Last Updated on নভেম্বর ৩০, ২০২৪ by
আবদুল্লাহ সাহেদের রম্য রচনা : ধুপ্পি খাওয়ার ধুপধাপ কাহিনী
চাঁপাইনবাবগঞ্জের শীতকাল মানেই ধুপ্পি পিঠার (এক ধরনের ভাপা পিঠা) মৌসুম। শহর থেকে গ্রাম, ধনী থেকে গরিবÑ সব বাড়িতে শীতের সকালে ধুপ্পি তৈরির ধুম পড়ে। পিঠা নয়, যেন একটা আঞ্চলিক উৎসব। তবে আমার জীবনে এই উৎসবের অংশগ্রহণটা বেশ বাধ্যতামূলক। কারণ ধুপ্পি আমার খুব একটা প্রিয় নয়। হ্যাঁ, এটা শুনলে হয়তো অনেকেরই গা জ্বলে উঠবে, বিশেষ করে আমার স্ত্রীর। তার চোখে, চাঁপাইনবাবগঞ্জে জন্ম হয়ে ধুপ্পি না পছন্দ করার মানে হলো ‘জাতীয় বেইমানি’। আর তাই, ভালো লাগুক বা না লাগুক, শীতকাল এলেই আমাকে ধুপ্পির প্রতি ভালোবাসা দেখানোর অভিনয়ে নামতে হয়।
ধুপ্পি বানানো নিয়ে বাড়ির সকালের পরিবেশটা বর্ণনা করলে হয়তো হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে যাবে। শীতের সকালে ঘুম থেকে উঠতেই শুনি রান্নাঘরে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। মা বাসনে ধুপধাপ আওয়াজ তুলছেন, বড় ভাবি খেজুর গুড় কাটছে আর বড়ভাই চুলায় আগুন ধরানোর ব্যর্থ চেষ্টা করছেন। আমি তখনো চাদর মুড়ি দিয়ে বিছানায় পিঠ ঠেকিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছি। কিন্তু স্ত্রী কখনো সেই সুখ সহ্য করেন না। বিছানার পাশে এসে এমনভাবে দাঁড়ান! দাঁড়িয়ে এমনভাবে তাকান, মনে হয় আমি কোনো রাষ্ট্রদ্রোহী, আর ধুপ্পি না খেলে চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাগরিকত্ব হারাব। তার চোখের চাহনি আর ঠোঁটের কোণে সেই শীতল হাসি দেখে আমি বুঝতে পারি, ধুপ্পি উৎসবে আমার উপস্থিতি বাধ্যতামূলক।
রান্নাঘরে ঢুকে দেখি, সবাই যার যার কাজে ব্যস্ত। মা চালের গুঁড়া ধুপ্পি বানানোর উপযোগী করছেন। বড় ভাবি গুড় আর নারিকেল কুরছে। আর বড়ভাই চুলার আগুন নিয়ে গবেষণায় ব্যস্ত। আমার দিকে তাকিয়ে স্ত্রী বলে উঠলেন, “তুমি কি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শীত উপভোগ করবে, নাকি কিছু করতে আসছ?” আমি মনে মনে বললাম, আমাকে দিয়ে এই সব কাজ করানোর চেয়ে কষ্টের কিছু আর হতে পারে না। কিন্তু বাস্তবে ঠোঁটের কোণে একটা মিষ্টি হাসি ঝুলিয়ে বললাম, “তাহলে কী করব বলো?”
আমার কাজ শুরু হলো ধুপ্পির পাত্রগুলোকে ভাপে বসানোর জন্য রেডি করে দেওয়া। কিন্তু সমস্যা হলো, আমি কিছু করলেই সেটা ভুল হয়। একবার ধুপ্পি বসানোর সময় হাত কাঁপিয়ে গুড়ের গোলা ঢেলে দিলাম চুলায়। বড়ভাই সঙ্গে সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠলেন, “আগুন নিমিহ্যা দিলি নাকি হে? ধুপ্পি সেঁকব কী দিয়্যা?” আর পাশে দাঁড়িয়ে মা বললেন, “ওকে দিয়ে রান্নাঘরের কাজ হয় না, ওকে পাঠাও বাজারে।” এদিকে, স্ত্রী চুপ করে দাঁড়িয়ে হাসছিলেন। তার হাসির মানে আমি ভালোভাবেই বুঝি। সে মনে মনে বলে, তোমার বোকামির শাস্তি এখন উপভোগ করো হে প্রিয়তম!
ধুপ্পি যখন সেঁকতে শুরু করল, তখন রান্নাঘর ধোঁয়ায় ভরে গেল। সেই ধোঁয়ার মধ্যে আমার একটাই দায়িত্ব, গরম ধুপ্পি মুখে দেওয়া। কিন্তু সেটাও সহজ নয়। মা বলে উঠলেন, “ধুপ্পি ঠা-া হতে দাও, না হলে গলা পুড়ে যাবে।” স্ত্রী তো আরো এক ধাপ এগিয়ে বলল, “তুমি আগে অপেক্ষা করো, তোমার চেয়ে বড়দের খাওয়া শেষ হলে তারপর তুমি খেও।” এর মধ্যেই ছোট ভাইস্তা আরিয়ান আমার চোখের সামনে থেকে ধুপ্পি তুলে দৌড় দিল।
ধুপ্পি খাওয়ার সময় সবাই মিলে যে মজার হাসিঠাট্টা চলে, তা বললে বুঝবেন কেন চাঁপাইনবাবগঞ্জে শীতকাল এত আনন্দময়।
একবারের গল্প বলি। বড় ভাবি যখন ধুপ্পি বানাতে গিয়ে বেশি খেজুর গুড় দিয়ে ফেললেন, তখন বড়ভাই বললেন, “গুড় দিয়া তুমি কি ধুপ্পি বানাইছো, নাকি আন্ধাসা (তেলপিঠা)?” আর বড় ভাস্তি নুসাইবা তৎক্ষণাৎ বলে উঠল, “আব্বু, এই ধুপ্পি খেলে শীতে তোমার আর গরম কাপড় লাগবে না!”
আমার ধুপ্পির প্রতি মিশ্র অনুভূতি আসলে পুরোপুরি বদলে গেল একদিনের এক ঘটনায়। সেই দিন আমার স্ত্রী পিঠা বানাতে গিয়ে নতুন কিছু চেষ্টা করলেন। ধুপ্পি বানাতে গিয়ে খেজুর গুড়ের বদলে আখের গুড় ব্যবহার করলেন। আমি মুখে এক কামড় দিতেই চমকে বললাম, “এটা কী? খেজুর গুড়ের বদলে মনে হচ্ছে কাঁচা চিনি খাচ্ছি!” স্ত্রী সঙ্গে সঙ্গে বলল, “তোমার জন্যই তো এই অবস্থা। খেজুর গুড় আনতে বলেছিলাম, তুমি আনোনি। এখন খাও আর চুপ করো।” আমার মুখ চুপ হয়ে গেলেও মনে মনে হাসি থামল না। ভাবলাম, বিয়ে হলো জীবনের সবচেয়ে বড় ধুপ্পি, যেটা মিষ্টি বা কম মিষ্টি অথবা টক-ঝাল যাই হোক না কেন, খেতেই হয়।
সত্যি বলতে, ধুপ্পি চাঁপাইনবাবগঞ্জের শীতকালীন সংস্কৃতির একটা অংশ। এটা শুধু খাবার নয়, বরং একসঙ্গে বসে সময় কাটানোর অজুহাত। আমাদের জীবন যত আধুনিকই হোক, এই ধুপ্পি খাওয়ার মিষ্টি স্মৃতিগুলো কিন্তু একদিন আমাদের জীবনের সব মিষ্টতা নিয়ে আসবে। আর স্ত্রী যখন পেছনে দাঁড়িয়ে বলবে, ‘ধুপ্পি খাও, নয়তো চা পাবে না,’ তখন মনে হবে ধুপ্পি আমার অপছন্দের নয়, বরং আমার জীবনের এক মিষ্টি বাস্তবতা।
ধুপ্পির প্রতি আমার এত ভালোবাসার গল্প শুনলে চাঁপাইনবাবগঞ্জের কেউই আমাকে ভর্ৎসনা করবে না। বরং তারা বলবে, ‘ওস্তাদ, তোমার ধুপ্পি খাওয়ার গল্প তো দেখি গল্পের বইতে ছাপানোর মতো!’ আর আমিও মাথা নিচু করে বলব, ‘হ্যাঁ, ধুপ্পি এখন শুধু পিঠা নয়, বরং আমার শীতকালীন জীবনের এক মিষ্টি অধ্যায়।’
আবদুল্লাহ সাহেদ : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট