বিপাশা রবি দাস
গোলা ভরা ধান পুকুর ভরা মাছ আর গোয়াল ভরা গরু-এই ছিল একদা আবহমান বাংলার এক চির চেনা রূপ। কৃষিভিত্তিক বাংলার প্রাণ, কৃষককুল জমিতে ফসল ফলান, আবার কাছের ডোবা, পুকুর জলাশয়ে মাছ চাষ করেন, উঠানেই পালিত হয় হাঁস-মুরগি, গোয়ালে ছাগল ও গরু। আঙ্গিনায় শাক-সবজি চাষ তো স্বভাবগত। তবে পারিবারিক খামার গড়ার স্বপ্ন সবার থাকলেও পুঁজির অভাবে অনেকেই তা পেরে ওঠেন না। এসব প্রান্তিক মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
প্রধামন্ত্রীর উদ্যোগে একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প চালু করা হয়। প্রকল্পটি বাংলাদেশ সরকারের গৃহীত সমবায় সমিতি ভিত্তিক একটি দীর্ঘমেযাদী সামাজিক পরিকল্পনা। এই প্রকল্পটির আওতায় গ্রামের দরিদ্র পরিবারগুলোকে অর্থনৈতিক ইউনিট হিসেবে তৈরি করার মাধ্যমে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নযন ঘটানোর উদ্যোগ।
২০০৯ সালের জুলাই থেকে ২০১৪ সালের জুন মাস মেয়াদে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ২০০৯ সালের নভেম্বর মাসে একনেক কর্তৃক অনুমোদিত হয়। ২০২০ সালের মধ্যে দেশে দারিদ্র্যতার হার ১০ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যে এই প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়। সমন্বিত গ্রাম উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রতিটি বাড়িকে অর্থনৈতিক কার্যাবলির কেন্দ্রবিন্দু হিসাবে গড়ে তোলার প্রয়াসে ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্পটি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়। এ প্রকল্পের আওতায় সারাদেশে দরিদ্র জনগোষ্ঠী আজ স্বালম্বী হবার সুযোগ পাচ্ছে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জেও এর সুফল পাচ্ছে দরিদ্র মানুষ। একটি বাড়ি একটি খামারের ঋণ নিয়ে স্বাবলম্বী হয়েছেন ফেরদোসী বেগম নামের এক নারী। তিনি সদর উপজেলার বারঘরিয়া ইউনিয়নের লক্ষ্মীপুর গ্রামের বাসিন্দা।
ফেরদৌসী বেগম বলেন-আমার ২ ছেলে ১ মেয়ে। বড় ছেলের নাম জামিল, সে এবার ডিপ্লোমা পড়ছে। ছোট ছেলের নাম জমিল খান এবার এস এস সি পরিক্ষার্থী। মেয়ের নাম ফারজানা সে ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ে। স্বামীর নাম বসির খান তিনি আগে দিন মুজর ছিলেন, যখন যা কাজ সামনে পেতেন তাই করতেন। কখনো ধান কাটতেন, কখনো কারো ঘরের চাল ঠিক করতেন। নিজের জমি নেই তাই অন্যের জমিতে কাজ করতেন এভাবে আনেক কষ্টে দিন কাটিয়েছি। খেয়ে নাখেয়ে আনেক কষ্টে দিন কাটত। টিনের বাড়িতে আনেক কষ্ট করে দিন কাটিয়েছি। বৃষ্টির সময় চাল ফুট হয়ে পানি পড়ত। গরমের সময় টিনের তাপে অনেক গরম লাগত, কখন দুবেলা ঠিক মতো খেতে পেয়েছি কখন পাইনি। এর ওর কাছ থেকে ধার-দেনা করে দিন কাটিয়ছি। তবুও খেয়ে না খেয়ে খুব কষ্টে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করিয়ে যাচ্ছি।
