গাজীউল আলম
গ্রামের অতিসাধারণ; কিন্তু ভ্রমণপিপাসুদের সাথে নিয়ে অতিসাধারণ একজন ভ্রমণপিপাসু হিসেবে সিলেট ও মৌলভীবাজার ভ্রমণ করা হয়েছে। সেই ভ্রমণে মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত, চা বাগান ও অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি জাফলং দর্শন করা হয়েছে।
সময়টা ছিল ২০১৯ সালের মার্চ মাসে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল থেকে আমরা ৪২ জন একটি রিজার্ভ বাসে উঠি। সারাদিন সারারাত ছুটে, বিভিন্ন রকম গল্প আর মজাদার আড্ডা দিতে দিতে ভোর রাতের দিকে পৌঁছে যাই মৌলভীবাজার শহরে। সেখানে সকালে হালকা নাস্তা সেরে ছুট দিই নির্দিষ্ট গন্তব্যের উদ্দেশ্যে।
মৌলভীবাজারের ছোট ছোট টিলা আর পাহাড়ের গায়ে লেগে থাকা চা বাগানের মনোরম দৃশ্য উপভোগ করতে করতে ছুটে চলি মৌলভীবাজারের বিখ্যাত দর্শনীয় স্থান মাধবকুণ্ড জলপ্রপাতের উদ্দেশ্যে। সকাল ৯টায় পৌঁছাই সেই কাক্সিক্ষত মাধবকুণ্ডে । নির্দিষ্ট ফি দিয়ে টিকিট কেটে সবাই মিলে হৈ-হুল্লোড় করে মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা উপজেলায় অবস্থিত এদেশের সর্ববৃহৎ জলপ্রপাত মাধবকু- জলপ্রপাত দেখতে ঢুকে পড়ি।
পাথারিয়া পাহাড়ের গায়ে অবস্থান এই জলপ্রপাতের। এই পাহাড়ের পূর্ব নাম, আদম আইল পাহাড়। প্রায় ১৬২ ফিট উপর থেকে পাহাড়ের গা বেয়ে মাধবছড়া ঝর্না প্রবাহিত হচ্ছে। বিশাল বিশাল পাথরের ওপর আছড়ে পড়ছে ঝর্নার পানি। মাধবছড়া বা মাধবকু- ঝর্না ধারা পর্যটকদের আকৃষ্ট করে, বিমোহিত করে এর নিজস্ব সৌন্দর্য ও ভালোবাসা দিয়ে। এই ঝর্নার মূল ধারা ১২ মাসই প্রবাহিত হয়। শীতকালে হালকা প্রবাহিত হলেও বর্ষাকালে প্রবল বেগে ঝর্না প্রবাহিত হয়। বর্ষাকালে এই মূল ধারার পাশে প্রচণ্ড পানির তোড়ে আরেকটি ঝর্নার সৃষ্টি হয়। ফলে এই দুই ঝর্না ধারা মিলিমিশে একাকার হয়ে যায়। সৃষ্টি হয় এক অপূর্ব নৈসর্গিক মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্যের।
এই ঝর্না ধারা প্রবাহিত হয়ে আরেক সৌন্দর্যের মায়াভরা স্থান হাকালুকি হাওরে মিলিত হয়। এই ঝর্নার কাছে গেলে আপনি যেই বয়সেরই হোন না কেন, বিশেষ করে বর্ষাকালে, এই ঝর্নার প্রবাহমান সৌন্দর্য আপনাকে ভুলিয়ে দিবে সবকিছু। ইচ্ছে হবে, সেই শৈশবে যেমন উঁচু পুকুর ও নদীর পাড় থেকে, লাফ দিয়ে পড়েছেন, সাঁতার কেটেছেন; সেরকমটি করতে। কিন্তু বিশাল উচ্চতা আর কঠিন শিলাস্তর আপনার সিদ্ধান্তকে বদলে দিবে। মনে করিয়ে দিবে বাস্তবতা।
শত শত পর্যটক ঝর্নার পানিতে কেউ গা ভেজাবার চেষ্টা করছে, কেউ বিস্ময়কর দৃষ্টিতে অপলক তাকিয়ে দেখছে। এই বিশাল বিশাল পাথরের তৈরি এই মায়াময় পাহাড় আর তার শীর্ষ থেকে নেমে আসা অপূর্ব সৌন্দর্যের ঝর্নাধারাকে ফ্রেমে বন্দী করে রাখতে অনেকেই ব্যস্ত ছবি তুলতে।
