ওপারের মেঘলা মালিহার জন্যে ভালবাসা

30

– শহীদুল হুদা অলক-

২০১৭ সালে ১২ ফেব্রুয়ারি। রাত তখন হবে পৌনে বারটা। চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌরসভার নামো শংকরবাটী এলাকার পরিচিত একজন সেলফোনে বলল, ‘ভাই দুপুর থেকে আমাদের ভবানিপুরের ফতেপুরের দু’শিশু নিখোঁজ। খুব ফুটফুটে ছিল মেয়ে দু’টি। ভাই শিশু পাচারকারী সন্দেহে কিন্তু এক মহিলাকে পুলিশে দেয়া হয়েছে…’।
দু’টি শিশু একসঙ্গে নিখোঁজ! খোঁজ নিলাম সদরের ওসি সাহেবের কাছে, তিনিও এমন খবর নিশ্চিত করলেন। মনটা খারাপ হয়ে গেল। ঘরের টেবিল থেকে উঠে গিয়ে উঁকি মারলাম আমার মেয়েদের ঘরে। তারা ঘুমিয়ে আছে। আমি ঘরে উঁকি মেরে না হয় নিশ্চিত হলাম। কিন্তু ওই শিশু দু’টির বাবা মায়ের কি অবস্থা। তারা কতই না হাহাকার নিয়ে এদিক সেদিক খুঁজে ফিরছেন তাদের প্রিয় সন্তানদের। আর মা উঁকি মারছেন বাড়ির দরজায়, এই বুঝি বুকের ধন ফিরে আসলো…
গভীর রাত পর্যন্ত ঘটনাটির খোঁজ নিতে থাকলাম। জানলাম, সন্দেহভাজন ওই মহিলা বিভ্রান্তিকর তথ্য দিচ্ছেন। ওই মহিলার কথানুযায়ী সদর থানার তৎকালীন ওসি মাজহারুল ইসলাম, ওসি তদন্ত চৌধুরী যোবায়ের আহমেদ রাতভর অভিযান চালান সোনামসজিদ বন্দর ও বরেন্দ্র এলাকার আনাচে কানাচে। শিশু দু’টি উদ্ধারে পুলিশের নিরন্তর চেষ্টা… এরই মাঝে স্থানীয় একটি চক্র বারবার আঙ্গুল তুলছেন সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের গীতা রানী নামের ওই মহিলার দিকে। তার বাড়িতে আগুনও দেয়া হয়েছে। পুরো বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় সাধারণ মানুষ চরম ধুম্রজালের মাঝে। এমন পরিস্থিতিতে স্থানীয় যুবকরা দুপুরের পর থেকে বাড়ি বাড়ি তল্লাশী চালানোর উদ্যোগ নেয়। সন্ধ্যার আগে প্রতিবেশি লাকি খাতুনের বাড়িতে গেলে লাকির আচরণে যুবকদের সন্দেহ হয়। তারা ঢুকে পড়ে লাকির বাড়িতে এবং সেখানেই সন্ধান পায় দু’ শিশুর। তবে, জীবিত নয় বস্তাবন্দি নিথর দু’টি দেহের। দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে শিশু দু’টির মর্মান্তিক হত্যাকা-ের খবর। পেশাগত (সাংবাদিকতা) দায়িত্ব পালন করতে খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ছুটে গেছিলাম ফতেপুরে। তখন সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত ছুঁয়েছে। চারিদিকে আহাজারি। পুরো এলাকার আকাশ বাতাস ভারি হয়ে আছে। বসন্তের পরিষ্কার আকাশে টকটকে চাঁদটাও যেন বেদনায় মুখ ভার করে রয়েছে। মর্মান্তিক এই ঘটনায় ফতেপুরের নারী-পুরুষ ঘর-বাড়ি ছেড়ে রাস্তায় নেমে এসেছেন। সরু গলির পথ ধরে ঘটনাস্থলের দিকে এগুতে কানে বাজছিল শুধুই আহাজারি আর ঘৃনার স্বর।
