Last Updated on ডিসেম্বর ২, ২০২৪ by
কম্পিউটার সাক্ষরতা দিবস ও প্রাসঙ্গিক ভাবনা
আবদুল্লাহ সাহেদ
প্রতিবছর ২ ডিসেম্বর পালিত হয় কম্পিউটার স্বাক্ষরতা দিবস। আধুনিক প্রযুক্তির যুগে কম্পিউটার আমাদের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে। এটি শুধুমাত্র একটি যন্ত্র নয়, বরং আমাদের যোগাযোগ, শিক্ষা, ব্যবসা, স্বাস্থ্য এবং অনেক কিছুই প্রযুক্তির সঙ্গে সম্পর্কিত। কম্পিউটার এখন পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে একটি অপরিহার্য উপাদান হিসেবে বিবেচিত। তবে, বিশ্বের সব জায়গায় একে সমানভাবে গ্রহণ করা হয়নি। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে, বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো দেশে, বহু মানুষ এখনো প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচিত নয় এবং তাদের কাছে কম্পিউটার ব্যবহারের সুযোগ অনেক সীমিত। এই বাস্তবতার প্রেক্ষিতে কম্পিউটার সাক্ষরতা দিবস পালন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
কম্পিউটার সাক্ষরতা দিবসের শুরু ১৯৮০ সালের দশকে, যখন বিশ্বজুড়ে প্রযুক্তির ব্যবহারে বিপ্লব ঘটতে শুরু করে। এটি পালন করার মূল উদ্দেশ্য ছিল, মানুষকে কম্পিউটার এবং প্রযুক্তির ব্যবহার সম্পর্কে সচেতন করা এবং তাদের জীবনে প্রযুক্তির গুরুত্ব বোঝানো। প্রযুক্তি আজ এমন এক জায়গায় পৌঁছেছে, যেখানে পৃথিবীর কোনো এক কোণে কম্পিউটার ছাড়া জীবনের অনেক কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। আমাদের দৈনন্দিন জীবনধারা, অফিসের কাজ, ব্যবসায়িক লেনদেন, শিক্ষাদান, এমনকি সামাজিক যোগাযোগের ক্ষেত্রেও কম্পিউটার এবং ইন্টারনেটের অবদান অপরিসীম।
বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে, প্রযুক্তি ব্যবহারের সূচনা স্কুল এবং কলেজ পর্যায়ে থেকেই শুরু হয়। সেখানে শিক্ষার্থীরা কম্পিউটার ব্যবহার শেখে, প্রযুক্তি ব্যবহার করে নিজেদের দক্ষতা বৃদ্ধি করে এবং ভবিষ্যতে প্রযুক্তিগত কাজের জন্য প্রস্তুত হয়। এর বিপরীতে, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে, যেখানে এখনো অনেক মানুষ প্রযুক্তির ব্যবহার জানে না, সেখানে এই দিবসের গুরুত্ব আরো বেশি।
দেশের অধিকাংশ অংশ এখনো প্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগ থেকে বঞ্চিত। দেশের শহরাঞ্চলে কিছুটা প্রযুক্তির সুবিধা থাকলেও, গ্রামীণ অঞ্চলের মানুষের কাছে এই সুযোগ এখনো কম। বিশেষত গ্রামাঞ্চলে যেখানে কম্পিউটার শিক্ষা কেন্দ্রের অভাব, ইন্টারনেটের অপ্রতুলতা এবং কম্পিউটার প্রশিক্ষিত শিক্ষকের অভাব রয়েছে, সেখানে অনেক মানুষ কম্পিউটার ব্যবহার থেকে পিছিয়ে রয়েছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে, কম্পিউটার সাক্ষরতা দিবস এই দুর্বলতাগুলো কাটিয়ে উঠতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
আজকের পৃথিবীতে কম্পিউটার ও তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর জীবনে প্রবেশ করতে হলে তরুণ সমাজের একটি শক্তিশালী ভূমিকা থাকতে হবে। বাংলাদেশে প্রযুক্তির ব্যবহারে বিশেষভাবে যুবসমাজ সবচেয়ে বেশি উৎসাহী। যুবসমাজ আজকাল ফ্রিল্যান্সিং, সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, গ্রাফিক ডিজাইন, ওয়েব ডিজাইন এবং ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের মতো কাজের সাথে যুক্ত হয়ে দেশ-বিদেশে প্রশংসিত হচ্ছে।
তবে, যুবসমাজের এই পরিবর্তনশীল ভূমিকা আরো বেশি প্রভাবশালী হতে পারে, যদি তারা কম্পিউটার শিক্ষার প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠে এবং তার দক্ষতা আরো উন্নত করে। এতে করে তারা কেবল নিজের জীবনে পরিবর্তন আনবে না, বরং দেশের অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারবে। বিশ্বের বৃহত্তম বাজারগুলোও বর্তমানে প্রযুক্তিনির্ভর। বাংলাদেশের তরুণরা যদি প্রযুক্তি শিক্ষায় আরো দক্ষ হয়, তবে তারা আন্তর্জাতিকমানের কর্মসংস্থান খুঁজে পেতে সক্ষম হবে।
শিশু-কিশোরদের জন্য কম্পিউটার শিক্ষা দেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান সময়ে, ছোট্ট বয়সে কম্পিউটার ব্যবহারের দক্ষতা অর্জন না করলে, তারা ভবিষ্যতে প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারবে না। আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা, চাকরি বাজার, এবং ব্যক্তিগত জীবনÑ সব ক্ষেত্রেই কম্পিউটার ব্যবহার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠেছে।
