Last Updated on ফেব্রুয়ারি ১, ২০২৫ by
এ জনপদে আদিবাসীর অতীত-বর্তমান
মোস্তাক হোসেন
বরেন্দ্র অঞ্চল হচ্ছে আদিবাসীদের বসবাসের অঞ্চল। বরেন্দ্র জনপদে সাঁওতাল জনগোষ্ঠী বসবাস করে আসছে বহুকাল ধরে। আদিবাসীদের শারীরিক বৈশিষ্ট্যগত দিক থেকে তারা খুবই পরিশ্রমী। তারা যে অঞ্চলে বসবাস করে সে জায়গায় প্রাকৃতিকভাবে সমতলের অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে ভিন্ন। পানি সংকট মোকাবিলা আর জংলা জমিকে ‘কৃষি জমিতে’ রূপান্তর করতে করতে তারা হয়ে উঠেছে পরিশ্রমী।
তাদের পূর্বপুরুষদের বসবাসের অঞ্চল ভারতের সাঁওতাল পরগনার ইতিহাস লক্ষ্য করলে তাদের পরিশ্রমিতার দৃষ্টান্ত প্রতীয়মান হওয়া যায়। ব্রিটিশ শাসনামলে চাষাবাদ করার শর্তে রাজমহলের পাহাড়ি জঙ্গল পরিষ্কার করে স্থায়ী বসবাস শুরু করতে থাকে। তাদের মুখরিত জীবন-যাপন রাজমহলের পাহাড়ি জংলা অঞ্চল পরিণত হয় সাঁওতাল পরগনায়।
আদিবাসীদের বৈচিত্র্যময় জীবন-যাপনে শুধু পরিশ্রমী মনোভাব পরিলক্ষিত হয় না, বরং সংগ্রামী জীবনও বটে। সংগ্রামী জীবনের ইতিহাস সুদীর্ঘ ও বহমান। প্রকৃতির রুষ্টতা, সামাজিক বৈষম্য, অঞ্চলগত প্রতিপত্তি-আধিপত্যতার বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করতে হয়। আদিবাসীদের অতীত সংগ্রামী ইতিহাস খুবই বেদনাদায়ক। যা বিবেককে নাড়া দিয়ে থাকে। ব্রিটিশ শাসনামলে যে অঞ্চল পরিশ্রমী জীবনের ফল হিসেবে পেলেও তা আবার কেড়ে নিল পরিশ্রমী জীবনাবসানের মধ্য দিয়ে।
ব্রিটিশ সরকার ভূমিকর ধার্য করলে জমিদার ও সুদখোর মহাজনের অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে পড়ে। শোষকদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ১৮৫৫ সালে সিধু-কানুর নেতৃতে ভাগলপুরের সাঁওতাল পরগনায় ইংরেজ প্রশাসন, জমিদার ও মহাজনদের দুঃশাসন প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে গড়ে তুলে এক বিদ্রোহ। যা সাঁওতাল বিদ্রোহ বা সান্তাল হুল নামে পরিচিত। এই বিদ্রোহের মাধ্যমে তারা বোঝাতে চেয়েছিল যে, ইংরেজ প্রশাসনের দোসর এদেশের জমিদার ও মহাজনরা তাদের অধিকার হরণ, তাদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ ও দুঃশাসনের বেড়াজালে শোষণ করে নিঃস্ব করছে।
যখন সাঁওতাল গোষ্ঠী বুঝতে পারল যে, তারা শোষণ ও নির্যাতিত হচ্ছে। এ থেকে উদ্ধারকল্পে ভাগলপুর ও বীরভূম জেলার অন্তর্গত দামিন-ই-কো স্থানে তারা সমবেত হয়ে তাদের কর্মপরিকল্পনা ঠিক করে। সেখানে তাদের নির্যাতনমূলক আচরণের বর্ণনা দিয়ে সাঁওতাল গোষ্ঠীর অন্যদের উদ্বুদ্ধ ও একত্রিত করা হয়। কারণ তাদের রাজমহলের দামিন-ই-কো অঞ্চলটির বন-জঙ্গল কেটে আবাদি জমি তৈরি করে এবং সেখানে তারা সাঁওতাল পরগনা গঠনের মাধ্যমে বসবাস করতে থাকে। কিন্তু তাদের কষ্টার্জিত আবাদি জমি, বসতবাড়ি ও সম্পদ সুরক্ষিত হলো না। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কারণে জমিদার ও সুদখোর মহাজনদের কুনজর পড়ে দামিন-ই-কোর ওপর। ফলে সাঁওতাল পরগনার আদিবাসীদের জীবনে নেমে আসে কালো ছায়া। তারা এ অবস্থা থেকে উত্তরণের পথ খুঁজতে থাকে।
প্রথমত তারা অহিংস পথে ইংরেজ প্রশাসনকে বোঝাতে থাকে এবং নির্যাতন সহ্য করে যে, সুদিন আসবে। কিন্তু তাদের সহ্যের সীমা পেরিয়ে যায় যখন ফুলমনির ধর্ষিত লাশ ও বীরসিংকে অপমানিত অবস্থায় দেখতে পায়। এ অবস্থায় সিধু, কানু, চাঁদ, ভৈরবসহ নিঃশেষিত আদিবাসী সুদখোর মহাজনের নির্যাতন হতে বাঁচার উদ্দেশ্যে ১৮৫৫ সালের ৩০ জুন ভাগলপুরের ভগনাডিহিতে সমাবেশের ডাক দেয়। সেই সমাবেশের সিদ্ধান্ত মোতাবেক ইংরেজ কর্মকর্তা, জেলা প্রশাসন, থানার কর্মকর্তা, জমিদার ও মহাজনের কাছে চিঠি পাঠানো হয় যেÑ তারা ইংরেজ প্রশাসনের বিরুদ্ধে না, শুধু তারা জমিদার ও মহাজনের কাছে নির্যাতিত তা জানানো এবং এর একটি সুরাহা করা।