লাকির বাড়ির মোড়ের কাছে দেখা গেল চরম এই বর্বরতায় প্রতিবাদী শ’ খানেক যুবকের চরম বিক্ষুব্ধতা। জীবনে মানুষের ক্ষুব্ধতা, বিক্ষোভ দেখেছি কয়েকবার। কিন্তু এমন বিক্ষোভ এখনও চোখের সামনে ভাসছে, অকল্পনীয়। এমনটাইতো হবে কেন না এই ক্ষুব্ধতার উৎস যে মানবতা। চাঁপাইনবাবগঞ্জ পুলিশের প্রধান টিএম মোজাহিদুল ইসলাম পুলিশের প্রায় সব কর্মকর্তাকে নিয়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত। পুলিশ শিশু দু’টির লাশ উদ্ধার করেছে। সেই সঙ্গে আটক করেছে লাকি ও তার শ্বশুর, শাশুড়িকে। কিন্তু মানুষের বিক্ষুব্ধতায় পুলিশ আইনি কার্যক্রম করতে পারছেন না। উত্তাল এক বিক্ষোভ। আমার সহযোগী ভাগ্নে আসাদ ফুটেজ ধারণ করছে আর আমি মানুষের ক্ষুব্ধতা দেখে হতবিহ্বল। ক্ষুব্ধ মানুষ লাকি খাতুনকে এলাকা থেকে নিয়ে যেতে দিবেন না। তাদের দাবি, বর্বরতার বিচার হবে এখানেই প্রকাশ্যে। পুলিশ সুপার ঠা-া মাথায় বিচক্ষণতার সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবেলা করছেন। ক্ষুব্ধদের শান্ত করতে বারবার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আশ্বাস দিচ্ছেন। কিন্তু যুবকদের নিবৃত করা যাচ্ছে না। এরই মাঝে আসাদ কাছে এসে বলল, ‘মামা লাশের ফুটেজসহ ভাল ফুটেজ পেয়ে গেছি’। তখন যুবকদের বিক্ষুব্ধতা চরমে। ৩০/৩৫ জন যুবক রাস্তায় শুয়ে পড়েছেন। লাকিকে নিয়ে পুলিশের গাড়ি তারা যেতে দিবেন না। র‌্যাব সদস্যরাও ঘটনাস্থলে। এক অবর্ণনীয় অবস্থা। পেশাগত দায়িত্বের বাইরে সামাজিক দায়িত্বে যোগ দিলাম। পরিচিত স্থানীয় ৪/৫ জন যুবককে সঙ্গে নিলাম। ক্ষুব্দদের শান্ত করতে বক্তব্য রাখলাম। এমনই মুহুর্তে হুড়োহুড়ি। হুড়োহুড়ির মাঝে রাস্তা ‘ক্লিয়ার’ করতে গিয়ে পাশের ড্রেনে পড়লাম আর চোখের সামনে দেখলাম, পুলিশ তিনজনকে দ্রুত পিকআপ ভ্যানে তুলে নিয়ে চলে গেল।
আবার পেশাগত দায়িত্বের কারণে হাটুঅব্দি ড্রেনের নোংরা কাদা নিয়ে থানায় এসে ঘটনার বক্তব্য নিতে গিয়ে দেখলাম, পুলিশ কর্মকর্তারা ঘটনার বর্ণনা দিলেন আর চোখের কোণে জমা পানি মুছলেন…
পরের দিন ঘটনার বিস্তারিত জানতে গিয়ে যা জানাগেল তা লোমহর্ষক। মেঘলা আার মালিহা ছিল লাকির মেয়ে ইলার বান্ধবি। অন্যান্য দিনের মত ছোটমনি বিদ্যা নিকেতন স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে খেলতে বের হয়েছিল। ইলার সঙ্গে ইলাদের গলিতেই মনের সুখে খেলছিল মেঘলা আর মালিহা। কিন্তু কে জানতো ঘাতক সেখানেই লুকিয়ে আছে। এমন সময় ঋণগ্রস্থ লাকির নজর পড়ে তাদের গায়ে থাকা স্বর্ণালংকারের উপর। স্বর্ণালংকারই কাল হয় তাদের। স্বর্ণালংকার হাতিয়ে নিতে লাকি কৌশলে তাদেরকে বাড়িতে নিয়ে যায়। স্বর্ণালংকার খুলে নিয়ে তাদের দু’জনকে ফ্রিজের পেছনে আটকে রাখে। নিখোঁজ মেঘলা মালিহা; বেলা গড়িয়ে দুপুর, দুপুর গড়িয়ে বিকেল, বিকেল গড়িয়ে রাত। স্বজনরা হন্য হয়ে খুঁজে ফিরছেন এখানে সেখানে আর ফ্রিজের আড়ালে বন্দি যন্ত্রণায় ছটপট করছে মেঘলা আর মালিহা। এরপরের ঘটনাগুলো লিখতে হাত কাঁপছে। সেই লোমহর্ষক ও বর্বরতার বর্ণনা না হয় থাক।
