এগিয়ে চলছে রাবারড্যাম নির্মাণকাজ বছরজুড়ে পাওয়া যাবে স্বাদু মাছ

21

আখতার জাহান : নদীমাতৃক দেশ বাংলাদেশ। এই দেশের ছোট একটি জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জ। তবে জেলা হিসেবে ছোট হলেও এই জেলার ওপর দিয়ে চারটি নদী প্রবাহিত। নদীগুলো হচ্ছেÑ পদ্মা, মহানন্দা, পাগলা ও পুনর্ভবা। এর চারটি নদীই নাব্য হারিয়ে মৃতপ্রায় অবস্থা। পদ্মার পশ্চিম পাড়ের মানুষ প্রতিবছরই বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হন। কিন্তু বর্ষকালে পদ্মা ফুঁসে উঠলেও এবং বাকি নদীগুলোয় পানি বৃদ্ধি পেলেও পদ্মার পূর্ব পাড়ে আগের মতো দুকূল ছাপিয়ে আর বন্যা হয় না। এক কথায় শুষ্ক মৌসুমে পানি প্রবাহ থাকে না।
নদী চারটির মধ্যে মহাননন্দা নদী একসময় ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দু ছিল। নৌপথে চলত সকল প্রকার ব্যবসা-বণিজ্য। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে একটু একটু করে নাব্য হারিয়ে নদীটি শুষ্ক মৌসুমে পানিশূন্য হয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় বতর্মান সরকার নদী খনন ও রাবারড্যাম নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়।
বর্ষাকাল পরবর্তী পানি সংরক্ষণ করে কৃষিজমিতে ব্যবহারের জন্য মহানন্দা নদীতে নির্মাণ হচ্ছে রাবার ড্যাম। চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সেতুর ৫০০ মিটার পশ্চিমে রাবারড্যাম নির্মাণের কাজ চলছে দ্রুতগতিতে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১১ সালে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সফরে এসে জেলাবাসীর দাবির প্রেক্ষিতে রাবারড্যাম স্থাপনের প্রতিশ্রুতি দেন।
প্রায় ১৫৫ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হচ্ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের চাঁপাইনবাবগঞ্জ পওর বিভাগের আওতায় প্রকল্পটির কাজ এগিয়ে চলেছে। গত ৬ মার্চ পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক এমপি এর নির্মাণকাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করে গেছেন। গতবছরের ১ নভেম্বর থেকে রাবারড্যাম নির্মাণকাজ শুরু হয়েছে। ২০২৩ সালের মে মাসের মধ্যে এর নির্মাণ কাজ শেষ করার লক্ষ্য রয়েছে।
ঐতিহ্যবাহী বহু পুরাতন এই নদীতে শুষ্ক মৌসুমে পানি না থাকায় নদীর সেচ কাজসহ অন্যান্য কাজ করতে পারেন না এলাকাবাসী। পাওয়া যায় না সুস্বাদু মাছ। রাবারড্যাম হলে শুষ্ক মৌসুমে মহানন্দায় পানি ধরে রেখে বিস্তীর্ণ বরেন্দ্র অঞ্চলে অধিকতর সেচ সুবিধা নিশ্চিত করা যাবে। আর এতে এ অঞ্চলে ফসল উৎপাদন দ্বিগুণ হবে। এছাড়া মহানন্দা নদী খননের ফলে নদীর গভীরতার পাশাপাশি মৃতপ্রায় নদীটি ফিরে পাবে নাব্য। এতে মৎস্য প্রজনন ও আহরণের আরো সুযোগ সৃষ্টি হবে। বদলে যাবে এই এলাকার মানুষের অর্থনৈতিক দৃশ্যপট। ফলে চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষি অর্থনৈতিতে সমৃদ্ধির গতি ত্বরান্বিত হবে। এমনটাই বলছিলেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের পওর’র উপবিভাগীয় প্রকৌশলী ময়েজ উদ্দীন। তিনি বলেন, রাবারড্যাম প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে চাঁপাইনবাবগঞ্জের মহানন্দা নদী থেকে ভারত সীমান্ত নদী পর্যন্ত পানি সংরক্ষণ করা যাবে। যার ফলে বর্ষা মৌসুম ছাড়াও শুষ্ক মৌসুমেও মহানন্দা নদীতে প্রায় ১২-১৪ ফুট পানি থাকবে, আর এই পানি ব্যবহার করে কৃষিকাজ করা যাবে। এতে কৃষি খাতে ব্যাপক উন্নয়ন হবে। বর্তমানে শুষ্ক মৌসুমে নদীতে পানি না থাকায় মাছ চাষ ব্যাহত হয় এবং সেচ ব্যবস্থার অসুবিধা হয় কিন্তু রাবারড্যাম নির্মিত হলে ১২ মাসই ব্যবহার করা যাবে নদীর পানি। তিনি বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২০১১ সালে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সফরে এসে কৃষকদের চাহিদা মোতাবেক মহানন্দা নদী খনন ও রাবারড্যাম নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দেন। প্রকল্পটির কাজ ২০১৭ সালে শুরু হওয়ার কথা থাকলেও ঠিকাদার না পাওয়ায় প্রকল্পের নির্মাণ কাজ শুরু হয় ২০২১ সালের ১ নভেম্বর থেকে, বলেন তিনি।
এদিকে রাবারড্যাম নির্মাণকাজ শুরু হওয়ায় খুশি স্থানীয়রা। তারা জানান, শুষ্ক মৌসুমে বেশি কষ্ট হয় মাছ চাষের। রাবারড্যাম হলে শুষ্ক মৌসুমে নদীর পানি দিয়ে সেচ সুবিধাসহ মাছ চাষে ভূমিকা রাখবে বলে জানান চাষিরা।
স্থানীয় সেলিম রেজা ও আব্দুস সালাম বলেন, শুষ্ক মৌসুমে নদীতে পানি না থাকায় জমিতে সেচ দিতে প্রচুর টাকা খরচ হয়, যেটা সবসময় সম্ভব হয়ে উঠে না। ফলে অনেক আবাদি জমি পতিত পড়ে থাকে। কিন্তু রাবারড্যাম নির্মাণ হলে ১২ মাসই নদীর পানি দিয়ে স্বল্প খরচে সেচ দিতে পারবেন তারা। তারা বলেন, অনেক সময় নদীতে পানি না থাকায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যায়; যার ফলে গভীর নলকূপেও পানি পাওয়া যায় না। রাবারড্যাম নির্মাণকাজ শেষ হলে সহজে পানি পাওয়া যাবে। এতে করে এলাকাবাসী ও কৃষকদের অনেক সুবিধা হবে।
তবে র‌্যাবারড্যাম নিয়ে কারো কারো মনোভাব নেতিবাচক। তাদের মতে, এই রাবারড্যাম বাস্তবায়ন হলে নদীর স্বাভাবিক গতিপ্রবাহ ব্যাহত হতে পারে এবং এটি জীববৈচিত্র্যের পাশাপাশি পশ্চিমের কৃষিজমি কমে যাওয়ার আশঙ্কাা রয়েছে। ইব্রাহিম এবং সোলেমান জানান, রাবারড্যাম স্থাপনের ফলে পাশে যে বিলগুলো আছে, সেখানকার হাজার হাজার একর জমির ধানচাষ নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এতে কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
এ নেতিবাচক মনোভাব ঠিক নয় বলে মনে করেন উপবিভাগীয় প্রকৌশলী ময়েজ উদ্দীন। তিনি জানান, পানির পর্যাপ্ত প্রবাহ থাকলে কৃষিজমির উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। এখানে আইডব্লিউএম জরিপে দেখা গেছে, নির্দিষ্ট আকারে প্রায় সাড়ে ১৪ মিটার উচ্চতায় পানি থাকবে, যেটি নদীর মধ্যেই অবস্থান করবে এবং সঠিক সময়েই বিলের পানি নদীতে চলে আসবে। তাই বিলের জমি কমে যাবার কোনো আশঙ্কা নেই। তিনি বলেন, রাবারড্যাম নির্মিত হলে একদিকে নদীর গতিপথ ও সৌন্দর্য বৃদ্ধি পাবে অন্যদিকে মাছসহ বিভিন্ন জলজপ্রাণী রক্ষা পাবে; ফিরে আসবে জীববৈচিত্র্যÑ এমনটাই জানান তিনি।