Last Updated on ফেব্রুয়ারি ২৫, ২০২৪ by
ড. ইমদাদুল হক মামুন
চাঁপাইনবাবগঞ্জের একদিকে বরেন্দ্র ভূমির লাল এঁটেল মাটি আর তারই মাঝে মাঝে আছে বিল, ঝিল, নদী আর ডোবা। আর এর সাথে জলবায়ু, জনবসতির ধরন, লোকসমাজের আচার, বিশ্বাস, সংস্কার, ঐতিহ্য এবং নিয়ত পরিবর্তনশীল মানসকিতা আর বাইরের জনসমষ্টির প্রভাবে গড়ে উঠেছে এখানকার বিচিত্র, বহুমাত্রিক এবং ঋদ্ধ লোকসংস্কৃতি। অনতিপূর্বকাল থেকেই এ এলাকার আচার অনুষ্ঠানের অংশ হিসেবেই গড়ে উঠেছে এখানকার লোক সংস্কৃতি।
রসালো আমের জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জ। তার সাথে আছে কাঁসা, পিতল, লাক্ষা, নকশিকাঁথা ও রেশমের সম্ভার। সাথে অলংকার হিসেবে আছে দেশখ্যাত গম্ভীরা, আলকাপ আর মেয়েলি গীত। এ জেলার রয়েছে অত্যন্ত গৌরবময় অতীত। ঐতিহ্যে ভরপুর এ জেলা। স্থাপত্যকলার অজ¯্র নিদর্শন এর আনাচে কানাচে। প্রাচীন বাংলার রাজধানী গৌড়ের উল্লেখযোগ্য জনপদ এটি। ঐতিহ্যের সাথে রয়েছে এ এলাকার মানুষের অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠার দীপ্তময় ইতিহাস।
হিমালয়ের পাদদেশ থেকে বয়ে আসা মহানন্দা, পুনর্ভবা, পাগলা আর পদ্মা নদীর কোলজুড়ে রয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা। বরেন্দ্র ভূমির বিস্তীর্ণ মাঠ, প্রাচীন গৌড় নগরীর পরিত্যক্ত বিরাণভূমি আজ দেশের ব্যস্ততম জনপদে পরিণত। খুব বেশি দিন আগের কথা নয়, শত বছর আগেও এখানে ছিল দুর্ভেদ্য জঙ্গল। আর এই দুর্ভেদ্য জঙ্গলেই তৈরি হয়েছে ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্যশিল্প। এর যেমন রয়েছে ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্যশিল্প; ঠিক তেমনি রয়েছে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যও।
লোকসংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ এ জনপদটির মানুষ খুবই সাধারণ। চাষাবাদ করে ফসল ঘরে তুলে পেটপুরে ভাত খায়। সাথে নদীর ছোট সুস্বাদু নরম মাছ। মাছ না থাকলেও কোনো সমস্যা নেই। লবণ মরিচ পেঁয়াজ মাখিয়ে পেটপুরে এরা ভাত খায়। তারপর সারারাত ধরে আলকাপ গান শুরু করে। আলকাপের সুরেলা তর্কবিতর্কে স্বর্গীয় আনন্দে নেচে উঠে জনগণ। একসাথে বসে হুঁকা টানে আর গান শোনে; কি ছোট কি বড়! তাদের তখন ধর্ম থাকে না, জাত থাকে না, পাত থাকে না। একই হুঁকাতে মুখ লাগিয়ে হুঁকা টানে সবাই। আবার সমাজের অসংগতি দেখলে বা মানুষকে সজাগ করতে কখনো আলকাপ আবার কখনো গম্ভীরা গান গায়। গম্ভীরার মাধ্যমে তারা তাদের সচেতন বিদ্রোহ প্রকাশ করে।
আসলে সংস্কৃতি বলতে তো আমাদের জীবনের সাথে জড়িয়ে আছে এমন সব কিছুকেই বোঝায়। সে দিক থেকে আমার পোশাক, খাবার, বাড়ি তৈরির পদ্ধতি, ঘুমানো, চিন্তা-চেতনা, দর্শন, আনন্দ প্রকাশ পদ্ধতি, দুঃখ প্রকাশের পদ্ধতি, খাবার স্টাইল সবকিছুই। আর সব সংস্কৃতির মধ্যেই রস আছে। কব্জি ডুবিয়ে ভাত খাওয়ার মধ্যেও আছে নিজস্ব সংস্কৃতি। সে দিক থেকে ছোট মাছ খাওয়া, কলাই রুটি খাওয়া, শীতকালে পিঠা খাওয়া, আবার জামাইবাড়ি ব্যাভার দেওয়াও এক ধরনের সংস্কৃতি। তবে এখন শুধু সংস্কৃতির মধ্যে থেকে সাংস্কৃতিক দিকটাই আলোচনা করব।