-ড. মোহা. এমরান হোসেন-
আশুরা শব্দটি আরবি। আরবি অভিধান সমূহে আশুরা শব্দটির দুটি অর্থ পরিলক্ষিত হয়। এক. মুহাররম মাসের দশ তারিখ। এ অর্থই এখানে প্রনিধানযোগ্য। দুই. ছাল ছড়ানো গমের তৈরী এক প্রকার মিষ্টান্ন। এ খাবারে কখনো কখনো দুধ, কিশমিশ ও পেস্তা মেশানো হয়।
ইসলামের ইতিহাসে এ দিনটি বিভিন্ন কারণে গুরুত্বপূর্ণ। কারণগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- ১। এদিনে আসমান ও জমিন সৃষ্টি করা হয় ২। এ দিনে পৃথিবীর প্রথম মানুষ হযরত আদম (আ.)কে সৃষ্টি করা হয় ৩। এ দিনে আল্লাহ নবিদেরকে স্ব স্ব শত্রুর হাত থেকে আশ্রয় প্রদান করেন ৪। এ দিনে নবি মূসা (আ.) এর শত্রু ফেরাউনকে নীল নদে ডুবিয়ে মারা হয় ৫। এ দিনে নূহ (আ.) এর কিস্তি ঝড়ের কবল থেকে রক্ষা পায় ৬। এ দিনে দাউদ (আ.) এর তাওবা কবুল হয় ৭। এ দিনে নমরুদের অগ্নিকু- থেকে হযরত ইবরাহিম (আ.) মুক্তিলাভ করেন ৮। এ দিনে আইয়ুব (আ.) দুরারোগ্য ব্যধি থেকে সুস্থ্যতা লাভ করেন, ৯। এ দিনে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ঈসা (আ.)কে আকাশে উঠিয়ে নেন। ১০। এক হাদিস মতে এ তারিখেই কিয়ামত সংঘটিত হবে। ১১। তবে বিশেষভাবে এদিনটি সব মুসলমানের নিকট স্মরণীয় হয়ে আছে ইয়াযিদ ইবন মুআবিয়াহ কর্তৃক নবি (স.) এর দৌহিত্র হযরত হুসাইন (রা.) এর করুন শাহাদাত লাভের ঘটনার কারণে।
আশুরা বলতে সাধারণের নিকট কারবালার বিয়োগান্ত ঘটনাই উপজীব্য হয়ে উঠে। হযরত মুয়াবিয়ার মৃত্যুর পর তাঁর মনোনয়ন অনুসারে তাঁর পুত্র ইয়াজিদ ৬৮০ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মোতাবেক ৬১ হিজরির শাবান মাসে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। এটি ছিল গণতান্ত্রিক নিয়মে খলিফা নির্বাচন পদ্ধতির বিপরীত বিদ‘আত পন্থা। অপরদিকে ইয়াজিদ ছিলেন ইসলামি ভাবাদর্শ বিবর্জিত ব্যক্তিত্ব। সে কারণে মহানবি (স.) এর দৌহিত্র হযরত হুসাইন (রা.) শ্বৈরাচারী ইয়াজিদের খেলাফত মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানান। কুফাবাসীরাও ইয়াজিদ এর বিপক্ষে অবস্থান নেন এবং হযরত হুসাইন (রা.)কে খলিফা হিসেবে দেখতে চান। তারা হুসাইন (রা.)কে কুফা আসার জন্য আমন্ত্রণ জানান। ফলে তিনি পরিবার-পরিজন ও ২০০ অনুচরসহ কুফার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন। ইতোমধ্যে কুফাবাসী বিশেষ পরিস্থিতির শিকার হয়ে হুসাইনের প্রতি সমর্থন ত্যাগ করে। ইয়াজিদ এর ৪০০০ সৈন্যের একটি বাহিনী হুসাইনের গতিরোধ করে। বাধ্য হয়ে হুসাইন (রা.) ফুরাত নদীর তীরবর্তী কারবালা প্রান্তরে শিবির স্থাপন করেন। তাদের সাথে অমানবিক আচরণ করা হয়। তাদেরকে পানিও পান করতে দেওয়া হয়নি। নির্মমভাবে হযরত হুসাইন (রা.)কে শহিদ করা হয়। এ নৃশংস হত্যাকা-ের ফলে মুসলিম জগত শিয়া ও সুন্নি নামে দুটি বিবদমান দলে বিভক্ত হয়ে পড়ে, যার খেসারত আজও মুসলিম মিল্লাতকে দিতে হচ্ছে। শিয়া-সুিন্নর বিভেদই মধ্য প্রাচ্যের দেশগুলোকে শতধা বিভক্ত করেছে এবং বর্তমানে রক্ত ঝরছে।
