চলে। তবে বিভিন্ন মেলার সময় এই কাজের চাপ বাড়ে। তবে কোরবানির ঈদ এলেই অতিরিক্ত কাজের চাহিদা বেড়ে যায়। তিনি জানান, সকাল থেকে একটানা রাত পর্যন্ত কাজ করতে হয়। অন্য সময় প্রতিদিন ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকা আয় হতো। এখন ঈদের সময় দেড় থেকে আড়াই হাজার টাকা উপার্জন করছেন।
ধূলাউড়ি মহল্লার দুধ কুমার বলেন, ঈদ সামনে রেখে ভালো উপার্জন হচ্ছে। লোকজন পুরোনো যন্ত্রপাতি বেশি শান দিতে আসছেন।
খোয়াড় মোড়ে শান দিতে আসা সাবেক ইউপি সদস্য মিজানুর রহমান মেজর জানান, তিনি ছোটো-বড় তিনটি সরঞ্জাম নিয়ে এসেছেন। বসে থেকে করে নিয়ে যাবেন। তার কাছে ২০০ টাকা দাবি করছেন।
কালাম নামে আরেকজন বলেন, প্রতিবছর কোরবানির ঈদে কামারে কাছে এসে ঠিক করে নেন। ৬টি সরঞ্জাম নিয়ে এসেছেন। প্রকারভেদে ৫০ টাকা থেকে ১০০ টাকা করে মজুরি চাচ্ছেন।
বাবু নামে আরেকজন দাঁড়িয়েছিলেন, তিনি বলেন, বাজার থেকে রেডিমেড ছুরি কিনে এনেছি। একবার কেটে আর কাটে না। এখানে কামারের কাছে এসেছি ভালো রড দিয়ে বানিয়ে নিবেন। উপজেলার অন্য কামারের দোকানগুলোর একই অবস্থা লক্ষ্য করা গেছে।
তবে অনেকে এ পেশায় সন্তুষ্ট নন বলে কথা বলে জানা গেছে। তার কারণ হিসেবে তারা জানান, কাজের শ্রম হিসেবে মজুরি কম।
এদিকে ঈদুল আজহার কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে গোমস্তাপুর উপজেলায় ৭ হাজার ৯৫৪টি ষাঁড়, ৬ হাজার ৭৯৮টি বলদ, ৭ হাজার ১২৬টি গাভী ও ৩৮টি মহিষসহ ৬ হাজার ৬৬টি ছাগল ও ৩ হাজার ৫৮৯টি ভেড়া প্রস্তুত রয়েছে বলে উপজেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে ।