Last Updated on ফেব্রুয়ারি ১, ২০২৫ by
এগিয়ে চলেছে চাঁপাইনবাবগঞ্জের নারীরা
আসমা উষা
কথায় আছে- ‘যে রাঁধতে জানে, সে চুলও বাঁধতে জানে।’ আর এই কথাটি নারীদের গুণের উদাহরণের ক্ষেত্রে বলা হয়। সৃষ্টিজগতে মানবের নারী ও পুরুষ হিসেবে পৃথিবীতে আগমন। সৃষ্টিগত জীবগুলোর মধ্যে মানুষের জ্ঞান, বুদ্ধি ও উন্নত বিবেকের কারণেই মানুষ জীবজগতের অন্যান্য জীবকুল হতে এক বিশেষ অবস্থান করে রয়েছে। আবার মানুষ হিসেবে পুরুষ কিংবা নারী- কেউই কোনো অংশে কম নয়।
অথচ অনেকেই মনে করেন, পুরুষরাই নারীদের চেয়ে সকল কিছুর ঊর্ধ্বে। পুরুষরা যা পারে, নারীরা তা পারে না। আর এর জন্য দায়ী, আমাদের সমাজব্যবস্থা, সামাজিক হীন্য মানসিকতা ও নানা ধরনের কুসংস্কার প্রভৃতি।
এই পরিস্থিতি হতে পরিত্রাণের একমাত্র উপায় হচ্ছে শিক্ষা। এ কারণে নারী সমাজ তথা বাংলাদেশের উন্নয়ন অনেকাংশেই ব্যাহত হচ্ছে। কেননা আমাদের দেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেকই নারী। একজন নারী শিক্ষিত হলে সে তার পরিবার, সন্তান এমনকি পুরো দেশকে উন্নয়নের দিকে নিয়ে যেতে পারবে।
বর্তমান কালের নারীরা আজ সংসার সামলিয়েও দেশের নানা ক্ষেত্রে সফলতার সাথে নানা পদ অলংকৃত করছেন। তারা বিভিন্ন অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারি-বেসরকারি নানা প্রতিষ্ঠানে তাদের যোগ্যতা ও দক্ষতার মাধ্যমে কর্মপরিচালনা করছেন। পিছিয়ে নেই চাঁপাইনবাবগঞ্জের নারীরাও। চাঁপাইনবাবগঞ্জের একমাত্র বৃহৎ বিদ্যাপীঠ নবাবগঞ্জ সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে সুনামের সহিত দায়িত্ব পালন করেছেন অধ্যাপক রাজিয়া সুলতানা। দেশবরেণ্য সংগীত শিল্পী ইফফাত আরা নার্গিসও এই জেলার মেয়ে। শিক্ষাবিদ মার্জিনা হকেরও অবদান কম নয়। চাঁপাইনবাবগঞ্জের এমন আরো অনেক নারীকেই পাওয়া যাবে, যারা সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রেখেছেন।
আর তাই নেপোলিয়ন বোনাপার্টের সেই বিখ্যাত উক্তির “তোমরা আমাকে শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাদের শিক্ষিত জাতি উপহার দেব।” যথার্থতা মেলে এসব নারীদের ক্ষেত্রে।
শুধুমাত্র চাকরি ক্ষেত্রেই নয়, ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও বর্তমানে এই জেলার নারীরা অনেকটা অগ্রসর হয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্য করে নিজেদের আর্থিক সচ্ছলতার পাশাপাশি বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও তারা অবদান রাখছে। এর মাধ্যমে নারীরা শুধুমাত্র ব্যক্তিগত জীবনেই স্বাবলম্বী হচ্ছে না, বরং দেশের অর্থনীতির চাকাকেও ঘুরিয়ে দিচ্ছে।
আমি মনে করি, দেশের বিভিন্ন স্থান বা অঞ্চলভেদে মানুষের আচার-আচরণগত বৈশিষ্ট্য, শিক্ষা-দীক্ষা, পেশা এবং বিভিন্ন ধরনের দক্ষতা ও নিপুণতা থাকে। ঠিক তেমনি আমাদের এই চাঁপাইনবাবগঞ্জের অধিবাসী হিসেবে নারী-পুরুষরা শিক্ষা-দীক্ষাসহ সব ক্ষেত্রে আজ এগিয়ে।