শিয়ারা মুহাররমের প্রথম ১০দিন বিশেষ অনুষ্ঠান উদযাপন করে থাকে। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- হুসাইনের পবিত্র স্থান দর্শন, তথায় মোমবাতি প্রজ্জ্বলন এবং হুসাইনের স্বপরিবারে শাহাদাত লাভের আলোচনা তুলে ধরা ইত্যাদি। আলোচনার সময় দুঃখ বেদনাদায়ক কথা শুনামাত্রই তারা স্বশরীরে চপেটাঘাত করে এবং বিলাপ করে। তারা হুসাইন ইবন আলিকে বঞ্চনা, অবিচার এবং শ্বৈরাচারিতার বিরুদ্ধে সংগ্রামের প্রতীক হিসেবে বর্ণনা করে । তারা প্রচুর পরিমাণে পানি বিতরণ করে। হুসাইন ইবন আলি কারবালা প্রান্তরে অসহ্য গরমের যন্ত্রণা ভোগ করেছিলেন তার স্মরণে তারা আগুন জ্বালায়। হুসাইনের ব্যাথায় সমব্যাথা প্রকাশ করার জন্য তারা চেইন দ্বারা নিজ শরীরে আঘাত করে রক্ত ঝরায়।
মরক্কোতে এ দিনটিকে ‘যমযম’ নামে অভিহিত করা হয়। তারা একে অপরের প্রতি পানি ছিটায়। ব্যবসায়ীরা তাদের সমস্ত পন্য প্রদর্শনী ও বিক্রয় করার চেষ্টা করেন। ১০ মুহাররম রাতে তারা চতুর্দিকে আগুন জ্বালায়, হুসাইনের স্তুতিমূলক গান গায়, হাসান ও হুসাইনের শাহাদাত লাভের বিবরণ তুলে ধরে।
বর্তমানে শিয়ারা যে প্রক্রিয়ায় আশুরার শোক প্রকাশ করে তা শরিয়ত সমর্থিত নয়। বিশেষত শরীরে আঘাত করে রক্তাক্ত করা কোনমতেই সমর্থনযোগ্য হতে পারে না। সে কারণে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী ফতোয়া জারী করেছেন, মুহাররাম ও আশুরায় শোক পালনের ক্ষেত্রে শরীর রক্তাক্ত করা হারাম। এছাড়াও তিনি পোশাক খুলে বা খালি শরীরে শোক প্রকাশ করারও বিরোধিতা করেছেন। ইরানি আলেমগণ বলেন – যারা কারবালার শোকাবহ ঘটনার জন্য শোক প্রকাশ করতে চায় তাদের উচিত অযথা রক্ত অপচয় না করে রোগীদের জন্য হাসপাতালে রক্ত দান করা। (তথ্যসূত্রঃ দৈনিক ইনকিলাব, ২৯/০৯/২০১৭ খ্রি.)।
আশুরার রোজাঃ আশুরার দিন তথা মুহাররাম মাসের ১০ তারিখ রোজা রাখা মুস্তাহাব এবং অত্যন্ত ফজিলতের কাজ। অনেকের মতে ইসলামের উষালগ্নে আশুরার রোজা ফরজ ছিল। রমজানের রোজা ফরজ হলে আশুরার রোজা মুস্তাহাব হয়ে যায়। ইবন আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (স.) মদিনায় এসে দেখলেন, ইহুদিরা আশুরার দিনে রোজা রাখছে। তিনি (স.) তাদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন – এটা কোন