আমরাও ঝর্না থেকে নেমে আসা প্রবাহিত পানিতে পা ভিজিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অবাক চোখে তাকিয়ে দেখতে থাকি বিশাল পাহাড় আর পাহাড়ের গায়ে লেগে থাকা ছোট-বড় বিভিন্ন গাছপালা, গুল্মলতা। বিশাল বিশাল পাথরের ফাঁকেই কিছু কিছু জায়গায় যেন গুহার মতো হয়ে আছে।
এই ঝর্না প্রবাহিত হয়ে যাচ্ছে যে পথে, সেখানে শিশু ও বড়দের জন্য রয়েছে বিভিন্ন বিনোদনের ব্যবস্থা। আছে ওয়াচটাওয়ারও, এই দৃশ্যকে প্রাণভরে উপভোগ করার জন্য।
পাহাড়ের গায়ে বসবাস করে খাসিয়া জনগোষ্ঠী। আশপাশেও রয়েছে। ঝর্নার পাশের পাহাড়ে উঠে পাহাড়ের গায়ে তাদের ছোট ছোট কুটির দেখা যায়। ঝর্না আর পাহাড়ের সাথে লেগে আছে বিশাল বনভূমি। অপর পাশে রয়েছে বিস্তীর্ণ চা বাগান। ছোট ছোট টিলা আর পাহাড়ের গায়ে লেগে থাকা চা বাগান দেখে যেন মনে হয় মহান আল্লাহতাআলা সবুজ গালিচা বিছিয়ে পরম যত্নে ঢেকে রেখেছেন পাহাড়গুলোকে।
চা বাগানের ভেতরে কিছুদূর পরপরই দেবদারু গাছের মতো লম্বা গাছ লাগানো আছে। এগুলো কি গাছ,, আর কেন লাগানো আছে বুঝতে পারিনি। চা বাগানের পাশেই স্থানীয় লোকজন উন্নতমানের চা পাতা স্বল্পমূল্যে বিক্রি করছে। সেই চা পাতার ঘ্রাণই সাক্ষী দিচ্ছে তার নিজস্বতার। সবাই নিজ নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী ব্যাগভর্তি করে কিনছে।
সন্ধ্যা পর্যন্ত পুরো চা বাগান ঘুরে ঘুরে তার অপূর্ব ও নৈসর্গিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে থাকি। আনন্দের মুহূর্তগুলো যেন অতিদ্রুত শেষ হয়ে যায়। ঝুপ করেই সন্ধ্যা নেমে আসে। দেরি না করে দ্রুত সবাই মিলিত হই, উঠে পড়ি বাসে।
সন্ধ্যার পরপরই রওয়ানা দেই সিলেটের উদ্দেশ্যে। রাতে হযরত শাহ জালালের মাজারের পাশে রয়েছে অনেকগুলো আবাসিক হোটেল। সেখানে রাত্রি যাপন করি।
গভীর রাত পর্যন্ত হযরত শাহ জালালের মাজারে অবস্থান করি। পুরো মাজারটা ঘুরে দেখি। সেখানে বিভিন্ন প্রকার জিনিস ও দৃশ্য চোখে পড়ে। মাজারটি বড় একটা টিলার উপর অবস্থান করছে। বিশাল মাজার, তার গা ঘেঁষেই বিশাল মসজিদ। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে মূল মাজারে ঢুকি। সেখানে সঙ্গতি ও অসঙ্গতিপূর্ণ অনেক কিছুই চোখে পড়ে। সেগুলো না উল্লেখ করাই ভালো।
গভীর রাতে হোটেলের রুমে ফিরে মাত্র কয়েক ঘণ্টা বিশ্রাম নিই। এরপর ফজর নামাজ পড়েই গোছগাছ শেষ। হোটেলে বাকি সবার জন্য অপেক্ষায় আছি। সবাই একসাথে হলেই রওয়ানা দিব। কিছুক্ষণের মধ্যেই একে একে সবাই এসে হাজির হলো। হালকা নাস্তা সেরে ছুটলাম আমাদের অদেখা আরেক কাক্সিক্ষত সৌন্দর্য জাফলং উপভোগ করার উদ্দেশ্যে।