এ জেলার নারীদের রান্না বেশ সুস্বাদু ও মজাদার। তারা চাঁপাইনবাবগঞ্জের বিখ্যাত ও ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। তারা চাঁপাইনবাবগঞ্জের বিখ্যাত কলাইয়ের রুটি, হাঁসের মাংস, বেগুন ভর্তা, ডালের বড়ি, বিভিন্ন ধরনের পিঠা-পায়েস বানাতে অতুলনীয়। রান্না ছাড়াও তারা হস্তশিল্পেও বেশ দক্ষ। এ জেলার ঐতিহ্যবাহী নকশিকাঁথা এখানকার প্রত্যেক ঘরে প্রায় সব মেয়েরাই এর সেলাইয়ে পারদর্শী। নকশিকাঁথার মধ্যে কার্পেট হলো চাঁপাইনবাবগঞ্জের বিখ্যাত ও ঐতিহ্যবাহী। এখানকার নারীরা তাদের সুনিপুণ হাতে অনেক যতেœ নকশিকাঁথায় ফুটিয়ে তোলে বিচিত্র লতাপাতা। ফুল ছাড়াও থাকে আরো বাহারি রঙের নকশা। কার্পেট ছাড়াও আরো অনেক ধরনের নকশিকাঁথা রয়েছে এখানে; যেমনÑ সুজনি, বকুলফুল, নিমফুল, দুই মুহনী ইত্যাদি।
একসময় নারীরা এসব নকশিকাঁথা সেলাই করত শুধুমাত্র নিজের গৃহের শোভাবর্ধনের জন্য। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে তার পরিবর্তন ঘটেছে। দেশের অভ্যন্তরে এবং বিদেশেও এর চাহিদা তৈরি হওয়ায় এখানকার অনেক নারী হস্তশিল্পকে বাণিজ্যিকভাবে নিয়েছেন। এর মাধ্যমে ঘরে বসে আয়ের পথ সুগম করেছেন তারা।
শুধু হস্তশিল্পই নয়, বিভিন্ন খাবার বানিয়ে অনলাইন অর্ডারের মাধ্যমে সরবরাহও করছেন অনেকেই। যা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক দেখলেই বোঝা যায়। অর্থাৎ এখানকার অনেক নারীই বর্তমানে নিজেকে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন আয়োজনে এসব নারীদের স্টল দেখে এর সত্যতা মেলে। নকশিকাঁথার স্টলগুলোর মধ্যে চাঁপাইনবাবগঞ্জে শহরের প্রাণকেন্দ্র বড়ইন্দারা মোড়ে অবস্থিত ‘নুর নকশী কর্নার’, পৌরসভার মুন্সীপাড়ার ‘শাপলা-শিফা নকশী কাঁথা’, চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদরের পলশা গ্রামের ‘বর্ষা নকশী পল্লী’ উল্লেখযোগ্য।
শিক্ষা-দীক্ষায়ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের মেয়েরা অনেকাংশে এগিয়ে গেছে। মা-বাবা শিক্ষার গুরুত্ব অনুধাবন করায় তারা তাদের ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েদেরও উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করছেন। তবে অধিক জনসংখ্যার দেশ হওয়াই কর্মসংস্থান প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল। কিন্তু বিজ্ঞানের এই উৎকর্ষতার যুগে মানুষ শুধুমাত্র চাকরির প্রত্যাশা করে না, বরং তারা নিজেদের শিক্ষা, বুদ্ধি ও দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে ফ্রিল্যান্সিং করে পরিবারকে করছে স্বচ্ছল। পাশাপাশি আরো পাঁচজনের কর্মসংস্থান করছে। এভাবেই