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের অন্যতম প্রধান সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য গম্ভীরা। যদিও এ গম্ভীরা এসেছে ¯্রােষ্টার গুণকীর্তণ থেকে। সুর দিয়ে গম্ভীরার শুরু, শেষও সুর দিয়ে। মাঝে কিছু বাক্যালাপ; তা অভিনয়ের মাধ্যমে। যার কারণে গম্ভীরাকে লোকসংগীত আর লোকসাহিত্য উভয়ের মধ্যেই ফেলা যায়। তবে গম্ভীরার শুরু মূলত শিব বন্দনা দিয়ে। গম্ভীরা শব্দটির উৎপত্তি যেভাবে হয়েছে, তার সাথে বর্তমান সংস্কৃতির তেমন একটা মিল নেই বলা চলে। কারণ গম্ভীরা শব্দটি সম্পর্কে বলা হয়, পুরীতে কাশীমিশ্রের ভবনে চৈতন্য দেবের বাসস্থানে বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল। দালানের পর দালান, তার মধ্যে খুবই ছোট ঘর বা কক্ষ। যেখানে বাইরের কোনো শব্দ যায় না; কোনো আলো যায় না। এরকম জায়গায় বসে শিবকে একান্তে স্মরণ বা শিবের বন্দনা বা শিবের পুজো করা বা শিবের গাজন। অনুমান করা হয়ে থাকে, প্রায় দেড় হাজার বছর আগে এর উৎপত্তি হয়। এ পূজা সাধারণত শিব বা মহাদেবকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠিত হতো। আবার গম্ভীরা শব্দের অর্থ মশারিও বোঝায়। তবে যাই বোঝাক না কেন, আমরা এখন বুঝি গম্ভীরা হচ্ছে খুবই হাস্যরসাত্মক লোকনাট্য ও লোকসংগীত। যার মধ্যে নানা-নাতির মজার সংলাপ আছে। আর আছে গানে গানে সমাজের অসংগতি সবাইকে জানানোর প্রচেষ্টা। এই গম্ভীরা দিয়েই চাঁপাইনবাবগঞ্জের পরিচিতি হয় সারাদেশে। গম্ভীরার নতুন ফরম অর্থাৎ শিব আরাধনা থেকে বের হয়ে রসের আধার করে দেওয়ার কাজটা মূলত সূফি মাস্টার করে গেছেন।
গম্ভীরার শুরুতেই নাতি মঞ্চের নিচে দর্শকদের জিজ্ঞেস করে, “হ্যাঁজি, তোমরা হামার নানাকে দেখ্যাছো জী?” এ প্রশ্ন করার সাথে সাথেই দর্শকের মনে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। গম্ভীরার নাতির প্রশ্নে শুধু চাঁপাইনবাবগঞ্জবাসী না, সারাদেশের মানুষ আনন্দে নাচে। আর চিৎকার করে দর্শক, শ্রোতারা তার নানাকে দেখেনি বলে জানালে নাতি মঞ্চের দিকে তাকায় এবং উপবিষ্ট শিল্পীদের বা দোহারীদের একই প্রশ্ন করে। মঞ্চের শিল্পীরা নাতিকে মঞ্চে আহ্বান জানায় আর নানা যেহেতু নাই, তাই তাকে গান গাইতে অনুরোধ করে। তাদের অনুরোধে নাতিও মনের আনন্দে বন্দনা গেয়ে নাচতে শুরু করে। এমন সময় লাঠি হাতে অকস্মাৎ নানার আগমন ঘটে। নাতিকে এভাবে ধেই ধেই করে নাচতে দেখে বিরক্ত নানা লাঠি দিয়ে নাতিকে একটা বাড়ি দেয়। আর সকালের খাবার অর্থাৎ নাস্তা (স্থানীয় ভাষায় ‘লাহারি’) নিয়ে ক্ষেতে না গিয়ে এখানে আসার জন্য কৈফিয়ত তলব করে। নাতি ইনিয়ে বিনিয়ে মঞ্চে আসার কারণ বর্ণনা করে এবং অনুষ্ঠানটির গুরুত্ব সম্পর্কে বুঝিয়ে নানাকে কিছু বলার জন্য রাজি করায়। তারপর নানা-নাতির যৌথ কণ্ঠে শুরু হয় গান আর কথাবার্তা।
গম্ভীরা পূর্বে শুরু হতো দেব বন্দনা দিয়ে। আধুনিক গম্ভীরার জনক রহনপুরের সূফি মাস্টার সেটাকে গম্ভীরা উপভোগরত মান্যগণ্য ব্যক্তিবর্গের বন্দনাতে পরিণত করেন। দেবতার কাছে অভিযোগ অনুযোগকে তিনি করেন মান্যগণ্য বা সমাজপতিদের কাছে, সমাজের অসংগতি তুলে ধরে সে সবের সমাধানের প্রচেষ্টা চালানো। দেবতার কাছে তো সব কথা বলা যায়, কিন্তু সমাজপতিদের কাছে তো আর বলা যায় না। সূফি মাস্টার তাই তার মধ্যে হাস্যরস বা উইট মিশিয়ে দেন। এই হাস্যরসের মাধ্যমে বা নানা-নাতি মজার সংলাপের মাধ্যমে মনের সব অভিযোগ অনুযোগ প্রকাশ করে দেন।
গম্ভীরা মূলত সমাজ আশ্রয়ী এবং ভাবনায় বৈচিত্র্যপূর্ণ। গ্রামীণ জীবনের সামাজিক চিত্র এতে যেমন প্রতিফলিত; তেমনি রাজনৈতিক, সামাজিক, সরকারি কর্মকা-ের অসংগতির মুখোশ উন্মোচন করে দেয়। এ নাট্যসংগীতের এমন একটা নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আছে যে, সাধারণ মানুষ সহজেই এর প্রতি আকৃষ্ট হয়।
সে সময়ের গম্ভীরা আর বর্তমানের গম্ভীরার মধ্যে একটু প্রভেদ তৈরি হয়েছে। পূর্বে গম্ভীরার নানা ছিলেন বিজ্ঞজন। জগৎ সংসারে অভিজ্ঞ মানুষ। আর নাতি ছিলেন অল্পবয়স্ক, জগৎ সংসার সম্পর্কে অনভিজ্ঞ। নাতি উল্টা-পাল্টা কথা বলত আর নানা সবকিছু নাতিকে বুঝিয়ে দিত। বর্তমানে তার উল্টো হয়ে গেছে। নানা আদিকালের মানুষ। আধুনিক বিষয়-আশয় সম্পর্কে তাঁর ধারণা খুবই কম। নাতি আধুনিক সময়ের মানুষ, সে সবকিছু জানে। তাই এখন নানা উল্টা-পল্টা কথা বলে আর নাতি সবকিছু নানাকে বুঝিয়ে দেয়।
জনপ্রিয় এ সংস্কৃতির সাথে চাঁপাইনবাবগঞ্জের প্রায় প্রতিটি সংস্কৃতিবান মানুষ জড়িত। হাজার বছরের এ ঐতিহ্য সবার রক্তে মিশে আছে। বর্তমানে ছাত্র, যুবক থেকে শুরু করে প্রবীণ এবং প্রৌড়রাও গম্ভীরা করে আসছে। বর্তমানে গম্ভীরা মূলত সরকারি সচেতনতা প্রচারে; মাদকের বিরুদ্ধে সচেতন করে তোলার জন্য, যুবসমাজকে বা তরুণ সমাজকে বোঝানোর জন্য, বাল্যবিয়ের কুফল সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করার জন্য, দেশের বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা, রাষ্ট্রীয় ঘোষণা জনগণকে জানানো এবং বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করার জন্যও পরিবেশন করা হয়। অর্থাৎ গম্ভীরা সমাজ সচেতনতার হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে।
গম্ভীরায় নানা আর নাতিই মুখ্য চরিত্র। এছাড়াও সহযোগী শিল্পী থাকেন ৬ থেকে ৭ জন। দোহার বা সহকারী গায়ক, হারমোনিয়াম বাদক, তবলা বাদক, জুড়ি বাদক, ঠুনঠুনি বাদকও দেখা যায় গম্ভীরা গানগুলোতে। হারমোনিয়াম, তবলা ও জুড়ি বাদকেরাও দোহার হিসেবে কণ্ঠ দিয়ে থাকেন। মাঝে মাঝে দোহাররা নাতির প্রশ্নের উত্তরও দিয়ে থাকেন।
গম্ভীরার পোশাক চিরকালীন গ্রামবাংলার পোশাক। গ্রামবাংলায় সাধারণ বৃদ্ধরা খালি গায়ে থাকে লুঙ্গি পরে থাকে, আর জোয়ানরা স্যান্ডোগেঞ্জি ও লুঙ্গি। গম্ভীরাতেও নানা খালি গায়ে লুঙ্গি পরে থাকে। হাতে থাকে ছোট লাঠি। যেটা গরু বা ছাগল চরানোর কাজে লাগে। আর নাতি থাকে লুঙ্গি আর ছেঁড়া স্যান্ডোগেঞ্জি পরে। দোহার, তবলা বাদকরা সাধারণত রঙিন পাঞ্জাবি পরে আর সাদা পায়জামা পরে। দোহার বা বাদকদের নির্ধারিত কোনো পোশাক নেই। নানা-নাতির আছে। তবে বর্তমানে গম্ভীরাতে প্রায়ই নাতিকে থ্রি-কোয়ার্টার প্যান্ট পরতে দেখা যায়। নানা মূলত বয়স্ক ব্যক্তি হয়ে থাকে; পঞ্চাশোর্ধ, চুল দাড়ি পাকা। অন্যদিকে নাতি সদ্য যুবক।