সাঁওতালদের মূল দাবি ‘জমি চাই, মুক্তি চাই’। জমিদার ও মহাজনের জুলুম, অত্যাচার হতে মুক্ত হয়ে শান্তিতে জীবন-যাপন করার জন্য তাদের সমবেত হওয়া। অথচ তাদের বিদ্রোহের পথ বেছে নেয়ার কারণই হলো ইংরেজ প্রশাসনের অবহেলা। এই বিদ্রোহে প্রাণ হারাতে হয়েছে নিরীহ প্রায় ১০ হাজার সাঁওতাল জনগোষ্ঠীকে (সাঁওতাল বিদ্রোহ সংখ্যা, তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ, পশ্চিমবঙ্গ ভারত)। যুগে যুগে সাঁওতাল আদিবাসীদের শাসকগোষ্ঠীর কাছ থেকে অত্যাচারিত ও নির্যাতিত হতে হয়েছে।
এ জনপদের বর্গাচাষি সাঁওতালের অধিকার রক্ষায় ১৯৪৬-৪৭ সালে সংগ্রামী নেত্রী ইলা মিত্র তেভাগা আন্দোলন করেছেন। সেই আন্দোলনে অনেক আদিবাসী নির্যাতিত হয়েছে। তেভাগা আন্দোলনের মহান নেত্রী ইলা মিত্রকে সহ্য করতে হয়েছে অবর্ণনীয় নির্যাতন। আন্দোলনোত্তর চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোলের আদিবাসীসহ সকল বর্গাচাষি তেভাগা অধিকার পেয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে নাচোলেই আদিবাসীদের অস্তিত্ত্বের সংকট বিদ্যমান। তেভাগা আন্দোলনের ঘাঁটি কেন্দুয়া, ঘাসুড়া, রাওতাড়া, চণ্ডীপুর সাঁওতাল অধ্যুষিত গ্রামগুলোতে এখন তাদের দেখা পাওয়ায় ভার।
জানা যায়, চাঁপাইনবাবগঞ্জে আদিবাসী সাঁওতালদের মধ্যে ১২টি গোত্র রয়েছে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যÑ মার্ডি, কিসকু, টুডু, সরেন, হেমরম, মুর্ম, ইত্যাদি। এছাড়াও এ অঞ্চলে আদিবাসী কোল সম্প্রদায় রয়েছে। সবমিলিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জের এদের সংখ্যা প্রায় ৫৫ হাজার। তবে সংখ্যাগরিষ্ঠের বাস নাচোল উপজেলায়।
ভূমিদস্যুদের প্রভাবে দিনাজপুরের আদিবাসী ফাগু সরেনের পুত্র টুডু সরেন খুন হবার পরেও তার পরিবার ফেরত পায়নি ৩৩ একর জমি। গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের সাহেবগঞ্জ বাগদা ফার্মে আদিবাসী সাঁওতালদের পৈত্রিক সম্পত্তি আজও ফেরত পায়নি। এভাবে ভূমিদস্যুদের কারণে আদিবাসীরা হারাচ্ছে তাদের ভূমি অধিকার।
আবার ভূমিহীন সাঁওতালদের দুর্ভোগের শেষ নেই। ভূমিহীন আদিবাসীরা খাসজমি বরাদ্দের আবেদন করে। সেই আবেদনের প্রেক্ষিতে তাদেরকে জমি বন্দোবস্ত দেয়া হয়। কিন্তু স্থানীয় প্রভাবশীলদের কারণে তারা বন্দোবস্তকৃত ভূমি বুঝে পায় না। প্রভাবশালীদের প্রতিপত্তির কাছে দরিদ্র ভূমিহীন সাঁওতালদের প্রশাসনই একমাত্র ভরসা।
১৮৫৫ সালের ৩০ জুনের যৌক্তিক দাবি ‘ভূমি চাই, মুক্তি চাই’ বর্তমান প্রেক্ষাপটেও তাদের একই সমস্যা ভূমি। তাদের ভূমি বিভিন্ন অঞ্চলে প্রভাবশালীদের দখলে থাকায় নিজের ভূমিতেই তারা ভূমিহীন অর্থাৎ নিজভূমেই পরবাসী। ১৯৫০ সালের জমিদারী উচ্ছেদ ও প্রজাস্বত্ব আইনের ৯৭(৮) ধারার বিধান মতে, হস্তান্তরকৃত বন্দোবস্ত জমি বিভিন্ন সময় কাগজপত্রে সমস্যা থাকায় সাঁওতালরা জমি দখল পায় না। এই সমস্যা দূরীকরণে পৃথক ভূমি কমিশন গঠন করা হলে তারা জমি-সংক্রান্ত জটিলতা হতে মুক্তি পাবে এবং বন্দোবস্তকৃত জমি পেতে সহায়ক হবে।
সমতলের আদিবাসীদের প্রধান সমস্যা ভূমি অধিকার। আর এ ভূমি অধিকার রক্ষায় সমতলের আদিবাসীদের পৃথক ভূমি কমিশন গঠন করা হোক এটা তাদের সময়ের দাবি।
মোস্তাক হোসেন : কলাম লেখক ও সংগঠক