ছুটে চলেছি আমরা। সবার চোখে-মুখে যেন এক অন্যরকম আনন্দের উচ্ছ্বাস। পথিমধ্যে আরেকটা বিখ্যাত মাজারÑ শাহ পরানের মাজার পড়ে। সেখানে অল্প সময়ের জন্য বিরতি দেই। এটিও বিশাল একটা মাজার। স্বল্প সময় নিয়ে ঘুরে দেখা হলো। দেরি না করে আবার রওয়ানা দেই জাফলংয়ের উদ্দেশ্যে। যেহেতু খুব সকাল, তাই রাস্তা প্রায় ফাঁকা। ছুটে চলেছি দুরন্ত গতিতে।
প্রায় ঘণ্টাখানেক চলার পরই ডান পাশে দেখা মিলল বিশাল বিশাল পাহাড়ের। একটা পাহাড় যেন আরেকটা পাহাড়ের গায়ে লেগে আছে। যেন পাহাড়ের মেলা। এক অপূর্ব নৈসর্গিক সৌন্দর্য। সবাই অবাক হয়ে দেখতে দেখতে এগিয়ে যেতে থাকি মূল গন্তব্যের উদ্দেশ্যে।
সকাল প্রায় পৌনে ৯টার দিকে পৌঁছে যাই কাক্সিক্ষত গন্তব্যে। নেমে সবাই বিমোহিত হই জাফলংয়ের সৌন্দর্য দেখে। জাফলং সিলেট শহর থেকে প্রায় ৬৩ কিলোমিটার দূরে বাংলাদেশের সীমান্ত এলাক। ও-পাশে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের সীমান্ত। খাসিয়া জৈন্তা পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত এক অপূর্ব নৈসর্গিক সৌন্দর্যে ভরপুর মায়াভরা দৃষ্টিনন্দন মনোমুগ্ধকর পর্যটন এলাকা এই জাফলং।
ভারতের ডাওকি অঞ্চল থেকে ডাওকি নদী প্রবাহিত হয়ে আমাদের পিয়াইন নদীর সাথে মিশেছে। ছোট্ট এবং পাথর বিছানো স্বচ্ছ পানির পিয়াইন নদীর ও-পারে বিশাল বিশাল পাহাড়ের গায়ে লেগে আছে ছোট-বড় অসংখ্য বিল্ডিং। পাহাড়ের গা কেটে তৈরি পাকা রাস্তা, সেখান দিয়ে অনবরত ছুটে চলেছে বিভিন্ন যানবাহন।
তার ফাঁকে ফাঁকেই সবুজ বনভূমি। যেন এক স্বপ্নে দেখার মতো অবিশ্বাস্য সৌন্দর্য। সেই সাথে পাহাড়ের গায়ে মেঘরাশি যেন ঘন কুয়াশার মতো লেপ্টে আছে। মনে হচ্ছে, এই অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ না করতে দেওয়ার জন্য ঘন কুয়াশার মতো মেঘের চাদর দিয়ে ঢেকে দেওয়ার চেষ্টা করছে, সৌন্দর্য লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। আর এ কারণেই বোধ হয় সৌন্দর্য আরো বহুগুণ বেড়ে গেছে।
এখানে আসার পরে বুঝলাম, কেন এই রাজ্যের নাম মেঘালয়। মেঘালয় মানে মেঘের আলয় বা মেঘের বাড়ি। সত্যিই এই এলাকায় মেঘের বাড়ি। হালদকা মেঘরাশি যেন সবসময় ছেয়ে রেখেছে এই এলাকাটাকে।
দুপুর হলে গোসলে নেমে পড়ে সবাই পিয়াইন নদীতে। পাথর বিছানো পিয়াইন নদীর স্বচ্ছ পানিতে সবাই জলকেলিতে মশগুল হই। পাহাড়ের গায়ে বসবাস করা ভারতীয়রা ও-পার থেকে নদীতে নেমে এলে সবাই মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। এ-পার আর ও-পারের সীমান্ত বাহিনীরা বাঁশি বাজিয়ে নিজ নিজ দেশের জনগণকে নিজ এলাকার সীমানায় রাখার চেষ্টা করে।