গম্ভীরার আধুনিক সংস্করণের জনক মোহাম্মদ সফিউর রহমান ওরফে শেখ সফিউর রহমান ওরফে সূফি মাস্টারের জন্ম ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে অবিভক্ত ভারতের মালদহ জেলার ইংরেজবাজার থানার ফুলবাড়ী গ্রামে। সূফি মাস্টার মালদহ জিলা স্কুলে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। নানা সমস্যার কারণে পড়াশোনা ত্যাগ করেন, তারপর যোগ দেন ডাক বিভাগের পোস্টম্যান পদে। চাকরির পাশাপাশি তিনি সংগীত চর্চা অব্যাহত রাখেন।
সূফি মাস্টার ছিলেন স্বভাবকবি। প্রথমে তিনি পালা গান, নিমাই সন্ন্যাস, রাধার মানভঞ্জন ইত্যাদি রচনা করেছেন। একসময় তিনি মালদহের খ্যাতনামা আলকাপ সরকার আকবর খলিফার আলকাপ দলে যোগ দেন। পরবর্তীতে যোগ দেন কিশোরী মোহন চৌধুরী ওরফে কিশোরী প-িতের গম্ভীরা দলে। শেষে তিনি নিজেই গম্ভীরা দল গঠন করেন। দেশ বিভাগ পূর্বকালে তাঁর পালা গম্ভীরা গানের প্রতিটি চরিত্র ছিল ব্রিটিশবিরোধী। তাঁর গম্ভীরা গানে স্বাধীনতা সংগ্রামের চেতনা লক্ষ্য করে ব্রিটিশ সরকার সূফি মাস্টারের মাথার জন্য এক হাজার টাকা পুরষ্কার ঘোষণা করেছিল।
গম্ভীরা গানের অন্যতম রূপকার সৈয়দ সোলেমান ওরফে মোহাম্মদ সোলেমান ওরফে সোলেমান ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দের ১৮ মার্চ অবিভক্ত ভারতের মালদহ জেলার পুরাতন মালদার (ওল্ড মালদা) জন্মগ্রহণ করেন। সোলেমান পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত অধ্যয়ন করেন। পেশায় ছিলেন চিকিৎসক। প্রথমে ইংরেজবাজারের পুড়াটুলিতে হাজী ডাক্তারের ডাক্তারখানায় হাতেখড়ি। এই ডাক্তারখানায় অ্যালোপ্যাথি ও হোমিওপ্যাথি উভয় ওষুধই দেয়া হতো। ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) চাঁপাইনবাবগঞ্জ মহকুমা শহরে চলে আসেন। সোলেমান ডাক্তার একজন স্বভাবকবি ছিলেন। তিনি প্রায় সহস্রাধিক গম্ভীরা গান রচনা করেছেন।
এছাড়াও সে সময় গম্ভীরা চর্চা করতেন বাবু বীরেন ঘোষ, চাঁপাইনবাবগঞ্জের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বীরেন ঘোষ নামে পরিচিত। তাঁকে লোকসংগীতের কিংবদন্তি এজন্যই বলা হয় যে, তাঁর সাংস্কৃতিক অঙ্গনের হাতেখড়ি আলকাপ গান দিয়েই। আলকাপ গানের ছোকরা হিসেবে তাঁর প্রথম আবির্ভাব হয়। পরবর্তীতে কুতুবুল আলম আর রকিবুদ্দীনের সাথে নাটোরের গণভবনে বঙ্গবন্ধুকে শোনানোর জন্য যে গম্ভীরা দল যায়, সে দলের হারমোনিয়াম বাদক ছিলেন বীরেন ঘোষ। এরপরই মূলত বীরেন ঘোষ গম্ভীরার দলের সাথে যোগ দেন। তিনি বেশ কয়েকটি সুরে গম্ভীরা করতে পারতেন। বর্তমানে সেসব সুর হারিয়ে গেছে, মাত্র একটি বা দুটো সুরে বর্তমানে গম্ভীরা গাওয়া হয়। কিন্তু বীরেন ঘোষ সাত থেকে আট রকমের সুরে গম্ভীরা পরিবেশন করতেন।
বর্তমানে যাঁরা গম্ভীরা চর্চায় খ্যাতি লাভ করেছেন তাঁদের মধ্যে মাহবুবুল আলম; যিনি রকিবুদ্দীনের সাথে কুতুবুল আলম মারা যাওয়ার পর নানা হিসেবে অভিনয় শুরু করেন। ফাইজুর রহমান মানি; বীরেন ঘোষ মারা যাওয়ার পর মাহবুবুল আলমের সাথে জুটি বেঁধে গম্ভীরা করছেন। এছাড়া আরো অনেকেই খ্যাতি লাভ করেছেন। বলা যায়, চাঁপাইনবাবগঞ্জের প্রায় প্রতিটি সংস্কৃতিবান মানুষই গম্ভীরা পারেন এবং চর্চা করেন।