কম্পিউটার শিক্ষা শিশুদের মধ্যে সৃজনশীলতা, বিশ্লেষণাত্মক চিন্তা এবং সমস্যা সমাধানের দক্ষতা গড়ে তুলতে সাহায্য করে। এটি শুধু একাডেমিক ক্ষেত্রে নয়, বরং তাদের সামাজিক দক্ষতা এবং আত্মবিশ্বাস গড়ে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ। তাই, শিশুরা যদি এখন থেকেই কম্পিউটার এবং প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষ হয়, তারা ভবিষ্যতে আরো উন্নত এবং সফল জীবনযাপন করতে সক্ষম হবে।
আজকের কর্মসংস্থান বাজারে প্রযুক্তির ভূমিকা অপরিসীম। বিশ্বব্যাপী আজকের অধিকাংশ চাকরি কম্পিউটারনির্ভর। বাংলাদেশে ফ্রিল্যান্সিং, গ্রাফিক ডিজাইন, ওয়েব ডেভেলপমেন্ট, এবং আইটি সেক্টরের কাজের সুযোগ বেড়ে যাওয়ার সাথে সাথে, কম্পিউটার জ্ঞান যে কোনো কর্মসংস্থানে সফলতার চাবিকাঠি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বব্যাপী প্রতিযোগিতা যতই বাড়ছে, ততই কম্পিউটার জ্ঞানের গুরুত্ব বাড়ছে। বাংলাদেশের তরুণরা আন্তর্জাতিক বাজারে কাজ করছে, বিভিন্ন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে কাজ করে নিজেদের জন্য ভালো কাজের সুযোগ তৈরি করছে। বাংলাদেশে, বিশেষ করে শহরাঞ্চলে, কম্পিউটার শিক্ষা অধিক গুরুত্ব পাচ্ছে এবং এতে অনেক তরুণ সফলভাবে নিজেদের ক্যারিয়ার তৈরি করতে পারছে।
ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষে, কম্পিউটার শিক্ষা একটি প্রধান অবলম্বন হিসেবে কাজ করছে। দেশে যদি প্রাথমিক স্তর থেকে কম্পিউটার শিক্ষা শুরু হয়, তাহলে শিক্ষার্থীরা খুব সহজেই প্রযুক্তির ব্যবহার শিখতে পারবে এবং ভবিষ্যতের প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন করতে পারবে।
বিশ্বের অনেক দেশ, যারা আজ প্রযুক্তিতে সফল, তারা ছোটবেলা থেকেই প্রযুক্তিগত শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দিয়েছে। বাংলাদেশেও এই উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে কিন্তু সেটা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। পর্যাপ্ত কম্পিউটার ল্যাব, দক্ষ শিক্ষক, ইন্টারনেট সুবিধা না থাকা ইত্যাদি কারণে আলোর মুখ দেখছে না।
কম্পিউটার শিক্ষার প্রয়োজন শুধু তরুণদের জন্য নয়, বরং সব বয়সী মানুষের জন্যও। যারা বর্তমানে বিভিন্ন পেশায় নিযুক্ত, তাদের জন্যও কম্পিউটার জ্ঞান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চাকরির ক্ষেত্রে এখন প্রাথমিক থেকে উচ্চস্তরের সকল পদে কম্পিউটার ও প্রযুক্তির ব্যবহারের দক্ষতা অত্যন্ত জরুরি। এছাড়া, মধ্যবয়সী বা বৃদ্ধ মানুষও কম্পিউটার শিক্ষা গ্রহণ করতে পারেন, যেমনÑ ব্যাংকিং, সরকারি সেবা, এবং সামাজিক যোগাযোগের জন্য প্রযুক্তি ব্যবহার করতে। এটি তাদের সামাজিক জীবনকে আরো সহজ এবং প্রাণবন্ত করে তুলতে সাহায্য করবে।
কম্পিউটার শিক্ষা সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছানোর জন্য সরকারের উচিত প্রযুক্তিগত অবকাঠামো উন্নত করা। স্কুল, কলেজ এবং অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে কম্পিউটার ল্যাব স্থাপন এবং ইন্টারনেট সংযোগের সুবিধা নিশ্চিত করা জরুরি। এছাড়া, গ্রামীণ অঞ্চলে বিশেষভাবে কম্পিউটার শিক্ষা বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র চালু করা এবং প্রয়োজনীয় শিক্ষক নিয়োগ করাও সরকারের দায়িত্ব হতে পারে।
কম্পিউটার সাক্ষরতা দিবস একটি সচেতনতা বৃদ্ধি কর্মসূচি। এটি শুধু একটি বিশেষ দিন নয়, বরং এটি একটি আন্দোলন, যা মানুষের মধ্যে প্রযুক্তির ব্যবহারের গুরুত্ব এবং এর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে সচেতনতা তৈরি করে। এই দিবসের মাধ্যমে জনগণকে কম্পিউটার এবং ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার শেখানো এবং এগুলোর সুবিধা সম্পর্কে জানানো হয়। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে, যেখানে প্রযুক্তিগত শিক্ষার অভাব রয়েছে, সেখানে এই দিবসটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
দেশের উন্নতি এবং ভবিষ্যতের উন্নত বাংলাদেশ নির্মাণের জন্য কম্পিউটার শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব দেওয়া অত্যন্ত জরুরি। যদি আমরা কম্পিউটার শিক্ষার দিকে মনোযোগী হই, তবে তা আমাদের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হয়ে উঠবে। কম্পিউটার সাক্ষরতা দিবস আমাদের সেই পথে এক ধাপ এগিয়ে নিতে সহায়তা করবে।
আবদুল্লাহ সাহেদ : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট