করোনাকালে অসহায় মানুষের পাশে ত্রাণ নিয়ে সরকার

50
ফাতিমা তুজ জোহরা

বৈশ্বিক মহামারি করোনা ভাইরাসে বিপর্যস্ত গোটা বিশ্ব। প্রাণঘাতী এই ভাইরাসের করাল থাবা গ্রাস করেছে বাংলাদেশকেও। এই ভাইরাসের কারণে দেশে কর্মহীন মানুষের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। তবে মানুষ মানুষের জন্য। মহামারির এই সময়ে তাই সরকারি অনুদান নিয়ে কর্মহীন মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান। করোনা দুর্গত মানুষের ঘরে ঘরে ত্রাণ পৌঁছে দিতে কাজ করে চলেছেন জনপ্রতিনিধি ও সরকারি কর্মকর্তারা। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যভাবে রয়েছেন, বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও মেম্বার এবং পৌর মেয়র ও কাউন্সিলর। এই সময়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ত্রাণ বিতরণসহ সরকারি অনুদানের ১০ টাকা কেজি চালের ভিজিএফ কার্ড প্রদান করে জেলাবাসীর পাশে দাঁড়িয়েছেন জনপ্রতিনিধিরা।
আমের রাজধানী হিসেবে খ্যাত সীমান্ত ঘেঁষা জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জেও করোনা ভাইরাসের প্রকোপে কর্মহীন হয়ে পড়েছেন অনেকেই। এই দুঃসময়ে অসহায়, কর্মহীন দুস্থ মানুষদের সহযোগিতায় সরকারি অনুদান নিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছেন জনপ্রতিনিধিরা। এগিয়ে এসেছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও। সরকারি-বেসরকারি অনুদান পেয়ে কিছুটা হলেও খেটে খাওয়া মানুষ উপকৃত হচ্ছেন। এছাড়া শুধু চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌরসভাতেই কর্মহীনদের জন্য ১০ টাকা কেজি দরের চালের জন্য ১৪ হাজার বিশেষ ওএমএস কার্ডেরও ব্যবস্থা করা হয়েছে। যে কার্ড দিয়ে প্রতি মাসে ২০ কেজি চাল উত্তোলন করতে পারবেন কার্ডধারীরা। এতে করোনাকালে অনেকটাই সাশ্রয় হবে ওইসব পরিবারে।
কথা হয় দুজন কার্ডধারীর সঙ্গে। এরা হলেন- চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌরসভার ৫নং ওয়ার্ডের উপররাজারামপুরের রেবিনা খাতুন ও সৈয়ফা বেগম। বিশেষ ওএমএস কার্ড পেয়ে খুশি রেবিনা খাতুন বলেন, “আমার স্বামী দিনমজুর। এই কার্ডটা পেয়ে খুব উপকার হলো আমাদের। বাইরে চালের দাম তো অনেক বেশি, কিনতে খুবই কষ্ট হতো।”
আর সৈয়ফা বেগমের কথা, ‘স্বামী দিনমজুর। দিন আনে দিন খাই। দেরিতে হলেও কার্ডটা পেয়ে খুব উপকারে লাগবে। অন্তত প্রতি মাসে ১০ টাকা দরে ২০ কেজি চাল তো পাবো। গরিব মানুষ, এ উপকার তো বলে বোঝানো যাবে না।”
তবে কার্ড নিয়েও কারো কারো প্রশ্ন রয়েছে। করোনায় বিপর্যস্ত অনেকেই এই কার্ড পাননি বলে অভিযোগ রয়েছে। সেখানকারই কয়েকজন এই অভিযোগ তুলে ধরেছেন এই প্রতিবেদকের কাছে। এদের একজন শ্রী অঞ্জলী। হাতের সমস্যার কারণে স্বামী অনেক দিন থেকেই কাজ করতে পারেন না। বড় মেয়ে একটি বেসরকারি সংস্থায় কাজ করতেন। এখন করেন না। ছোট দুই সন্তানের আয় দিয়েই চলে অঞ্জলীর সংসার। তার অভিযোগ, “একজনের সহায়তায় দুইবার ত্রাণ পেয়েছি। যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। কিন্তু ১০ টাকা কেজি দরের চালের জন্য কোনো কার্ড পাইনি। এটি পেলে আমাদের মতো গরিব পরিবারের জন্য খুবই উপকার হতো। চাল কেনা বাবদ অনেক টাকা বেঁচে যেত।” তাই একটা কার্ড বরাদ্দের আকুতি শ্রী অঞ্জলীর।
