অব্যক্ত অনুভূতি

385

মোহাঃ জোনাব আলী
ছোট্র মেয়েটি, নাম তার পলি। বয়স পাঁচ কি ছয়। কথা বলতে শেখা অবধি খুবই চটপটে। যাকে-তাকে যেটা-সেটা প্রশ্ন করে বসে। যেন ষাট বছরের বুড়ি। তার সাথে কথা বলতে গিয়ে সবাই হেরে যায়। সময়-সময় এমন উদ্ভট প্রশ্ন করে বসে-যার উত্তরই হয়তো মিলেনা।
যেমন ঃ আকাশটা নীল কেন? পাখিরা কেমন করে উড়ে? আমরা কি উড়তে পারিনা? বাস কে তৈরি করেছেন? ইত্যাদি-ইত্যাদি। উত্তরের সময় না দিয়েই আবার প্রশ্ন। ওর ইঁচড়ে পাকা কথার উত্তর দিতে-দিতে ওর মা-বাবা রেগে গিয়ে ধমক দিয়ে বসেন। আর কি! বাবার শার্ট-প্যান্ট, মার শাড়ী টানাটানি। তারপর ঘরে যা পায়, তাই বাইরে নিয়ে আঙ্গিনায় ছড়িয়ে ফেলে। যতক্ষণ ক্লান্ত না হয়, ততক্ষণ ছাড়াছাড়ি নেই।
বাড়ির পাশে একটি আমের বাগান। বাগানের দু’টি গাছের ফাঁকে দুব্বা ঘাসের উপরে একদিন একাকী নীরবে বসে কি যেন ভাবছিলাম। পিছন দিক থেকে এসে বলল – ভাইয়া, অমন করে কি দেখছ? ওর দাম্ভিকতার কথা মনে করে অপ্রস্তুত অবস্থাতেই বললাম-কিছু দেখিনি। তুই আমার এখানে এলি কেন, যা বাড়ি যা।
-যাবনা, এখানে বসবো।
-বস, কথা বলিসনা।
-বা..রে কথা বলবো না তো বসবো কেন?
একটু রেগেই বললাম-বল তোর যা ইচ্ছে তাই বল।
-আচ্ছা তুমি রোজ এভাবে বসে কি ভাবো?
-ঘোড়ার ডিম।
-ঘোড়ার ডিম দেখতে কেমন?
-তোর মতন।
-ইস ঘোড়ার ডিম কখনো মানুষের মত হয়?
-তুই বল কিসের মত হয়?
-তোমার মত হয়।
-আমার মত, আমি কি মানুষ নই?
-তুমি যে ঘোড়ার ডিম ভাব, তাই ঘোড়ার ডিম তোমার মতন।
ওর কথায় আমি অতিষ্ঠ হয়ে যায়। কিন্তু উঠে যেতে পারিনা। তাই বুদ্ধি খাটিয়ে বলি-ঐ যে তোর মা ডাকছে।
-আম্মার কাছে যাবোনা, আমাকে কোথাও যেতে দেয়না। আচ্ছা, বলোতো আমাকে এমন চোখে-চোখে রাখে কেন?
-তোকে খুবই ভালবাসে তাই।
-আচ্ছা, তুমি কাউকে ভালবাসোনা?
-হ্যাঁ বাসি।
-কাকে?
-তোকে, তোকে খুব ভালোবাসি।
-ভালবাসোতো তুমি আমাকে চলে যেতে বলছো কেন?
-তুই যে শুধু বিরক্ত করিস তাই।
-সবাই মিথ্যে বল, কেউ আমাকে ভালবাসো না। আম্মা-আব্বাও না, তুমিও না। সবাই শুধু আমাকে ধমক দাও।
কথা কয়টা বলে নীরব গম্ভীর হয়ে নিচের দিকে চেয়ে থাকে। যেন ওর মনে চরম দুঃখের জড় বেরিয়েছে, ঠিক সদ্য মন ভেঙে যাওয়া বিরহিণীর মত। ওর অভিমানে আমি দুঃখী হই কিনা জানিনা। কিন্তু ও রাগ করলে আমার যেন ব্যথা লাগে। তাই বলে বসি-আয় আমার কাছে আয়। পাগলী কোথাকার, একটুতেই শুধু রাগ করিস কেন? যারা তোকে ভালবাসে তারাই ধমক দেয়।
ভালবাসার দাবি থাকলে অধিকার নিয়ে অনেক কিছু বলা যায়। আর ধমক দেয়ার অর্থ তুই বুঝবি না। তোর অপরিণামদর্শী কথা ও কাজের জন্য তোকে ধমক দিতে হয়। নইলে যে বড় হয়ে আরো বেপরোয়া হয়ে যাবি।
আমার কথা গুলোর অর্থ সে বুঝলো কিনা জানিনা। আর আমিও অনর্থক যেন একজন অজ্ঞ লোকের কাছে সিলেবাসের শিক্ষার কথা বললাম বা অন্ধের কাছে প্রকৃতির সৌন্দর্যের বর্ণনা দিলাম। অবশ্য এ আমার গৌরবের কথা নয়। এটা আমার নিত্য ব্যবহার করা অভ্যাসের কথা, সাহিত্য ভাষা সৃষ্টির কথা। একটু উচ্চ এবং ভাল শাব্দিক ভাষা ছাড়া আমি যেন কথা বলতে পারিনা।
আমার কথাগুলো শুনে সে নীরব হয়ে মুখের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। কিছু বলতে গিয়ে যেন ভাষা খুঁজে পাইনা। তাই মান ভাঙ্গাতে আমি নিজেই বলি-কই, কথা বলছিসনা যে পলি?
একটু গম্ভীর হয়েই বললো-কি কথা বলবো?
-তোর যা ইচ্ছে তাই বল। আমিতো এখন তোর কথা শুনছি। তোর কথা শুনতে আমার খুব ভালই লাগে।
-আচ্ছা, এবার মেলাতে আমাকে একটা ভালো পুতুল কিনে দেবে?
আমি ঈষৎ হেসে তাতে সস্মতি দিলাম এবং বললাম-শুধু পুতুল কেন, তোর জন্য নখ পালিশ, লাল টুকটুকে লিপস্টিক, লেডিজ ব্যাগ, লাল কাঁচের চুড়ি, খেলনা আরো যা চাইবি, তাই দেব। আর মিষ্টিতো তোর জন্য ফ্রি, যত খেতে পারবি।
-বেশি কিছু চাইনা আমি, শুধু পুতুল পেলেই হলো। আর আমাকে একটা পুতুল কিনে দিলে আমিও তোমাকে একটা আংটি কিনে দিবো।
-তুই পয়সা পাবি কোথায়?
-মায়ের কাছে নেব, মা না দিলে তো আব্বা দিবেই।
-তোকে পুতুল কিনে দেব, কিন্তু আমি কিছু নেবনা।
-তাহলে আমিও নেবো না।
-পাগলী কোথাকার। আমি আংটি ভালবাসিনা, এজন্যই নেবনা। আর পুরুষদের হাতে আংটি পরতে হয়না।
সেদিন আর তেমন কোন কথা হয়নি। কাজ থাকায় চলে আসি। সে বছরই ঈদের মেলাতে ওকে একটা সুন্দর পুতুল কিনে দিই। সে থেকে সে ঐ পুতুলটা প্রতেক দিন প্রায় একবার করে আমাকে দেখাবেই। আমার আংটি নেয়া হয়নি যে তাকে দেখাবো।
কালের বিবর্তনে মনের অগোচরে অনেক দিন পার হয়ে গেছে। সে তখন অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী। আমি ডিগ্রী পরীক্ষাটা দিয়ে বেকার ঘুরছিলাম।
এর মধ্যে আমার জীবনেও অনেক পরিবর্তন হয়েছে। তাই ছোট করে হলেও একটা ব্যবসা পেতে বসেছি। ব্যবসায় কিছুটা উন্নতি দেখে বাবা-মা বিয়ের জাল ফেলার চেষ্টা করছেন। সব কিছু ঠিক ঠাক। আগামী মাসের দশ তারিখ বিয়ে। বিয়ের ব্যাপারে আমার তেমন আগ্রহ না থাকলেও আপত্তিও ছিলনা।
গ্রামেরই পলি। আর পলির সাথে প্রায় প্রতি দিনই কোন না কোন সময় দেখা হয়। কথাও হয়। এভাবেই বহমান ¯্রােত সময়কে হত্যা করে চলে।
বাইরে থেকে ঘরে ফিরে দেখি আমার টেবিলের উপর একটা পুতুল। ভাবলাম কোন দৈত্য দানব হয়তো? দেখি না, তা নয়। এটা পলিরই পুতুল। তখনকার মত রং নেই, মলিন হয়ে গেছে। যেন দুঃখে ভারাক্রান্ত নীরব একটি পাথর জীবন। কিন্তু টেবিলের উপর এ পুতুল এলো কেন? যেন একটা বিভীষিকায় পড়ে গেলাম। কেননা প্রায় ৮/৯ বছর আগে তাকে এ পুতুল কিনে দিয়েছিলাম। সেই পুতুল কেন সে এখানে রেখে গেছে? চিন্তার খোরাক শেষ হয়না। হয়তো এমনি রেখে গেছে। শুয়ে যাই। ঘুমিয়ে পড়ি।
-মাশুক ভাই…
-কে?
-আমি পলি।
-এতো রাতে কেন এসেছিস?
-না, রাত নয়তো, এখন দিন। তুমি ঘুমিয়েছ তো তাই রাত মনে হচ্ছে।
-কিছু কি বলছিস?
-না, কিছু বলতে আসিনি, এমনি দেখা করতে এলাম।
-বসবি?
-না, বসবোনা, মা বকবে। আচ্ছা তোমার নাকি বিয়ে?
-হ্যাঁ, কেন তুই শুনিসনি। শুনেছি, বিশ্বাস করিনি।
-কেন বিশ্বাস করিসনি?
-জানিনা।
-ও আমি তোকে বলিনি এজন্যে?
-না তাওনা।
-তবে………? ঘুম ভেঙ্গে যায়। একি?
আমিতো এতক্ষণ স্বপ্ন দেখলাম। কিন্তু…….্ পলিকে তো আমি কখনও এভাবে স্বপ্নে দেখিনি? লাল পাড়ের টিয়া রঙের শাড়ী, হাত ভর্তি লাল চুড়ি, গলায় ফুল জড়ানো জরির মালা, মুখের সমস্ত অংশ জুড়ে রং বেরঙের ফোটা, গায়ে হলুদের গন্ধ। ক্ষণিকের জন্য দেহটা নীরব, অথচ মনটা নদীতে ডুবতে গেলে যেমন ছটফট করে। কিন্তু কল্পনা না করলে তো স্বপ্ন আসেনা? আমিতো পলিকে কখনও ভাবিনি। তবে এমন স্বপ্ন দেখলাম কেন? আবার মনকে সান্ত¦না দিই। শয়তানের কান্ড। শয়তান খুব ধুর্ত। মানুষের মনে বিভেদ ধরাতে জানে, ঘর ভাঙ্গতে জানে, সংসার ভাঙ্গতে জানে। যে কোন মানুষের মনে স্বপ্ন দিয়ে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে।
আরো দশদিন কেটে যায়। চৈত্রের পাঁচ তারিখ। কয়েকদিন পর বিয়ে। বাজার থেকে বাড়ি আসতে না আসতে মা বলল ‘পলির আম্মা তোকে ডেকে গেছে এখনি যা’। সাথে-সাথেই গেলাম। বাড়িতে পৌছোতেই পলির আর্তনাদ শুনতে পাই। জিজ্ঞেস করতে-করতে ঘরে প্রবেশ করি।
-পলির কি হয়েছে? পলির আম্মা বললেন-আজ দশদিন থেকে ওর প্রচন্ড জ্বর। ডাক্তার বলে গেল ‘টাইফয়েড হয়েছে’। অনেক ভুল বকছে প্রলাপে তোমার নামও বলছে বাবা। গিয়ে দেখ, তোমাকে হয়তো চিনতে পারে কিনা? পলির পাশে গিয়ে বসি। মুক্ত মনে ¯েœহের আদরে ওর গায়ে হাত বুলিয়েছি। আজ ও অসুখে ছটফট করছে অথচ ছুঁয়ে কিছু বলতে পারছিনা। কেমন একটা সংকোচ মনে দানা বাঁধে। তাই শুধু মুখে বলি-পলি আমি মাশুক, তুই আমাকে চিনতে পারছিস? বড়-বড় চোখ করে আমার দিকে খানিকটা তাকিয়ে নিল। যেন আমি ওর আজন্ম শত্র“। কিছু মনে করলামনা। হয়তো অসুখে ওর মনটা তিক্ত-বিক্ত হয়ে গেছে।
আবার বললাম-তোর অসুখ আমাকে বলিসনি কেন?
কাতরাতে-কাতরাতে না পেরেও বললো-অসুখ কই আমার তো কোন অসুখ হয়নি। তোমার বিয়েতো তাই আনন্দে শরীরটা একটু খারাপ হয়েছে। তুমি চেয়ে দেখ আমার মুখের দিকে, এই যে আমি হাসছি। হাসি না আসলেও সে যে মিথ্যে করে হাসার চেষ্টা করছে তা আমার বুঝতে দেরি হলোনা। বলতে লাগলো-
-আমার কোনো অসুখ হয়নি। আচ্ছা তোমার বিয়েতে আমাকে নিয়ে যাবেনা? দেখ আমি কি সুন্দর হয়ে বসে আছি। আচ্ছা আমি যদি না যেতে পারি তবে আমার পুতুলটা নিয়ে যাবে। বল, বল মাশুক ভাই। পলির প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাইনা আমি। ওর কথার তাৎপর্য না বুঝেই যেন কিংকর্তব্য বিমুঢ় হয়ে যাই। ওর দিকে চাইতে গিয়ে কখন সহসা চোখের কোণে অশ্র“ জমে যায়। এক সময় টপ-টপ করে কয়েক ফোটা অশ্র“ পায়ের উপর পড়ে যায়। আমার সমস্ত দেহ মনকে আসতে-আসতে চুম্বকের মত আকর্ষণ দিয়ে কাছে টেনে নেয়। ওর ব্যক্ত ব্যথায় আমি মুসড়ে পড়ি। সইতে পারছিনা। ভাবনার অতল তলে নিমজ্জিত হই।
-কেন তার এ অভিমান? তবে কি সে আমাকে ভালবাসে? কিন্তু এতদিন সে এ কথা আমাকে একবারওতো বলেনি? আমার বিয়ের জন্যেই কি তার এ অসুখ? যদি তাই হয়, তবে আমারওতো কিছু প্রশ্ন করার ছিল?
মনে মনে অনেক কথা বলার কল্পনা করেও তাকে কিছু বলতে পারলামনা। চকিতে জাগিত ভালবাসার ব্যর্থ মনোরথ নিয়ে ফিরে এলাম। এতদিনে আমারও অনুভবে কথা বললো-আমি যেন পলির দুরন্ত গতিস্রোতের সাথে জড়িয়ে আছি। শুধু প্রকাশ করার ভাবনাটা মাথায় আসেনি। ঠিক তÍ মতই।
জীবন ছুঁয়ে গেল চেপে রাখা গোপন ভালবাসার পদ্মকলিতে। তবুও এ আমার কাছে অনেক দুর্বোধ্য। এ তার অপ্রত্যাশিত দুর্লভ বাসনা। হয়তো আমারও। কিন্তু এর মধ্যে একটা চরম সত্য বার-বার উঁকি দিয়ে চলেছে। কারণ যে আশায় মমত্ব আছে, অথচ গাঢ়তা নেই, যে আশার ফুলকলি আছে, অথচ ফাগুন নেই, যে নদীতে নৌকা আছে, অথচ মাঝি নেই তার কোন অর্থ হয়না। সমস্যা হয়ে থেকে যায়। আমার আজীবন লালিত বাস্তব বিয়ের প্রথম সোপানে ভাঙন ধরাতে ইচ্ছে হলেও হৃদয়ের সংযমী পোকাটা শ্রদ্ধার কাছে এতটুকু বেয়াদবী করতে পারেনা। কিন্তু ভালবাসার কাছে তার ভুমিকা কি? একদিকে বিরাট আয়োজন, অপরদিকে পলির একান্ত ভালবাসা। চোখ দু’টো ঝাপসা হয় এলোমেলো চিন্তার সাগরে। রাত হয় দিনের শেষে। ভাবতে-ভাবতে ঘুম পোকাটা ক্লান্ত হয়ে পড়ে। সহসা ঘুমিয়ে যাই। আবার স্বপ্ন দেখি, ঘুম ভেঙ্গে যায়। একি কথা স্বপ্ন থেকে শুরু করে সব সময় আমার অন্তর সত্ত্বায় প্রতিধক্ষণিত হতে থাকে।
-মাশুক ভাই, তুমি না আমাকে বলেছিলে, ‘তোকে ভালোবাসি’। এই কি তোমার ভালবাসা? তোমার দেয়া পুতুল আমি নিজেই তোমাকে ফিরিয়ে দিয়েছি। তোমাকে আমি ভালবাসতে পেরেছি, কিন্তু তোমার মন জয় করতে পারিনি। শুধু মায়া দিয়ে জড়িয়ে রেখেছি। তোমার বিয়ে, আমার কি যে আনন্দ হচ্ছে তা তোমাকে বোঝাতে পারবোনা। কিন্তু কেন যেন বুকটা আমার বেদনায় থরথর কাঁপছে। গোলাপ তুলতে গিয়ে যেন কাঁটায় আঘাত লাগছে।
আমার জ্ঞানেন্দ্রিয়ে পলির তাকানো করুণ স্মুতির জ্যোতি বার-বার শিহরণের ঝিলিক দিয়ে যায়। আমাকে চিরসাথী করার আশায় প্রতীক্ষমান একটি কোমল, কচি প্রাণের ব্যগ্র ব্যাকুল আহবান আমার অনাস্বাদিত আত্মাকে পলে-পলে বিড়ম্বনায় ভারাক্রান্ত করে তোলে।
এমনি ভাবে দিন এগোতে থাকে। সহসা উত্থাপিত অকল্পনীয় সমস্যার কোন সমাধান হয়না। রাতের কুয়াশা সকালে ফুরিয়ে যায়। সূর্যের প্রখর দীপ্ত আলোকের মাঝে ভাবনার পোকাগুলো গোল পাকাতে থাকে। রাতের নিরিবিলিতে একটু স্তিমিত হয়ে কিছু স্বাভাবিকতা ফিরে আসে। আবার লদ্ধ ফলে পৌছার পূর্বেই মোড় ঘুরে যায়। জন্ম হয় এক ভাবনা থেকে আর এক ভাবনার। দুই নেতৃস্থানীয় ভাবনার মধ্যে তুমুল লড়াই চলতে থাকে। কেউ কারো কাছে পরাজয়ের গ্লানি মেনে নিতে পারেনা।
অবশেষে ধার্য্য দিন দ্বার প্রান্তে পৌছে যায়। রাত থেকে বাড়িতে অতিথি মেহমানদের আনাগোনা। বাড়িতে যেন একটা মেলা বসে গেছে। কে কি খাবে, কে কি নিবে, কে কি করবে? এই নিয়ে সবাই ব্যস্ত। তবু হাজারও ব্যস্ততার মাঝেও আমার কর্ণ কুহরে কলরবের বিন্দুমাত্র প্রতিঘাতও লাগছে না। সকল আয়োজনের বাস্তব প্রতিচ্ছবিটাও আমার নয়নাক্ষি এড়িয়ে যাচ্ছে। আমার কর্তব্যবোধের সকল নির্বাচন নিগলিত হয়ে ধীরে-ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। বাড়ির আঙিনা ভরা মানুষের কলকন্ঠের ধ্বণি ইচ্ছে করে উপভোগ করতে যাই, কিন্তু হয়ে উঠেনা। নির্বাক দৃষ্টি নিয়ে শাখের করাতের দিকে নিবিষ্ট মনে চেয়ে আছি। এর মধ্যে গীত কন্ঠে এলো অনেক কয়টা হুরপরী। আমার হতভম্বের ভাবটাকে তারা অভিনয় বলে শনাক্ত করলো। আমি কিছু বলার আগেই ওরা আমকে সময় না দিয়ে হলুদ মাখাতে লাগলো। আমি শুধু কা-পুরুষের মত নীরবে সব সয়ে যেতে থাকলাম। অত্যধিক উচ্চ ভাষার কথাগুলো আজ মনের মাঝে পলির মুখচ্ছবিটা ক্রমাগত স্থান করে নিতে থাকে। ধীরে-ধীরে সব আয়োজন আমার কাছে তুচ্ছ মনে হয়। আমার ন্যায়াধীশ বিবেক আদালতে পলির ভালবাসাকে জয়ী কর নিতে চায়। ভালবাসার মর্মস্পশী শিহরণ আমাকে বার-বার ঝাঁকি দিতে থাকে। এক সময় চোখ থেকে অনবরত অশ্র“ধারা প্রবাহিত হতে থাকে। রুমালে মুছে ফেলি। কিন্তু অন্তরের রক্তক্ষরণের অশ্র“তো আর মুছা যায় না। কাজল যখন কালি হয়ে যায়, তখনও তাকে মুছে ফেলে মুখচ্ছবিটা স্বাভাবিক সৌন্দর্যে আনা যায়। কিন্তু অদৃশ্য হলেও অন্তর এমন একটা বস্তু, যার মাঝে দাগ ধরলে সে দাগ কিছুতেই মিলিয়ে দেয়া যায় না। বরং আজীবন কালের জন্য একটা ব্যর্থ আশার সাক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়।
পলির অসুস্থ ও পীড়িত অবস্থার কথা মনে করে এবং তার ভালবাসার প্রতিবাদে আমি বর গমনের সব প্রস্তুতির আয়োজনকে ধ্বংস করে ফেলার স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হই। আনন্দে মুখরিত সব আত্মীয় স্বজনদের চোখ ধাঁধিয়ে ছুটে যাই পলির কাছে। আমার মনের ভিতর থেকে কথাগুলো উপচে পড়তে থাকে। পলি, আমিও তোমাকে ভালবাসি। তুমি ছাড়া জীবনে আর কিছু নেই। তোমাকে জীবন সাথী করে বেঁচে থাকতে চাই। এইতো আমি সমস্ত কিছুকে তচনচ করে তোমার কাছে ছুটে আসছি। তুমি আর একটু অপেক্ষা কর। তোমাকে দেয়া পুতুলটা আমি নিয়ে আসছি………। কিন্তু হায়-যেতে না যেতেই সূর্যের অস্তগামী লাল আভাটা আকাশের সীমানা পেরিয়ে চিরদিনের মত বিদায় নিয়ে…….।

লেখক ঃ সাংবাদিক, শিক্ষক ও লেখক।