পুরো বাংলাদেশের মধ্যে বরেন্দ্র অঞ্চলের লোকজন আসলেই অনেক পুরোনো। এ এলাকা আসলে ‘লোক’ অর্থাৎ সাধারণ মানুষ নিয়েই গঠিত। আর এই লোকদের রয়েছে নানান শিল্প ও সংস্কৃতি। একেক অঞ্চলে রয়েছে একেক লোকশিল্প। আবার এলাকাভেদে একই শিল্পের রয়েছে ভিন্নতার কিছু ছাপ; রয়েছে সে অঞ্চলের নিজস্ব স্বকীয়তা। চাঁপাইনবাবগঞ্জের আদি অধিবাসী মূলত ইন্দো-মঙ্গলয়েড গোষ্ঠীভুক্ত। এদের মধ্যে ‘বাৎসরিক অধিবেশন’ উপলক্ষে সংগীত ও নৃত্য প্রচলিত ছিল। এ সংগীত কিন্তু বর্তমান সময়ের মতো সংগীতকে বোঝায় না। এ সংগীত মূলত পালাগান; কবিগান। আলকাপের উৎপত্তি কোথায় এটা নিয়ে গবেষক বা প-িতদের মধ্যে তেমন একটা মতপার্থক্য দেখা যায় না। যেটুকু মতপার্থক্য আছে তা হচ্ছেÑ আলকাপ এসেছে গম্ভীরা থেকে, কেউ বলছেন আলকাপ এসেছে সত্যপীরের গান ও মনসার ভাসান থেকে। তবে খেউড় গানের সাথে আলকাপের কিছুটা মিল লক্ষ করা যায়। আবার কেউ মনে করেন আলকাপের সাথে রাঢ় অঞ্চলের ঝুমুর গানের সাদৃশ্য আছে। সেহেতু ঝুমুর গান থেকেই আলকাপের জন্ম।
আলকাপ আসলে নিখাদ একটা পালাগান। এটি মূলত কবিগানেরই একটা সংস্করণ। ‘পালা’ করে যখন একেকজন গান গায় তখন তাকে পালাগান বলে। ‘পালা’ মানে একজনের বলার অধিকার। অর্থাৎ একজনের যখন বলা শেষ হলো, তখন আরেকজনের পালা। মানে তখন সে বলবে। এই পালাগান অতিপ্রাচীন একটা সংস্কৃতি। আলকাপের বর্তমান আঙ্গিক পরিবেশন রীতি দেখে মনে হয় না যে, এ সংস্কৃতি না এসেছে সত্যপীরের গান থেকে, না এসেছে মনসার ভাসান থেকে, না এসেছে খেউড় গান গান থেকে, না এসেছে রাঢ়ের ঝুমুর গান থেকে, না এসেছে গম্ভীরা গান থেকে।
অনেকে আবার উল্টো করে বলেন যে, গম্ভীরা সৃষ্টি হয়েছে আলকাপ থেকে। আসলে উত্তরাঞ্চলের প্রাচীন সংস্কৃতি কবিগান। পালাগান সৃষ্টি হয় মূলত বিতর্ক করার উদ্দেশ্য থেকেই। কোনো কবি মঞ্চে উঠে কোনো বিষয় সম্পর্কে তাঁর মতামত সুরে সুরে বলে ফেললেন। কিন্তু যে কবি বসে আছেন, তিনি সেই মঞ্চের কবির মতামতকে মানতে রাজি নন। মঞ্চের কবি তাকে আমন্ত্রণ জানান ছন্দে ছন্দে বিতর্ক করতে। তিনিও তখন তার বিপরীত মত প্রদান করতে মঞ্চে উঠে কবিতার ছন্দে বলা শুরু করেন। শুরু হয় তর্ক বিতর্ক। রাত যত গভীর হয় বিতর্ক তত জমে উঠে। রাত শেষ হয়, কিন্তু বিতর্ক শেষ হয় না। দুই কবিই ক্লান্ত, আর পারছেন না, শরীরে কুলোচ্ছে না। দুজন দুজনকে সম্মান জানিয়ে পরস্পরের মতকে স্বীকার করে বিতর্ক শেষ করলেন।
আমরা এখনকার ছবি দেখলাম? পালাগান? নাকি আলকাপ গান? আসলে আলকাপ গান আমাদের সেই অতি সুপ্রাচীন লোকসংস্কৃতি পালাগান থেকেই উদ্ভূত। এটা কারো কাছ থেকে ধার করা বা কারো অনুকরণ করে না। পালাগান থেকে আলকাপের পার্থক্য এটুকুই, পালাগানে ‘ক্যাঁইপ্যা’ নামে চরিত্র থাকে না। ‘ক্যাঁইপ্যা’ মূলত পালাগান থেকে আলকাপকে ভিন্ন বা আলাদা করেছে। দীর্ঘক্ষণ ধরে মানুষ কবিগান শুনতে শুনতে যেন বিরক্ত না হয়ে যায় বা পালাগানে একঘেঁয়েমি না আসে সেজন্য মানুষকে আনন্দ দেওয়ার জন্য সং সেজে একটুক্ষণের জন্য কৌতুক অভিনয় করে ‘ক্যাঁইপ্যা’। আরেকটু পার্থক্য আছে, আলকাপের সময় কবিরা একটু অভিনয়ও করেন আকর্ষণীয় করার জন্য। অর্থাৎ নাটকের কিছুটা সংস্পর্শ আছে। অর্থাৎ আলকাপকে নাট্যগীতি বা নাট্যপালাও বলা যায়।