সুদে নেয়া টাকার দেনা মেটাতে ঘাতক লাকি স্বর্ণালংকারগুলো ২১ হাজার টাকায় বিক্রি করেছিল ওই এলাকার স্বর্ণকার মিজানুর রহমান পলাশের কাছে।
মর্মান্তিক এই ঘটনায় পরের দিন থেকে মানুষ আরো সোচ্চার হয়ে উঠেন। ফাঁসির দাবির শ্লোগানে যুক্ত হন এলাকার নারী পুরুষ শিশু কিশোর বৃদ্ধ সবাই। একজন কর্মী হিসেবে আমিও যুক্ত হই মেঘলা মালিহার খুনি লাকির ফাঁসির দাবিতে। সেদিন ছিল ২০ ফেব্রুয়ারি। লাকির ফাঁসির দাবিতে বিক্ষোভের দিন। সেদিন আবার দেখেছিলাম বিক্ষোভের জোয়ার। বাঁধ ভাঙ্গা জোয়ারের মতো নারীরা ঘর ছেড়ে রাস্তায় নেমে আসছেন। রাজারামপুর থেকে মিছিলের মুখ বটতলা হাটে। তখনও বিক্ষোভের মিছিলে যুক্ত হচ্ছেন ক্ষুব্ধরা। ঠিক যেন হ্যামিলিয়নের বাঁশিওয়ালার গল্পের মতো। বাঁশিওয়ালার বাঁশির সুরের টানে যেমন শিশুরা ঘর ছেড়ে রাস্তায় নেমেছিল তেমনই মেঘলা মলিহার মায়ার টানে ঘর ছেড়েছিল নারী পুরুষ শিশুরা। মিছিলের স্রোত গিয়ে মিলেছিল কোর্ট এালাকায়। হাজারো মানুষ কোর্ট এলাকার বিক্ষোভ সমাবেশে। গগণবিদারী একটাই শ্লোগান, ‘লাকির ফাঁসি চাই’।
স্মারকলিপি দেয়া হয়েছিল সেদিন জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারকে। সেদিন পুলিশ সুপার টিএম মোজাহিদুল ইসলাম আমাদেরকে পুলিশের উপর আস্থা রাখতে বলেছিলেন। পরে ২৩ ফেব্রুয়ারি রাজারামপুর হামিদল্লাহ উচ্চ বিদ্যালয় মাঠের এক সমাবেশে তিনি কথা দিয়েছিলেন এইভাবে, ‘যতদিন চাঁপাইনবাবগঞ্জে থাকবো ততদিন এই হত্যাকারিকে আইনের আওতায় সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে কাজ করবো’।
হ্যাঁ, আমরা তেমনটায় দেখেছি। দু’শিশু নিখোঁজের জিডিটি ১৪ ফেব্রুয়ারি লাশ উদ্ধারের পর হত্যা মামলায় রূপান্তরের মাত্র ২ মাসের মাথায় মামলার তদন্ত কর্মকর্তা চৌধুরী যোবায়ের আহমেদ আদালতে অভিযোগপত্র (চার্জসীট) দাখিল করেন। আর বিজ্ঞ আদালত ১৬ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ শেষে ৫ আগস্ট, ২০১৮ তারিখ সেই রায়ই দিয়েছেন যেটা কোর্ট এলাকায় হাজারো কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছিল… “লাকির ফাঁসি চাই”
ধন্যবাদ পুলিশ, ধন্যবাদ বিজ্ঞ বিচারক, কৃতজ্ঞতা প্রতিবাদী হাজারো নারী-পুরষ। এযেন ওপরের মেঘলা মালিহার প্রতি তোমাদের ভালবাসা।
পুনশ্চ: সবুজ শ্যামল এই বাংলার মুক্ত আলো বাতাস তোরা প্রাণভরে ভোগ করতে পারিসনি। তবে, প্রাণশেষে পেয়েছিস অগণিত মানুষের ভালবাসা। ওপারে ভালো থাকিসরে মা তোরা…
লেখকঃ গণমাধ্যম কর্মী ও সংগঠক