নারীরা দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের নারীরাও কেবলমাত্র চাকরির প্রত্যাশা না করে নিজেরাই বিভিন্ন কর্মের উদ্যোগ গ্রহণ করে সফলতার মুখ দেখছেন। হয়ে উঠছেন নারী উদ্যোক্তা। হস্তশিল্প, খাদ্যপণ্য, হাঁস-মুরগি ও গরু-ছাগল, কবুতর-কোয়েল পালন, ইত্যাদি মাধ্যমে অনেক নারী নিজেদের স্বাবলম্বী করে তোলার নজির গড়েছেন। এছাড়া কৃষিকাজেও অনেক নারীকে যুক্ত হতে দেখা যাচ্ছে এ অঞ্চলে।
আমের রাজধানী চাঁপাইনবাবগঞ্জ। আর তাই আমের বিভিন্ন ধরনের আচার তৈরি করে স্থানীয় বাজার ছাড়াও দেশের অভ্যন্তরে বিক্রি করছেন নারীরা। ঐতিহ্যবাহী কুমড়ার বড়িও চলে যাচ্ছে অনলাইন অর্ডারের মাধ্যমে গ্রাহকের হাতে; যা ১০ বছর আগে ছিল কল্পনাতীত। পোশাক বা বুটিক পরিচালনার ক্ষেত্রেও এখানকার নারীরা বেশ এগিয়ে গেছেন। অনেকেই দোকান বা শোরুম খুলেও বসেছেন। বিভিন্ন উৎসব বা মেলায় স্টলও দিচ্ছেন।
এভাবেই এগিয়ে চলেছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের নারীরা। নিজের, পরিবারের ভাগ্যের চাকা ঘোরানোর পাশাপাশি আশপাশের অনেক নারীও তাদের মাধ্যমে স্বাবলম্বী হওয়ার পথ খুঁজে পেয়েছেন। এমন কয়েকজন নারীকে জানি, যারা নিজের চেষ্টায় ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে উঠেছেন, পরিবারে সচ্ছলতাও এনেছেন। শুধু তাদের নাম নিয়ে অন্যদের ছোট করতে চাই না।
বর্তমানে নারী উদ্যোক্তার সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটি দেশের অর্থনীতিতে একটি উল্লেখযোগ্য দিক। সরকারও নারী উদ্যোক্তা তৈরিতে নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করে চলেছে। তাদের স্বাবলম্বী করে গড়ে তুলতে বিভিন্ন সহায়তাও দেয়া হচ্ছে।
এ কথাও বলতে হয় যে, নারী উদ্যোক্তারা সাফল্য অর্জন করলেও তাদের সামনে এগোতে অনেক প্রতিবন্ধকতার মধ্যে পড়তে হয়। যেমন, ১. আর্থিক সহায়তার অভাব। অনেক উদ্যোক্তাই ব্যবসা শুরু করার জন্য পর্যাপ্ত পুঁজি বিনিয়োগ করতে পারে না। ২. সামাজিক বাধাও একটি বড় কারণ। সমাজের কিছু মানুষ এখনো নারী উদ্যোগকে সমর্থন করতে পারে না। ৩. দক্ষতার অভাবও রয়েছে। অনেক নারী কাজ জানলেও সেটা পরিচালনার জন্য যথেষ্ট দক্ষতা অর্জন করতে সক্ষম হন না।
তবে এসব প্রতিবন্ধকতাকে কাটিয়ে উঠে নারী উদ্যোক্তারা অনেক সম্ভাবনাও দেখতে পাচ্ছেন। কেননা, সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে তাদের জন্য প্রশিক্ষণ, ঋণ এবং বিপণন সহায়তাও দেয়া হচ্ছে।
নারী উদ্যোক্তারাও দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন। আশা, এসব প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে। আর এভাবে আরো এগিয়ে যাক নারীরা। পুরুষের পাশাপাশি নারীদের হাত ধরেও এগিয়ে যাক প্রিয় চাঁপাইনবাবগঞ্জ।
আসমা উষা : সমাজকর্মী