ওই একই এলাকার লতিফন বেগম। স্বামী অটোচালক। করোনার সময়ে আগের মতো আর আয় হয় না অটো চালিয়ে। তিনিও বিশেষ ওএমএসের কার্ড পাননি। লতিফন বলেন, “বেশ কয়েকবার কয়েকজনকে আমার ভোটার আইডি কার্ডের ফটোকপি দিয়েছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত কার্ড পাইনি।” তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, “২০০ টাকায় যদি ২০ কেজি চাল পাই, তাহলে চাল নিয়ে তো আর চিন্তাই থাকে না। এই বিপদের দিনে তো ওটাই অনেক লাভ নাকি বলেন?” “পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তখন তো আবার কাজকর্ম করে সংসার চলবে,” বলেন তিনি।
ভ্যানচালকের স্ত্রী তাজকেরা বেগমেরও একই কথা। তিনিও ভোটার আইডি কার্ডের ফটোকপি দিলেও কার্ড বা কোনো সহযোগিতা পাননি। তাজকেরা বলেন, “গরিব মানুষ, চালের কার্ডটা পেলে ২০০ টাকা দিয়ে এক মাস চলতে পারতাম। চাল কেনার চিন্তাটাই থাকত না।”
করোনাকালে দুর্গত মানুষদের ত্রাণ, সহযোগিতা থেকে শুরু করে বিশেষ ওএমএসের কার্ড নিয়ে কথা হয় চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌরসভার মেয়র মোহাম্মদ নজরুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি জানান, সরকারি অনুদান দুস্থ মানুষদের ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে নিরলস পরিশ্রম করেছেন বিভিন্ন ওয়ার্ডের কাউন্সিলররা। পৌর মেয়র বলেন, “করোনা ভাইরাসের কারণে যারা কর্মজীবী ছিল, তাদের অনেকেই কর্মহীন হয়ে পড়েছে। এই কর্মহীন মানুষের যে খাদ্য সংকট তা মোকাবেলা করার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ত্রাণ তৎপরতার অংশ হিসেবে আমাদের জেলাতে যা বরাদ্দ দিয়েছিলেন সেখান থেকে মাননীয় জেলা প্রশাসক চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌরসভায় কিছু বরাদ্দ দিয়েছেন। এরই মধ্যে আমরা ১৯২ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ পেয়েছি এবং তা ১৯ হাজার ২০০টি পরিবারের মধ্যে বিতরণও করা হয়েছে। আরো ৩০ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ পাওয়া গেছে, যা বিতরণ করা হবে। তিনি আরো বলেন, “আমরা নগদ অর্থ পেয়েছি প্রায় ১৬ লাখ ৮০ হাজার টাকা। যা দিয়ে খাদ্যসামগ্রী ক্রয় করে ৪ হাজার ২৫টি পরিবারের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে। শিশুখাদ্য হিসেবে যা বরাদ্দ পাওয়া গেছে, সেটি ১ হাজার ৬০২টি পরিবারের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে।”
নজরুল ইসলাম বলেন, প্রথম দিকে কর্মহীন মানুষের মাঝে ত্রাণের জন্য হাহাকার ছিল। সে জায়গা থেকে বরাদ্দ পাওয়া এসব খাদ্যসামগ্রী বা ত্রাণ সুষ্ঠুভাবে বণ্টনের চেষ্টা করেছি। আমাদের ১৫ জন ওয়ার্ড কাউন্সিলর এবং ৫ জন সংরক্ষিত আসনের মহিলা কাউন্সিলর দুখি ও দরিদ্র মানুষের কাছে এসব ত্রাণ বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দিয়েছেন। এর ফলে খাদ্যের জন্য মানুষের যে হাহাকার ছিল, সেটা কিছুটা হলেও কমেছে।”
মেয়র আরো বলেন, বর্তমান সরকার কর্মহীন মানুষদের কাছে সঠিকভাবে এই খাদ্যসামগ্রী পৌঁছে দিচ্ছেন, যাতে মানুষ খাদ্যাভাবে না থাকে। তিনি বলেন, পৌরসভায় ১৪ হাজার পরিবারকে বিশেষ ওএমএস কার্ড দেয়া হয়েছে, যারা ১০ টাকা কেজি দরে ২০ কেজি চাল কিনতে পারবে। যারা এই চাল কিনবে তারা ত্রাণের জন্য আর ছোটাছুটি করবে না বলে আমার কাছে মনে হয়।
জনপ্রতিনিধিরা ছাড়াও করোনাকালে দেশের এই দুর্যোগময় মুহূর্তে চাঁপাইনবাবগঞ্জবসীর সুরক্ষায় সরকারি নির্দেশনা বাস্তবায়নে রাত-দিন পরিশ্রম করে চলেছেন সরকারি কর্মকর্তারা। এছাড়া করোনা দুর্গতদের পাশে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তিগত উদ্যোগে অনেকেই এগিয়ে আসছেন।

ফাতিমা তুজ জোহরা : ফেলো, রেডিও মহানন্দা ৯৮.৮ এফএম, চাঁপাইনবাবগঞ্জ