রবিবার, ৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ২৬ মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৯ শাবান, ১৪৪৬ হিজরি

Last Updated on ফেব্রুয়ারি ১, ২০২৫ by

উপজেলা ও গ্রামপর্যায়ে সরকারি স্বাস্থ্যসেবা জানতে হবে, জানাতে হবে

ডা. আসাদুর রহমান বিপ্লব

জনগণের সর্বস্তরে মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করছে দেশের স্বাস্থ্য বিভাগ। তবে স্বাস্থ্যের মানোন্নয়নে সর্বাগ্রে প্রয়োজন জনসচেতনতা ও জনঅংশগ্রহণ। বিনামূল্যে কিংবা স্বল্প খরচে ধনী-গরিব নির্বিশেষে সকলের জন্য প্রাথমিক চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে প্রতিটি উপজেলায় স্বাস্থ্যসেবার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে রয়েছে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। একজন সচেতন নাগরিক চাইলে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের প্রবেশমুখে স্থাপিত সিটিজেন চার্টারের মাধ্যমে খুব সহজেই প্রাপ্য স্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পেতে পারেন। তবে বাস্তবতা হলো, আমরা এখনো সকলে সরকারি স্বাস্থ্যসেবা সম্বন্ধীয় তথ্য ঠিকভাবে জানি না।
বর্তমানে দেশের বেশির ভাগ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে রয়েছে ৫০ শয্যাবিশিষ্ট আন্তঃবিভাগ, যেখানে রোগীদের চিকিৎসার পাশাপাশি পথ্য সরবরাহ করা হয় এবং বরাদ্দ থাকা সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ওষুধও বিতরণ করা হয় সম্পূর্ণ বিনামূল্যে; এক্ষেত্রে রোগীর ভর্তি ফি মাত্র ৫ টাকা। এছাড়া আগত রোগীরা মাত্র ৩ টাকা মূল্যের টিকেট সংগ্রহ করে প্রতিদিন (শুক্রবার ও সরকারি ছুটির দিন ব্যতীত) বহিঃবিভাগে সকাল থেকে দুপুর অবধি প্রযোজনীয় চিকিৎসা সেবা গ্রহণ ও ওষুধ সংগ্রহ করে থাকেন। আর বছরের ৩৬৫ দিন ২৪ ঘণ্টা নিরবচ্ছিন্নভাবে খোলা থাকে হাসপাতালের জরুরি বিভাগ। এখানেও টিকেট মূল্য মাত্র ৩ টাকা।
সকলের অবগতির জন্য জনস্বার্থে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রদেয় স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রমের গুরুত্বপূর্ণ অংশ তুলে ধরা হলো।

গর্ভবতী মায়ের সেবা
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের এএনসি ও পিএনসি কর্নারে প্রসূতি মায়ের প্রসবপূর্ব ও প্রসব-পরবর্তী সেবা বিনামূল্যে দেয়া হয়। এছাড়া ২৪ ঘণ্টা বিনামূল্যে নরমাল ডেলিভারির সুব্যবস্থা থাকে এবং কিছু কিছু উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রযোজ্য ক্ষেত্রে সিজারিয়ান ডেলিভারির সুযোগ রয়েছে।

টিকাদান কার্যক্রম
‘ইপিআই’ টিকা কার্যক্রমের আওতায় সকল শিশুকে ১০টি রোগ প্রতিরোধে বিভিন্ন টিকা প্রদান এবং কিশোরীদের জন্য টিটি ভ্যাকসিন ও জরায়ু-মুখ ক্যান্সার প্রতিরোধী এইচপিভি টিকা প্রদান করা হয়। এছাড়া বরাদ্দ থাকা সাপেক্ষে জলাতঙ্ক প্রতিরোধে র‌্যাবিস ভ্যাকসিনও প্রদান করা হয়।

আইএমসিআই ও পুষ্টি সেবা
০-৫ বছর বয়সী শিশুদের জন্য রয়েছে আইএমসিআই ও পুষ্টি কর্নার। এখানে অসুস্থ শিশুর সমন্বিত চিকিৎসা এবং মায়েদের পুষ্টিবিষয়ক স্বাস্থ্য শিক্ষা প্রদান করা হয়। পাশাপাশি ওজন ও উচ্চতা পরিমাপের মাধ্যমে শিশুর দৈহিক বৃদ্ধি পর্যবেক্ষণ করা হয় এবং মারাত্মক অপুষ্টির শিশুকে হাসপাতালে ভর্তি রেখে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ও বিনামূল্যে থেরাপিউটিক মিল্ক প্রোডাক্ট প্রদান করা হয়।

যক্ষ্মা ও কুষ্ঠ ইউনিট
একনাগাড়ে দুই সপ্তাহের অধিক সময় ধরে কাশি যক্ষ্মার অন্যতম লক্ষণ। এছাড়াও প্রতিদিন জ্বর আসা, ক্ষুধা কমে যাওয়া, ওজন কমে যাওয়া, কফের সঙ্গে রক্ত আসা, বুকে ব্যথা, অল্প পরিশ্রমে হাঁপিয়ে যাওয়া, দুর্বলতা অনুভব করা, ঘাড় / বগল / কুঁচকিতে ফোলা বা গোটাÑ এসব লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত নিকটস্থ স্বাস্থ্য কেন্দ্রে যোগাযোগ করতে হয়। এখানে অত্যাধুনিক জিন-এক্সপার্ট মেশিনের সাহায্যে কফ পরীক্ষাসহ যক্ষ্মা রোগ নির্ণয়ের যাবতীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা বিনামূল্যে করা হয়। এছাড়াও বিনামূল্যে কুষ্ঠ রোগ নির্ণয় ও প্রয়োজনীয় চিকিৎসার সুব্যবস্থা থাকে।

এনসিডি কর্নার
মূলত অসংক্রামক রোগের চিকিৎসা ব্যয়বহুল হওয়ায় বেশিরভাগ দারিদ্র্যপীড়িত রোগী নিয়মিত ওষুধ সেবন করেন না। ফলে অনেকেই দীর্ঘমেয়াদি জটিলতায় আক্রান্ত হয়ে পড়েন। তাই এনসিডি কর্নারে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, শ^াসতন্ত্রের বাধাজনিত দীর্ঘমেয়াদি রোগসহ বিভিন্ন অসংক্রামক রোগের চিকিৎসা প্রদান করা হয় এবং বরাদ্দ থাকা সাপেক্ষে বিনামূল্যে প্রয়োজনীয় ওষুধ সরবরাহ করা হয়।

টেলিমেডিসিন সেবা
অনেক সময় উপজেলা পর্যায়ে রোগীর চিকিৎসায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শের প্রয়োজন হয়। প্রযোজ্য ক্ষেত্রে নির্ধারিত উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে টেলিমেডিসিন সার্ভিসের মাধ্যমে অডিও-ভিডিও কলের সাহায্যে নির্দিষ্ট বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে রোগীকে সহজেই প্রয়োজনীয় উন্নত চিকিৎসা প্রদান করা সম্ভব হয়।

কৈশোরবান্ধব স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র
১০-১৯ বছর বয়সী কিশোর-কিশোরীদের জন্য কৈশোরের স্বাস্থ্য তথ্য, সমস্যার সমাধান ও পরামর্শ প্রদানের উদ্দেশ্যে বেশিরভাগ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চালু হয়েছে কৈশোরবান্ধব স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র।

মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক কার্যক্রম
সম্প্রতি গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের ১৮% মানুষ কোনো না কোনো মানসিক রোগে আক্রান্ত। অথচ দেশের প্রায় ৯৩% মানসিক রোগী চিকিৎসার বাইরে। পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমানে চাঁপাইনবাবগঞ্জ, যশোর, সিলেট, বান্দরবানসহ মোট ১০টি জেলায় শুরু হয়েছে মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক কার্যক্রম এবং সেখানে নির্দিষ্ট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে ‘মনের জানালা’ বা ‘মনের বাড়ি’ নামে মানসিক স্বাস্থ্য কর্নার স্থাপন করা হয়েছে।

কমিউনিটি আই সেন্টার
নির্ধারিত উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে স্থাপিত কমিউনিটি আই সেন্টারে চক্ষু পরীক্ষার উন্নত উপকরণ, যেমনÑ স্লিট ল্যাম্প বায়োমাইক্রোস্কোপ, রিফ্র্যাক্টোমিটার ইত্যাদি ব্যবহার করে চক্ষু রোগ নির্ণয় ও টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে চিকিৎসা প্রদান করা হয় এবং প্রয়োজনীয় ওষুধ, যেমনÑ চেখের ড্রপ সরবরাহ করা হয়।

ভায়া টেস্ট ও সিবিই
নারীদের জরায়ু-মুখ ও স্তন ক্যান্সার নির্ণয়ের জন্য সম্পূর্ণ বিনামূল্যে ভায়া টেস্ট ও ক্লিনিকাল ব্রেস্ট এক্সামিনেশনের (সিবিই) সুবিধা রয়েছে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে। এক্ষেত্রে জাতীয় পরিচয়পত্র আবশ্যক।

প্যাথলজি, আল্ট্রাসনোগ্রাফি, এক্সরে ও ইসিজি
নির্ধারিত ইউজার ফি প্রদানের মাধ্যমে ন্যূনতম খরচে প্যাথলজিক্যাল রুটিন পরীক্ষা-নিরীক্ষা, এক্সরে ও ইসিজির ব্যবস্থা রয়েছে। এছাড়াও আল্ট্রাসনোগ্রাফির সুবিধা রয়েছে প্রযোজ্য উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে।

কমিউনিটি ক্লিনিক (সিসি)
গ্রামপর্যায়ে প্রতি ৬ হাজার জনের জন্য স্থাপিত প্রতিটি কমিউনিটি ক্লিনিকে বিনামূল্যে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, মা ও শিশু রোগসহ বিভিন্ন অসুখের প্রাথমিক চিকিৎসায় ২২ প্রকারের ওষুধ প্রদান করা হয়। এছাড়াও সিসিগুলোতে প্রযোজ্য ক্ষেত্রে পরিবার পরিকল্পনা ও জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি এবং পুষ্টি ও স্বাস্থ্য শিক্ষাবিষয়ক কার্যক্রম পরিচালিত হয়।

অন্যান্য
ডায়রিয়া বাংলাদেশের রোগগুলোর মধ্যে অন্যতম। ডায়রিয়া আক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসায় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে চালু আছে ওরাল রিহাইড্রেশন থেরাপি (ওআরটি) কর্নার। অন্যদিকে গ্রামপর্যায়ে স্বাস্থ্য সচেতনতামূলক উঠান বৈঠক, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্কুল হেলথ প্রোগ্রামের আওতায় স্বাস্থ্য শিক্ষা, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জন্য ট্রাইবাল হেলথ ক্যাম্প এবং বিনামূল্যে ওষুধ বিতরণ কার্যক্রমের আয়োজন করে থাকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। এছাড়া উপজেলা পর্যায়ে সর্পদংশন আক্রান্ত রোগীর প্রাথমিক চিকিৎসা শুরু ও প্রয়োজনে অ্যান্টিভেনম প্রয়োগ এবং প্রযোজ্য ক্ষেত্রে রোগীর উন্নত চিকিৎসার জন্য রেফারেল কার্যক্রম বাস্তবায়নে কম খরচে জরুরি অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস প্রদানসহ বছরব্যাপী স্বাস্থ্যবিষয়ক বিভিন্ন ক্যাম্পেইন পরিচালনার মাধ্যমে স্বাস্থ্যের মানোন্নয়নে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বিশেষ ভূমিকা পালন করে প্রতিটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স।
উল্লেখ্য, সকল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পর্যাপ্ত জনবল না থাকা সত্ত্বেও কর্তব্যরত ডাক্তার, নার্স, চিকিৎসা সহকারীসহ সংশ্লিষ্ট সকলেই আগত সেবাগ্রহীতাদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা প্রদানের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করে থাকেন। অথচ মাত্রাতিরিক্ত রোগীর চাপ সামাল দিতে গিয়ে অনেকেই হিমশিম খান। তবে কখনোই কোনো রোগীকে চিকিৎসা ব্যতিরেকে ফেরত পাঠানোর নজির নেই। এরপরও অনেক সময় আমরা বাস্তবতা না বুঝেই অমূলক সমালোচনা করি। ফলে আমাদের অজ্ঞাতেই সরকারি স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রমে জনঅংশগ্রহণ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়। আর এতে স্পষ্টত ক্ষতিগ্রস্ত হয় সাধারণ জনগণ।
পরিপ্রেক্ষিতে বিনামূল্যে এবং প্রযোজ্য ক্ষেত্রে কম খরচে মানসম্মত ও নিরাপদ সরকারি চিকিৎসা সেবা গ্রহণ না করে অনেকেই আমরা অপ্রয়োজনীয় চিকিৎসা ব্যয়ে জর্জরিত হচ্ছি। আবার কেউ কেউ অপচিকিৎসার দিকে ধাবিত হয়ে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছি প্রতিনিয়ত। গ্রামেগঞ্জে এখনো এসব চরম মাত্রায় পরিলক্ষিত হচ্ছে।
সর্পদংশনের চিকিৎসার জন্য আক্রান্ত ব্যক্তিকে তথাকথিত ওঝা কিংবা কবিরাজের কাছে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, হাড়-ভাঙার চিকিৎসার জন্য একজন রোগীকে কোনো হাসপাতালে কিংবা অর্থোপেডিক সার্জনের কাছে না নিয়ে গিয়ে যত্রতত্র হাতুড়ে ডাক্তারের কাছে এলোমেলোভাবে ভাঙা-হাড়ের প্লাস্টার করিয়ে নেয়া হচ্ছে। আবার কোথাও কোথাও অন্য কোনো জটিল রোগে আক্রান্ত রোগীর জন্ডিস না থাকা সত্ত্বেও জন্ডিস নিরাময়ের নামে সকাল-সন্ধ্যা ঝাড়ফুঁক করা হচ্ছে। এসব কারণে একজন রোগীর সুচিকিৎসা যেমন ব্যাহত হচ্ছে, ঠিক তেমনি রোগী তার নিজের অজান্তেই নানাবিধ মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকির মুখে পতিত হচ্ছেন, কখনো কখনো অনাকাক্সিক্ষত মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে।
অথচ একজন রোগী যদি তার চিকিৎসার জন্য ন্যূনতম একটি নিকটস্থ সরকারি হাসপাতালের ওপর আস্থা রাখেন, তাহলে তিনি অন্তত সব ধরনের অপচিকিৎসা থেকে নিরাপদ থাকবেন। তাই আমাদের সকলের স্বাস্থ্যের নিরাপত্তা এবং কম খরচে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে সরকারি স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম সম্বন্ধে স্পষ্ট ধারণা থাকাটা অতীব জরুরি। এজন্য সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। উপজেলা ও গ্রামপর্যায়ে প্রদেয় সরকারি স্বাস্থ্যসেবার বিষয়ে নিজে জানতে হবে, স্পষ্ট ধারণা রাখতে হবে এবং অন্যকে জানাতে হবে।

ডা. মো. আসাদুর রহমান বিপ্লব : আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও), উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, মহম্মদপুর, মাগুরা

About The Author

শেয়ার করুন