আলকাপে আনন্দের মাঝে পল্লী জীবনের বাস্তব প্রতিচ্ছবি তুলে ধরা হয়। মূলত আলকাপ গানের আসল লক্ষ্য এটি থাকে। সভ্য সমাজের যা লজ্জার, যা গোপন করে রাখতে হয়, বা যা বলা যায় না সমাজের ভয়ে, প্রশাসনের ভয়ে; আলকাপ গান তাতে একটু উইট মিশিয়ে অভিনয় আর গানের মাধ্যমে পরিবেশন করে। মানুষকে জানানোও হলো, আবার সম্মান বা সমাজও রক্ষা হলো। প্রশাসনের রক্তচক্ষু থেকেও রক্ষা পাওয়া গেল। একসময় পূজাপার্বণে, নবান্নে, অন্নপ্রাশনে, বিয়ের অনুষ্ঠানে এবং অবসরে সৌখিন পরিবারে আলকাপ গান পরিবেশিত হতো। আলকাপ মূলত নাচ, গানের মূর্ছনায় হাস্যরসাত্মক বাক্য বিনিময় ও কৌতুকের মাধ্যমে দুটি দলের প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশনা। ধর্ম-অধর্ম, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, নারী-পুরুষ প্রভৃতি বিষয়-আশয় নিয়ে আলকাপ গান পরিবেশন করা হয়। দুই দলের মধ্যে নিজেদের নির্ধারিত বিষয়ে অবতীর্ণ হয়ে বিজয়ী হওয়ার জন্য দিন-রাত পর্যায়ক্রমিকভাবে পাল্টা-পাল্টি গান ও অভিনয়ের মাধ্যমে সওয়াল জওয়াব করে থাকে। একসময় দুই দলই তাদের মতামতকে প্রাধান্য দেওয়া বাদ দিয়ে দুই মতামতকেই স্বীকার করে নেয়। ফলে তাদের মধ্যে সৌহার্দ্য ও সমতার মনোভাব দেখা দেয়। আর তখনই উভয় দলের গানের প্রতিদ্বন্দ্বিতারও শেষ হয়।
আলকাপ দলের প্রধান, গায়ক এবং গীতিকারকে ‘সরকার’ বলে। অর্থাৎ যে কবি বিতর্ক করে বা গান গায় সেই সরকার; দলের প্রধান। সেই সরকারই গান রচনা করে, অভিনয়শৈলী বুঝিয়ে দেয়, প্রতিদ্বন্দ্বীমূলক কথাবার্তা কিভাবে করতে হয় তাও বুঝিয়ে দেয়। অর্থাৎ সরকারের সঠিক নির্দেশনাতেই দলের আসর জমে ওঠে। দুই দলের সংলাপ মূলত পূর্ব লিখিত নয়। তৎক্ষণাৎ বুদ্ধি খাটিয়ে ছুঁড়ে দেওয়া প্রশ্নের উত্তর দিয়ে সংলাপ বানাতে হয়।
আলকাপ নিয়ে যতটুকু তথ্য, তাতে বলা যায়, বর্তমানে যে রূপে আলকাপ দেখা যাচ্ছে তা মূলত সৃষ্টি বা বিকাশ হয় উনিশ শতকের শেষ এবং বিশ শতকের শুরুর সময়ে। বর্তমানে আলকাপ গানকে যে ফরমে দেখা যায়, তার পুরাতন দিনের শিল্পী ও লেখক জামুরুদ্দিন বিশ্বাস (১৮৫৭-১৯৫২)। তিনি মূলত আলকাপ গানের সরকার ছিলেন। তিনি মুখে মুখেই গান রচনা করতে পারতেন। আলকাপের প্রয়োজনে অসংখ্য গান তিনি রচনা করেছেন। তার গানগুলো বর্তমান প্রজন্মের আলকাপ শিল্পীদের মুখে মুখে আছে। বোনাকানাকেও অবশ্য বর্তমান ফরমের প্রথম শিল্পী মনে করেন অনেক গবেষক। তবে বোনাকানার আলকাপে প্রাচীন রূপও বর্তমান। সেদিক থেকে জামুরুদ্দিন বিশ^াসই আধুনিক আলকাপের প্রথম রচয়িতা। তবে জামুরুদ্দিন বোনাকানার আলকাপকেই কিছুটা পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করেন। সেদিক থেকে বোনাকানাকেও আধুনিক আলকাপের প্রথম সরকার বলে অনেক গবেষক মনে করেন।
বিশ শতকের শুরুর সময়ের বিখ্যাত সরকার সুবল কানার একটি আলকাপ গানে সে সময়ের বেশ কিছু সরকারের নাম পাওয়া যায়। যেমনÑ বোনাকানা, সুবেদার আলী, ঝাঁকসু, জগু সরকার, জাগিরুদ্দিন, মকবুল হোসেন, সুধীরচন্দ্র, সিরাজ মাস্টার, মোজাম্মেল, নৈমুদ্দিন, মানকির আলী, বরকত আলী প্রভৃতি। এ গানটি সংগ্রহ করেন গবেষক সৈয়দ খালেদ নোমানÑ