দিবস যে তোমরা রোজা রাখছ? তারা বলল- এটা এমন এক মহান দিবস যেদিন আল্লাহ তায়ালা মুসা (আ.) ও তাঁর সম্প্রদায়কে নাজাত দিয়েছিলেন এবং ফেরাউনকে তাঁর দলবলসহ ডুবিয়ে মেরেছিলেন। মুসা (আ.) কৃতজ্ঞতা স্বরূপ এ দিনে রোজা পালন করেন। এ কারণে আমরাও রোজা পালন করে থাকি। এ কথা শুনে রাসুলুল্লাহ (স.) বললেন- তোমাদের চেয়ে আমরা হযরত মুসা (আ.) এর অধিতকর ঘনিষ্ঠ ও নিকটবর্তী। অতঃপর রাসুলুল্লাহ (স.) রোজা রাখলেন ও অন্যদেরকে রোজা পালনের নির্দেশ দিলেন। (সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ২৭১৪)। আশুরার রোজার ফজিলত সম্পর্কে কাতাদাহ বর্ণিত এক হাদিসে নবি (স.) বলেন- আশুরার দিনের রোজাকে আল্লাহ তায়ালা বিগত এক বছরের গুনাহের কাফফারা হিসেবে গ্রহণ করে থাকেন। (জামি‘ তিরমিযি, হাদিস নং ৭৫২)।
আশুরার দিনের আগের দিন তথা মুহাররমের নবম তারিখেও রোজা রাখা মুস্তাহাব। কেননা হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস (রা.) বর্ণিত হাদিসে এসেছে- যখন রাসুলুল্লাহ (স.) আশুরার রোজা রাখলেন এবং অন্যদেরকে রোজা রাখার নির্দেশ দিলেন তখন সাহাবিরা বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! এটিতো এমন দিন যাকে ইহুদি ও খ্রিস্টানরা সম্মান প্রদর্শন করে থাকে। তখন নবি (স.) বললেন- যদি আমি আগামী বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকি তবে অবশ্যই নবম তারিখেও রোজা রাখব। (সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ২৭২২)। কিন্তু পরবর্তী মুহাররম আসার পূর্বেই নবি (স.) ইন্তিকাল করেন। অপর এক হাদিসে এসেছে, নবি (স.) বলেন- তোমরা আশুরার রোজা রাখ এবং ইহুদিদের সাদৃশ্য পরিত্যাগ করে আশুরার আগে বা পরে আরো একদিন রোজা রাখ। (মুসনাদু আহমাদ, ইবন খুযায়মাহ)। এ হাদিসের আলোকে অনেকে বলেন – কেউ ইচ্ছা করলে মুহাররমের ৯ ও ১০ তারিখ রোজা রাখবে অথবা ইচ্ছা করলে ১০ ও ১১ তারিখ রোজা রাখবে।
পরিশেষে বলতে চাই, আশুরা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে ঈমানদীপ্ত পরকালমুখী জীবন গড়ে তুলতে হবে। অপরাধমুক্ত জীবন গড়ার প্রত্যয় গ্রহণ করতে হবে। বিশেষত কারবালার হৃদয়বিদারক ঘটনা থেকে সত্যের উপর অবিচল ও অটল থাকার দিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। বিলাপ ও শরীরে চপোটাঘাত করার ন্যায় অযৌক্তি ও শরিয়ত পরিপন্থি কর্মকা- থেকে বিরত থাকতে হবে। এ ক্ষেত্রে আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের একটি উক্তি এখানে বিশেষ উল্লেখযোগ্য। তিনি বলেন-“ত্যাগ চাই, মর্সিয়া ক্রন্দন চাহি না”।
লেকক-অধ্যক্ষ, শংকরবাটী হেফজুল উলুম এফ. কে. কামিল মাদরাসা