২০১৪ সালে একদিন আমাদের ওয়ার্ডে দরিদ্র মানুষদের নিয়ে একটি বাড়ি একটি খামার থেকে এক বৈঠক বসে, সেখানে আমাদের এখানকার সবাই গিয়েছিল। সবার কথা শুনে আমিও সেখানে যায়। তারা বলেন “আমরা যত টাকা জমা দেব সরকার আমাদের সমপরিমাণের টাকা দেবে, আমাদের প্রতি মাসে ২০০ টাকা করে জমাদিতে হবে, এবং মাত্র ৮ শতাংশ লাভে ঋণ দেয়া হবে, আমরা ঋণ নেয়ার পরে কীভাবে ঋণ পরিশোধ করব তা আমরাই ঠিক করব। যেমন প্রতি মাসে, বছরে দুই বারে বা এক বছর পরে একবারে শোধ করা যাবে”। এসব কথা শোনার পর বাড়িতে এসে সবাইকে বলি। এদিকে পাড়ার একেক জন একেক ধরনের কথ বরতে লাগে। কেউ বলে এটাকি সত্যি দেবে না আমাদের লোভ দেখাচ্ছে, কেউ বলে এভাবে লোভ দেখিয়ে আমাদের টাকা নিয়ে চলে যাবেনাতো ! একেক জন একেক রকমের মন্তব্য করতে লাগল। আবষেশে তারা আমাদের বোঝাতে সক্ষম হন। তারা আমাদের ভালোভাবে বোঝান এবং তাদের কথা শোনার পর অনেকে আগ্রহী হয়। আমাদের এখানে আনেকে এ সমিতির অন্তর্ভক্ত হয়। তাদের সাথে আমিও সমিতির অন্তর্ভক্ত হয়। সমিতিতে অন্তর্ভক্ত হওয়া ৬ মাস পরে ১০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলাম। এই ঋণের টাকা দিয়ে আমি মুদিখানার দোকান দিই। সংসারের খরচ যোগানোর পাশাপাশি মাসে মাসে ঋণ শোধ করি। তার পরে আবার ১৫ হাজার টাকা নিই এবং একটি হোটেল খুলি। হোটেলে পুরি, বেগুনি, পিয়াজু, ডালের বড়া করে কিক্রি করি। আমি একই সাথে দোকান ও বাড়ি সামলায়। প্রথমে এতে আসেন কষ্ট হত দুদিক সামলাতে হিমসিম খেতাম। এতে লাভ হওয়ায় আমার স্বামীও আমার সঙ্গ দেন। তার পর দুজনে বেশ সুন্দর করে সবটা গুছিয়ে নিয়েছি। আমরা এটা আরও বড় করি। তখন থেকে একটু সচ্ছলভাবে জীবন যাপন শুরু হয়। এভাবে কিছু টাকা জমিয়ে আবার ২০ হাজার টাকা নিয়ে একটি গর্ভবতী গাভী কিনেছি। এখন আগের থেকে আনেক সুখে আছি। এভাবে একটু একটু করে টাকা জমিয়ে টিনের বাড়ি ভেঙ্গে ভালো ও সুন্দর করে ছাদের বাড়ি করেছি। ছেলেমেয়েদের অনেক ভালোভাবে লেখাপড়া করাতে পারছি। এখন আমি একই সাথে সংসার ও দোকান সামলায় এবং গরুর দেখাশোনা করি। ছেলে মেয়েরা সারাদিন স্কুল প্রাইভেট এই সব নিয়ে ব্যস্ত থাকে। ছোট ছেলে মাঝে মাঝে বড় ছেলের দোকানে বসে।
এভাবেই আমি আমার সংসার চালিয়ে যাচ্ছি। আমি আমার নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছি। এদিকে আমার বড় ছেলে লেখাপড়ার পাশাপাশি এই সমিতির সদস্য হয়ে ১৫ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে পল্ট্রি মুরগীর একটি দোকান দিয়েছে। এখন আমি বলব আমি ভালো আছি, সুখে আর শান্তিতে আছি।
ফেলো-রেডিও মহানন্দা ৯৮.৮ এফ.এম