প্রথমে মোনাকষার বোনাকানা / আলকাপ গান করেন রচনা। / তারপরেতে সুবেদার আলী ভাই / বাড়ি তার মালদহেতে হয়। / তারপরেতে ঝাঁকসু সরকার নামটি শুনি / তার জঙ্গীপুরে বাড়ি জানি / আলকাপে সে বিখ্যাত রে ভাই। / জাগিরুদ্দিন যাহার নাম / তার নুরপুরেতে হয় গো ধাম। / ঝাঁকসু জগু একসঙ্গেতে গায়॥ / তারপর মকবুল হোসেন নামটি শুনি / তার রাজমহলে বাড়ি জানি। / সেই কিন্তু মন্দ নয় রে ভাই / সুধীরচন্দ্র যাহার নাম / তার সাগরদীঘি হয়গো ধাম / সিরাজ মাস্টার তাকে রেখেছিল ভাই / মোজাম্মেল নৈমুদ্দিন শুনি / তারা দুজননাতে বন্ধু জানি। / তাদের দলটিও মন্দ নয় রে ভাই॥ / মানকির আলী নামটি শুনি / তার গোবিন্দপুর বাড়ি জানি / বরকত আলী তার পাশেতে রয়। / কার বা কত করবা নাম / এবার শুনেন সুবল কানার গান / এই বলে ভাই / আমি দশের কাছে প্রণাম জানাই।
প্রাচীন এই আলকাপ গান থেকে অনুমান করা যায়, সে সময় আলকাপ গানের বেশ প্রচলন ছিল এবং এ নিয়ে বেশ ভালোই প্রতিযোগিতা হতো। জনপ্রিয়ও ছিল তা সহজেই অনুমেয়। তৎকালীন মালদহ জেলাব্যাপী যে আলকাপ ছড়িয়ে ছিল এ গানটি তারও একটি বড় প্রমাণ। শুধু মালদহ জেলাই নয়, পুরো বাংলাজুড়ে ব্যাপক জনপ্রিয় ছিল আলকাপ পালা।
লোককবি জামুরুদ্দিন বিশ্বাস আলকাপ গানের পুরাতন দিনের শিল্পী ও দর্শক-শ্রোতাদের কাছে অতিপরিচিত নাম। তিনি ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন মালদহ জেলার চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের অদূরে রাজারামপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মরহুম আইনুদ্দিন বিশ্বাস। জামুরুদ্দিন বিশ্বাসের শিক্ষাগত যোগ্যতা ম্যাট্রিকুলেশন। তিনি ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দে আলকাপ দল গঠন করেন। তিনি মুখে মুখে গান রচনা করতেন, সুর দিতেন এবং গাইতেন। তাঁর দলে শিল্পীরা কেউ বেঁচে নেই। এই খ্যাতিমান শিল্পী ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে ইন্তেকাল করেন।
মহবুব ইলিয়াস সরকার ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন মালদহ জেলার নবাবগঞ্জ থানার নামোশংকরবাটী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মরহুম মোহাম্মদ আলী বিশ্বাস। ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে তিনি আলকাপ দল গঠন করেন এবং রাজশাহী জেলার নওগাঁ, নাটোর ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে বিভিন্ন স্থানে আলকাপ গান পরিবেশন করে খ্যাতি অর্জন করেন। আলকাপ প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয়ে তিনি বহু কাপ, মেডেল ও সার্টিফিকেট লাভ করেন।
মেয়েলি গীত চাঁপাইনবাবগঞ্জের লোকসংগীতের একটি উল্লে¬খযোগ্য ধারা। নারীসমাজের আনন্দ-বেদনা, হাসি-কান্না, কামনা-বাসনার বিচিত্র উপাদানের আকর মেয়েলি গীতের ভাব সম্পদ। প্রকৃতপক্ষে মেয়েলি গীত মেয়েদের জীবনবেদ স্বরূপ। চাঁপাইনবাবগঞ্জ মেয়েলি গীতে সমৃদ্ধ। এখানকার পালা পার্বণে অনুষ্ঠানে যেমনÑ আকিকা, মুসলমানি ও বৈবাহিক উৎসবে মেয়েলি গীতের ভূমিকা মুখ্য ছিল একসময়। সময় পাল্টেছে। আধুনিক গানবাজনার চাপে পড়ে এখন মেয়েলি গীত প্রায় হারাতে বসেছে। তবে হঠাৎ করে যদি কোনো অনুষ্ঠানে মেয়েলি গীত গেয়ে ওঠে কোনো মেয়ে, আমরা অবাক হই না। তবে বর্তমান প্রজন্ম অবাকই হয় বৈকি! বাঙালি সমাজ নিরীক্ষণে চাঁপাইনবাবগঞ্জের মেয়েলি গীতের গুরুত্ব অপরিসীম।