এ এক অন্যরকম মোহময়ী দৃশ্য, শুধু প্রাণভরে উপভোগ করা যায়, উপলব্ধি করা যায়, কিন্তু বর্ণনা করা যায় না। তবে সেখানে গিয়ে আফসোসও হয়। কারণ, পাহাড়ে ঘেরা অপরূপ সৌন্দর্যের বেশিরভাগ এলাকা ভারতের দখলে। এই অপরূপ সৌন্দর্য শুধু একেবারে অতি সন্নিকটে দাঁড়িয়ে দেখেছি; অথচ মাত্র দুই কদম দূরে হলেও যেতে পারছি না। হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যায়, কিন্তু ছুঁতে পারছি না। কারণ সেটা অন্যের সম্পত্তি, আমার প্রিয় বাংলাদেশ নয়।
এবার হঠাৎ নজরে পড়ে, নদীর এ-পারেও বিশাল একটা পাহাড় আর তার গায়ে সুন্দর সুন্দর ইমারত। মনটা আনন্দে নেচে উঠে। যাক একটা সুন্দর পাহাড় তো আমার প্রিয় বাংলাদেশের দখলে আছে। তক্ষুনি ছুটে যেতে চাই সেখানে; কিন্তু পরক্ষণেই সব আনন্দ বিলীন হয়ে মন বিষাদে ভরে যায়। লক্ষ করি, নদীর এ-পারের পাহাড়ের সাথে ও-পারের পাহাড় সুন্দর একটা ঝুলন্ত ব্রিজের মাধ্যমে সংযুক্ত। আর সেখান দিয়ে একটার পর একটা বাস, ট্রাক ছুটে চলেছে। বুঝতে বাকি থাকল না যে, এটাও তারা ছাড় দেয়নি। এত আনন্দঘন মুহূর্তেও বুকের গহীন থেকে যেন চাপা কষ্টের একটা দীর্ঘশাস বের হয়ে আসে।
জোহরের নামাজ শেষে সবাই খাওয়া-দাওয়া সেরে নিই। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়। এবার ছোট্ট নদীর স্বচ্ছ পানিতে নৌকা নিয়ে ঘুরতে বের হই। কিন্তু সীমাবদ্ধতা থেকে যায়। সেই ঝুলন্ত ব্রিজটা আরো কাছ থেকে দেখার ইচ্ছে হয়, নদীর ও-পারে সিঁড়ি বেয়ে পাহাড়ের উপরে উঠতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু সীমান্তের সীমাবদ্ধতার কারণে সেই ইচ্ছেকে দমন করতে হয়। আর তাই নিজের দেশের এলাকাকে নৌকা থেকে প্রাণভরে উপভোগ করি। চেষ্টা করি পুরো সময়টাকে কাজে লাগাতে।
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে। হঠাৎ করে তৈরি হয় আরেক মোহময়ী সৌন্দর্যের। পাহাড়ের গায়ে গায়ে জ্বলে উঠে সমস্ত ইলেকট্রিক বাতি, সৃষ্টি হয় আরেক জাদুকরী দৃশ্য। গোটা পাহাড়গুলোই নিয়ন বাতির আলোয় ঝলমলিয়ে উঠে। সৃষ্টি হয় এক নৈসর্গিক সৌন্দর্যের। অবাক চোখে শুধু তাকিয়ে থাকি। আর সেই পাহাড়ের আলো পাথর বিছানো পিয়াইন নদীর স্বচ্ছ জলে প্রতিফলিত হয়ে এক অন্যরকম মায়াবী সৌন্দর্যের সৃষ্টি হয়।
অন্ধকার ঘনিয়ে আসে, রাত হয়। এবার রওয়ানা দেয়া দরকার। কিন্তু জাফলংয়ের অপরূপ সৌন্দর্য মোহাবিষ্ট করে আঁকড়ে ধরে রাখতে চায়। তবে সেই আকর্ষণ উপেক্ষা করেই ফিরে আসতে হয় আপন ঠিকানায়।
গাজীউল আলম : অধ্যক্ষ, গোলাবাড়ী কলেজ, নাচোল