মেয়েলি গীত সাধারণত কয়েকজন মেয়ে একসাথে বসে সুর করে গেয়ে ওঠে। কখনো কখনো একজন প্রধান গায়ক থাকে আর বাকিরা ধুয়া ধরে, আবার কখনো একসাথে কোরাস আকারে সবাই মিলে একসাথে গেয়ে ওঠে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের লোকনাট্যের এক বিশিষ্ট ধারা কবিগান। এ গান কোনো জনপ্রিয় ঘটনা, পৌরাণিক প্রসিদ্ধ কাহিনী এবং ধর্মীয় বিষয়বস্তু নিয়ে তাৎক্ষণিক সৃষ্টি হয়। বাক্যবিন্যাস, যথার্থ শব্দ প্রয়োগ, উপস্থিত বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তি বা ব্যক্তিরাই এ গানের ¯্রষ্টা। চাঁপাইনবাবগঞ্জের কবিদলের চারণভূমি পলশা। এখানে বিভিন্ন সময় বহু কবিদল ও কবিয়াল বসবাস করে আসছেন। যাঁরা এ জেলায় কবিগান গেয়ে খ্যাতি অর্জন করেছেন তাঁরা হলেনÑ চাঁপাই পলশা গ্রামের আ. সালাম কেরামত ও নসিপুরের সঞ্জয় কুমার। তবে বর্তমানে আর কবিগান দেখা যায় না।
ঠিক তেমনি আরেকটি প্রায় হারিয়ে যাওয়া সংস্কৃতি পুঁথিপাঠ। এ অঞ্চলে পুঁথিপাঠের প্রচলন সুদীর্ঘকালের। কোনো কাহিনী বা বিষয়কে অবলম্বন করে বিশেষ ছন্দে লিখিত এই পুঁথি সুর করে একটু দুলে দুলে পড়া হয়। যাতে করে শরীরে ও মনে ছন্দ আসে। প্রচুর ফারসি-উর্দু-হিন্দি শব্দের মিশ্রণ থাকায় এই পুঁথিকে দোভাষী পুঁথিও বলা হয়। সাধারণত এ পুঁথিগুলো পয়ার ও ত্রিপদী ছন্দে রচিত। কখনো থামক, তোটক ও চৌপদীও ব্যবহার করা হয়। এতে প্রথমে হামদ ও পরে নাত দিয়ে শুরু করা হয়। একসময় চাঁপাইনবাবগঞ্জে সন্ধ্যার পর মাটির প্রদীপ জ্বালিয়ে আসর করে পুঁথিপাঠের দৃশ্য এ অঞ্চলে লোকজনের অন্যতম উপাদান ছিল। তাছাড়া এ অঞ্চলে গয়নার নাওয়ে যাত্রীদের চলার পথে মনোরঞ্জনের জন্যও পুঁথিপাঠের প্রচলন ছিল। তবে গয়নার বিলুপ্তির সঙ্গে সঙ্গে এ ধারারও বিলুপ্তি ঘটে। ইউসুফ-জুলেখা, রহিম বাদশা-রূপবান কন্যা, গাজী-কালু-চম্পাবতী, সোনাভান, জঙ্গনামা, আমি হামজা, কাছাছুল আম্বিয়া, হাকীকাতুল আম্বিয়া, ফয়ছাল আহকাম, জিকরনামা প্রভৃতি পুঁথিপাঠের প্রচলন ছিল এ অঞ্চলে। এই অঞ্চলে অতীতে পুঁথিপাঠের ব্যাপক প্রচলন থাকলেও বর্তমানে নেই বললেই চলে।
আমাদের আরেকটি সমৃদ্ধ ঐতিহ্য রয়েছে সেটি আর্ট বা শিল্প। এই দিক থেকে পোড়ামাটির শিল্প যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে ক্যানভাসে তেলচিত্র বা পেন্সিল স্কেচ বা রঙচিত্র। এদিক থেকে আমাদের ঐতিহ্য বেশ সমৃদ্ধ। বহু আগে থেকেই মাটির তৈজসপত্রে এ চিত্র আঁকার প্রবণতা দেখো গেছে এ অঞ্চলের মানুষের। তারই ধারাবাহিতকতায় ঝড়ু পাল বা রফিকুন্নবীর কথা বলতে হয় সর্বাগ্রে। রফিকুন্নবী আমাদের জেলার গর্ব। তিনি আন্তর্জাতিক শিল্পী বর্তমানে। এবং তিনি আন্তর্জাতিক সম্মাননাও পেয়েছেন। এছাড়া তরুণ শিল্পী মামুনার রশীদ পোড়া মাটির শিল্প দিয়ে দেশ ও বিদেশে যথেষ্ট সুনাম কুড়িয়েছেন। আরেক কৃতী শিল্পী আল্পতগীন তুষার। যিনি বর্তমানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ডিন হিসেবে কর্মরত আছেন।
লেখক ও গবেষক এবং ইন্সট্রাক্টর, বাংলা বিভাগ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ সরকারি টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